তাও তে চিং হল সহজ পথের নিশানা। লাউৎস এর জীবনবাদও বলা হয়। এটি এমন এক সততার খোঁজ, যা ইশ্বরের চেয়েও পুরনো।
তাও তে চিং হলো লাউৎস এর রহস্যে ভরপুর দার্শনিক মতবাদ নিয়ে লেখা চীনা ভাষার বই। বইটিতে পাঁচ হাজার অক্ষরে সহজ সরল পথের সন্ধান দেওয়া হয়েছে। বইটির বাংলা অনুবাদ করেছেন সরকার আমিন।
১.
লােকেরা যখন কোনােকিছুতে সৌন্দর্য দেখে অন্যকিছুকে মনে হয় দারুণ কুৎসিত লােকে যখন কোনােকিছুকে ভালাে বলে অন্যকিছুকে তাদের মন্দ বলে মনে হয়।
থাকা আর না-থাকা একে অন্যকে সৃষ্টি করে জটিলতা আর সহজতা একে অপরকে সমর্থন করে হ্রস্ব্য আর দীর্ঘ তাে একে অপরকে চিহ্নিত করে। উঁচু এবং নিচু একে অপরকে নির্ভর করে পূর্ব এবং পর একে অপরকে অনুসরণ করে।
২.
গুরু তার কাজ করে যান কোনাে কিছু না করেই দীক্ষা দেন তিনি নিঃশব্দে। যখন কিছু জাগে তিনি জাগতে দেন যখন কিছু লুপ্ত হয় বিলুপ্ত হতে দেন যা আছে তাকে ত্যাগ করতে তাঁর কোনাে দ্বিধা নেই
তিনি প্রত্যাশা ছাড়াই কাজ করে যান। যখন শেষ হয় তাঁর কাজ তিনি তা ভুলে যান একারণে বেঁচে থাকে চিরকাল তাঁর অবদান।
যদি মহাপুরুষকে অতিরিক্ত বড় কর সাধারণ মানুষ হয়ে পড়ে অসহায় রকম ছােটো যখন সম্পদের অতিমূল্য প্রচার কর লােকে চুরি করতে প্রলুব্ধ হয় ।
দীক্ষা দেন গুরু মানুষকে মন থেকে মুছে দিয়ে মােহ অপসারণ করে দিয়ে বাসনা শিক্ষা দেন গুরু কেমন করে সহসা সবকিছু থেকে থাকা যায় মুক্ত ।
গুরুর শিক্ষায় মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত হয় সে বিষয়ে যে বিষয়ে সে অতিবেশি নিশ্চিত।
কিছু না, অনুশীলন কর সবকিছু পাবে ।
৩.
তাও যেন এক ঝরনা। সতত দানশীল, কখনাে ফুরায় না তাও যেন এক অনন্ত শূন্যতা ভরে আছে অসীম সম্ভাবনায় ।
তাও অদৃশ্য সদা জাগ্রত জানি না কে এর জন্মদাতা
তাও ঈশ্বরের চেয়েও প্রবীণ ।
তাও জন্ম দেয় ভালাে আর মন্দ
কোনাে পক্ষই নেয় না। গুরুরও নেই কোনাে পক্ষ তিনি সন্ত আর পাপীকে একসাথে স্বাগত জানান।
তাও যেন হাপর । ভেতরে শূন্যতা, সম্ভাবনায় অসীম যত বেশি গ্রহণ করবে, বেড়ে যাবে ততই বাচাল হবে যতটা বেশি। ততবেশি কম পাবে তাকে।
অতএব, কেন্দ্রে এসে মৃদুবাক হয়ে যাও তুমি।
তাও এক মহান মা। শূন্যতাময় সুষমা জন্ম দেয় অনন্ত পৃথিবী।
তাও আছে নিশ্চয় সব সময় হৃদয়ে তােমার গ্রহণ কর একে যখন যেমন যতটা প্রয়ােজন ।
তাও অসীম অনন্ত
কেন? কারণ সে গ্রহণ করেনি জন্ম সুতরাং মৃত্যু নেই তার
কেন সে অসীম? তার নেই কোনাে বাসনা সে সবার মাঝে বিলীন
সবার মাঝে করে বসবাস।
গুরু আছেন তাই তাে আছে তাও তাও মুক্ত সবকিছু থেকে সে থাকে সবকিছুর মাঝে আর লুকাতে পারে নিজেকেই নিজের ভেতর।
তাও এক অনন্য পূর্ণতা।
৪.
সার্বভৌম ভালাে যেন জল জলের মতাে সে কাজে লাগে সকলের মানুষ ঘৃণা করে নিচুভূমির জল তাও সতত নিমগ্ন ও নিম্নমুখী ।
বাস কর স্থলের নিকটে চিন্তা করাে সারল্যের সাথে সংঘাতে থাকো যতটা সম্ভব উদার শাসন করাে নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই যে কাজে খুঁজে পাও আনন্দ তা করাে সংকোচবিহীন পরিবার-জীবনে উপস্থিত থাক সব সময়।
যখন থাকবে যথেষ্ট সরল ভুলেও করবে না তুলনা কারাে সাথে কখনাে হবে না প্রতিদ্বন্দ্বী কারাের
দেখবে সবাই তােমাকেই ভালােবাসে সব'চে বেশি।
যদি পাত্র ভরে যায় বেশি
উপচে পড়বে যদি বড়াে বেশি ধার দিতে থাক ছুরি দেখা যাবে হয়ে গেছে ভোঁতা।
অর্থ আর নিরাপত্তার জন্য যদি বেশি বেশি পাগল হও দেখবে তােমার হৃদয়টিকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না যদি গ্রাস করে জনরুচি হয়ে যাবে তুমি জনতার ক্রীতদাস।
কাজ করাে আর ফিরে আসাে এটাই তাে পথ স্বস্তি আর শান্তি পাবার ।
৫.
তুমি কি রাখতে পারাে মনকে শান্ত শত ঘূর্ণিপাকে পারাে কি থাকতে একনিষ্ঠ অদ্বিতীয় এককে? সদ্যোজাত শিশুর মতাে ধারণ করতে পার দেহ পরিচ্ছন্ন রাখতে পার কি মনােদৃষ্টি থাকতে পার আলােকিত আলাে না জ্বেলে ? বাসতে কি পার ভালাে মানুষকে তােমার ইচ্ছার বােঝা চাপিয়ে না দিয়ে? জটিলতাকে কি পূর্ণ হবার দিতে পার পরিপূর্ণ সুযােগ?
প্রত্যাশাবিহীন কাজ নিয়ন্ত্রণবিহীন নেতৃত্ব অধিকারবিহীন অর্জন -এসবই তাে সবচে বড়াে গুণ।
৬
আমরা চাকার মাঝে স্পােকের মতাে গাঁথা বৃত্তের মাঝে শূন্যতা ফলাফল গতি
মাটির দলা দিয়েই তৈরি হয় পাত্র এ তৈরি করে শূন্যতা যা আমাদের প্রয়ােজন মেটায়।
ঘর বানাবার জন্যই মসৃণ করা হয় কাঠ ভেতরে থাকে শূন্যতা ফলাফল গৃহবাস
আমরা লিপ্ত থাকি সত্তার সাথে আমরা যা করি তা সত্তার অতীত।
রং অন্ধ করে চোখ। শব্দ নষ্ট করে দেয় কান গন্ধ শেষ করে দেয় স্বাদ | চিন্তা ক্ষত করে মন বাসনা ভ্রষ্ট করে হৃদয়
গুরু পৃথিবীকে সহজ করে দেখেন সবকিছুকে তিনি স্বীকার করে নেন
তার মহান হৃদয় যেন এক খােলা আকাশ।
সাফল্য ব্যর্থতার মতােই ভয়াবহ আশাও ভয়ের মতাে ভয়ংকর তবে এর কি মানে ‘সফলতা ব্যর্থতার মতােই ভয়াবহ’? সাফল্যের পরই আসে পতনের ভয় যখন কেউ দাড়ায় ভর দিয়ে পায়ে সেই কেবল বুঝতে পারে ভারসাম্য।
‘আশাও ভয়ের মতাে'- কথাটার কী তবে মানে? আশা আর ভয় একে অপরের ভূত যার উৎপত্তি চেতনা থেকে যখন নিজেকে ভাবি না তখন কি ভয়ডর থাকে?
পৃথিবীকে দেখাে সত্তার ভেতর ভালােবাসাে যা আছে যেমন ভালােবাসাে পৃথিবীকে নিজস্ব রীতিতে তাহলে বন্ধু হবে সব কিছুর ।
৭.
উপরে যা তা নয় উজ্জ্বল নিচে যা সে নয় গাঢ় এ ফিরে আসে শূন্যতার জগৎ থেকে এ অখণ্ড, যার নাম নেই এ আকারবিহীন আকার এ ছবিবিহীন ছবি এ হচ্ছে এক নিবিড় সত্তা, ধারণারও অতীত।
অনুসরণ করাে একে, যার কোনাে শুরু নেই, সমাপ্তি নেই।
তুমি হয়তাে পারবে না জানতে
তবে একে পেতে পার সহজ জীবনে
শুধু বুঝতে চেষ্টা করাে কোথেকে এসেছ তুমি এটাইতাে জগৎ প্রজ্ঞার মর্মশাস।
প্রাচীন গুরুর দিব্যদৃষ্টি ছিল ছিল গভীর ধ্যান জানতেন না তিনি প্রজ্ঞার সীমা আমরা তাে জানি কেবল তাদের জীবনের পােশাকি মহিমা।
৯.
তারা ছিলেন সতর্ক যেন পার হচ্ছেন পরিখা ভাবতেন আছেন শত্রুর এলাকায় তাঁরা জানতেন সৌজন্যের রীতি ছিলেন বরফের মতােন রূপান্তরশীল জানেন বিচ্ছিন্ন হতে যেন কাঠের টুকরাে উপত্যকার মতাে সম্প্রসারণশীল
ছিলেন তারা জলের মতাে স্বচ্ছ ।।
তুমি কতটা ধৈর্য ধরতে জান পারবে কাদামাটিকে শক্ত হবার দরকারি সময়টুকু দিতে?
তার মনে পূর্ণতার জন্য হাহাকার নেই। গুরু হাজির সর্বকাজে সব সময়।
শূন্য করাে মন সরিয়ে রাখাে চিন্তা হৃদয় তবে খুঁজে পাবে প্রশান্তি ।
অশান্তিকে গলা টিপে মেরে ফেল না এরও আছে পূর্ণতা পাবার অধিকার।
জগতের বিচ্ছিন্ন সত্তা ফিরে আসে উৎসে এই ফিরে আসাটাই খাঁটি এই সত্যটাকে যদি বােঝ তবে কেটে যাবে দ্বিধা আর দুঃখ
যতই সহজ হবে তুমি ফিরে পাবে ধৈর্য যতই নির্মোহ হবে ফিরে পাবে উপকারী মন
রাজর্ষি মহাৰ্ঘে দীপ্ত হবে হৃদয় তােমার হৃদয়কেই তখন মনে হবে তাও।
জীবন যেভাবে আসে
গ্রহণ করাে একে সহজ আনন্দে মৃত্যু যেভাবে আসুক।
গ্রহণ করাে একে সহজিয়া ছন্দে।
১০.
গুরুর শাসনে মানুষ শাসিত হয়
নিজেরই অজান্তে ।
সেই নেতা ভালাে যিনি ভালােবাসা পান সেই নেতা মন্দ নয় লােকে যারে ভয় পায়। তবে সেই নেতাই খারাপ লােকে যারে ঘৃণা করে।
যদি বিশ্বাস করতে না পার দেখবে মানুষ হচ্ছে বিশ্বাসঘাতক।
কথা নয় গুরুজি ভালােবাসেন কাজ সফল সমাপ্ত হলে কাজ লােকে বাহবা কুড়ায় আর বলে শুনেন এই কাজ কিন্তু আমরাই করেছি।
বিলুপ্ত হলে বুদ্ধি জন্ম নেয় চালাকি
পিছু হটে জ্ঞান বি হলে তাও-এ জন্ম নেয় মহত্ত্ব আর সৌন্দর্য।
সংসারে না থাকলে শান্তি অধঃপাতে যায় সন্তান তবে দেশ ডুবে গেলে নৈরাজ্যে জন্ম নেয় দেশপ্রেম।
ছুড়ে ফেলাে
প্রজ্ঞা ন্যায়
নৈতিকতা দেখবে মানুষ সুখী দেখবে মানুষেরা ঠিক কাজটি করছে নিজ থেকেই বন্ধ করাে মুনাফার কারবার।
দেখবে দেশে চোরের অস্তিত্বই নেই।
যদি এসব করতে নাইবা পার তবে দয়া করে থামাে। সবকিছুকে এগুতে দাও নিজের মতন আর থাকো তুমি সকল কিছুর কেন্দ্রে।
চিন্তাটাকেই থামিয়ে দাও দেখবে কোনাে সমস্যা নেই।
সাফল্য আর ব্যর্থতা খুব কি আলাদা কিছু?
ললাকে মূল্যবান মনে করে যে পথ তুমি তা অনুসরণ কর লােকে এড়িয়ে চলে যে পথ তুমিও এড়িয়ে চল সে পথ
কী অদ্ভুত!
মিছিলের লােকেরা সব সময় উত্তেজিত থাকে আমি একা পরােয়া করি না আমি একা পিছুটান নেই আমি একা উদাসীন ঘর নেই একা আমি একা অন্ধকার মানুষেরা খুব তীব্র করে স্তব তারা জ্যোতির্ময় তবে মানুষের আছে মতলব ।
আমি মিছিলের মানুষ নই। আমি সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝে উদাসীন
বাতাসের মতাে অনির্দিষ্ট। আমি সকলের মতাে নই আমি তাে করেছি পান মহান মায়ের স্তন্য।
গুরুর মনে বাস করেন তাও জ্বল জ্বল করে জ্বলে ।
কে পারে ধারণ করতে তাওকে হৃদয়ের মাঝখানে? অদৃশ্যে কে পারে সঁপে দিতে দেহ ও মন?
তাও তাে অতল অসীম অনাদি এক নিরঙ্কুশ অন্ধকার এক অনির্ণেয় আলাে।
যখন আমার হৃদয়ে তাকাই আমি দেখতে পাই আমার তাও অন্তর্যামী।
২২
যদি হতে চাও সমগ্র খণ্ড খণ্ড কর নিজেকে যদি হতে চাও ঋজু। নিজেকে বক্র কর। যদি হতে চাও পূর্ণাঙ্গ নিজেকে অপূর্ণ কর যদি পুনর্জন্ম চাও। আগে বরণ কর মৃত্যু। ত্যাগী হলে পরিত্যাগ কর পুরােটাই।
তাও নৈকট্যে এসে গুরু সৃষ্টির জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে যান নিজেকে বড়াে করে দেখার রােগ সেরে যায় দ্রুত লােকে তখন কেবলই দেখতে পায় তার অন্তর্গত আলাে । তার আগ্রহ নেই প্রমাণে। লােকে তাঁর কথা গেঁথে ফেলে প্রাণে। তিনি তাে ভুলে যান নিজেকে লােকে তাকে শনাক্ত করেন মনের ভেতর তিনি তাে ভুলে যান গন্তব্য। কিন্তু সব কিছুতেই থেকে যান অবশিষ্ট।
গুরু বলেন “যদি তুমি ত্যাগ কর তবে ত্যাগ কর পুরােটাই এ কথাও বলেন তিনি নিঃশব্দে সকল চেষ্টায় যদি থাকে তাও তবেই খুঁজে পাবে তুমি তােমার আসল তােমাকে।
নিজেকে প্রকাশ কর পুরােপুরি তারপর চুপ করে থাকো।
অনুভব কর প্রকৃতি-স্বভাব যখন সে বৃষ্টি কেবলই হয় বৃষ্টি যখন সে বায়ু কেবলই প্রবাহিত হয় উড়ন্ত মেঘের ভেতর রােদের লুকোচুরি দেখাে
তুমি যদি নিজেকে মেলে ধর তবেই তুমি এবং তাও দুই মিলে হবে এক বৎস, যদি গ্রহণ কর, তবে পুরােটাই কর।
তাও সমীপে নিজেকে মেলে ধর নিশ্চয় খুঁজে পাবে বিশ্বাস। সঠিক ঠিকানা খুঁজে পাবে সবকিছু।
২৪ যে দাঁড়ায় আঙুলে ভর দিয়ে সে আসলে দাঁড়ায় না যে ছুটতে থাকে সে বেশি দূরে যেতে পারে না
যে কাতর রােদের জন্য। সে নিভিয়ে দেয় অন্তর্গত আলাে যে নিজেকে বিজ্ঞাপিত করে সে আসলে নিজেকে জানে না যে খালি দাপট দেখায় সে ক্ষমতাকে চেনে না।
যে জাপটে ধরে থাকে সবকিছু
সে কিছুই ধরে রাখতে পারে না।
গ্রহণ যদি কর হৃদয়ে তাও তবে যাও কাজ কর আর ভুলে যাও।
পৃথিবী জন্ম নেবার আগে আকারবিহীন তবে বিশুদ্ধ কিছু একটা ছিল ।
এ ছিল প্রশান্ত, শূন্য, নিঃসঙ্গ, অপরিবর্তিত অনির্দিষ্ট এক অনন্তের উপস্থিতি এর কোনাে নামকরণ সম্ভব নয় এ যেন বা বিশ্বমণ্ডলীর মাতা আসাে একে তাও বলে ডাকি।
এ সবকিছুর মধ্যে প্রবাহিত বাইরে এবং ভেতরে। আর ফিরে ফিরে আসে সব কিছুর উৎসে বারবার।
তাও মহান মহান বিশ্বমণ্ডলী মহান পৃথিবী মহান মানুষ। এ চার মহান শক্তি।
মানুষ পৃথিবীকে অনুসরণ করে পৃথিবী বিশ্বমণ্ডলীকে অনুসরণ করে বিশ্বমণ্ডলী অনুসরণ করে তাও। তাও অনুসরণ করে তাকে।
হালকার উদ্ভব ভারী থেকে সব আন্দোলনের উৎস স্থিরতা।
গুরু সারাদিন কাটিয়ে দেন ভ্রমণে ঘর থেকে যদিও তার পা বাইরে পড়ে না দৃষ্টিভঙ্গির উজ্জ্বল আলাে নিয়ে তিনি তাে অবস্থান করেন নিজের ভেতর।
দেশের প্রভুরা সতত অস্থির কেন পায়চারি করে বােকাদের মতাে?
যদি ভেতরে তুমি অস্থির আর দূরবর্তী হয়ে পড় তবে তুমি হারাবে উৎসের প্রশান্তি।
যদি কেবল ছুটতে থাক হে অস্থির হারাবে আপনারে আপন মর্মমূল থেকে।
২৭
একজন ভালাে পর্যটকের কোনাে ছক থাকে না। এবং থাকে না ফেরার তাগিদ। ভালাে শিল্পী সজ্ঞা দিয়ে পথ চলে ভালাে বিজ্ঞানী তত্ত্বের দাসত্বকে অস্বীকার করে তার মন থাকে মুক্ত সতত ।।
গুরুর কাছে সকলেই পৌছুতে পারে গুরু কাউকেই করেন না প্রত্যাখান।
তিনি তৈরি যে কোনাে পরিস্থিতির জন্য এবং কিছুতে কিছু করেন না অপচয় এই তাে আলােকিত চিত্তের পরিচয়
কে ভালাে মানুষ ? যিনি মন্দ মানুষের শিক্ষক ! সে কি মন্দ মানুষ ? যে করে ভালাে মানুষের কাজ? তুমি যদি এটা বুঝতে না পারাে বৎস সকলই হারাবে।
পুরুষকে জানােনা ধারণ কর নারীত্ব। পৃথিবীকে কাঁধে নাও তােমাকে কখনােই ছেড়ে যাবে না তাও আর তুমি হবে ছােট্ট শিশুর মতাে কোমল।
সাদাকে জাননা ধারণ কর কালােকে
হও নিদর্শন। যদি হতে পারাে নিদর্শন
তাওকে পাবে এমন কিছুই থাকবে না বাকি
যা তােমার কাছে কখনাে থেকে যাবে অজেয়।
ব্যক্তিকে জানতে চেষ্টা কর থাকো নৈর্ব্যক্তিক গ্রহণ করতে চাও তাে পৃথিবী
হুবহু গ্রহণ কর। তাও উজ্জ্বলভাবে থেকে যাবে হৃদয়ে তুমি ফিরে পাবে তােমার আদি-অন্তর।
পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে একটি শূন্যতা থেকে কাঠ থেকে যেমন তৈরি হয় হাতল গুরু জানেন ভালােই হাতল ও কাঠের রহস্য তিনি সবই জানেন সকল কিছুর ব্যবহার।
তুমি কি পৃথিবীটাকে উন্নত করতে চাও ? আমার মনে হয় না এটা সম্ভব ।
পৃথিবী পবিত্র একে উন্নত করা সম্ভব নয়। পৃথিবীকে নিয়ে তুমি যদি উত্তেজিত হও তবে এর সর্বনাশ হবে তুমি যদি একে লক্ষ্য হিসেবে গণ্য কর তবে নিশ্চিত একে হারাবে ।
আছে সময় যা আছে সদা অগ্রসরমাণ সময় যা আছে সত্তার পেছনে আছে সময় যা আন্দোলিত করে এমন সময় যা অবনমিত করে। সময় যা সত্তার জন্য বীরত্বময়। সময় যা সত্তার জন্য নিঃশেষিত সময় সত্তার জন্য নিরাপদ। সময় সত্তার জন্য বিপজ্জনক ।
গুরু বস্তুকে অবিকলভাবে দেখেন। নিয়ন্ত্রণ করার কোনাে চেষ্টাই করেন না তিনি সবকিছুকে বিকশিত হতে দেন আর বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে যান নিজে।
কোনাে বিষয়েই জবরদস্তি কর না পদানত কর না শত্রুকে গায়ের জোরে প্রতিটি শক্তির আছে বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিংসা হিংসাকে আমন্ত্রণ জানায়।
গুরু নিজের কাজটা শেষ করে থেমে যান অনুভব করেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে যা নিয়ন্ত্রণহীন। দীক্ষিত করতে কাউকে তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন না অপরের স্বীকৃতির জন্য তিনি লালায়িত নন কারণ তিনি নিজেকে জানেন অফুরন্ত বিশ্ব খেলা করে হৃদয়ে তার।
অস্ত্র সন্ত্রাসের হাতিয়ার। সন্ত মানুষ একে ঘৃণা করে
অস্ত্র উৎপন্ন করে ভয় কেবল নােংরা প্রয়ােজন ছাড়া সন্ত মানুষ অস্ত্রের নিকট সাহায্য চায় না।
গুরুর সর্বোচ্চ লক্ষ্য শান্তি যদি বিনষ্ট হয় শান্তি তিনি কেমন করে শান্ত থাকেন? অবশ্য তার শত্রুরা কেউ দানব নন তারা সবাই তারই মতাে মানুষ তিনি কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করেন না বিজয়ে তিনি উল্লসিত হন না মানুষের দুর্দশায় কেমন করে তিনি উল্লাস করবেন?
প্রবল করুণা আর বেদনাসমেত দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে তিনি প্রবেশ করেন যুদ্ধে যেন তিনি অনিচ্ছুক প্রবেশ কবলেন বিপন্ন জানাজায়।
তাওকে ধরা যায় না তাও ইলেকট্রনের চেয়েও ছােটো এর মধ্যে মিশে আছে অগণিত গ্যালাক্সি ।
শক্তিমান পুরুষ আর নারী যদি হৃদয়ের মাঝখানে সমাহিত রাখেন তাওকে তবে সকলই তার কাছে মনে হবে সুষমাময় পৃথিবীকেই মনে হবে বেহেশত সে খুঁজে পাবে প্রশান্তি আইন কানুন তখন লেখা রবে কেবলই হৃদয়ে।
যখন তুমি নামকরণ কর আর তৈরি কর আকার জেনে রাখ তা কেবলই সাময়িক যখন তুমি তৈরি কর প্রতিষ্ঠান মনে রেখাে থেমে যাবে কার্যক্রম কখন থামতে হবে তা ভালাে মতাে জেনে নাও তবেই তুমি এড়াতে পারবে বিপদ।
সবকিছু তাও-এ এসে শেষ হয় যেমন সব নদী মিশে যায় ঘন নীল সমুদ্রে।
অন্যকে জানাকে বলে বুদ্ধি নিজেকে জানা মানে প্রজ্ঞা অন্যকে শাসন করা মানে ক্ষমতা নিজেরে শাসন করলে দেখা মেলে প্রকৃত শক্তির ।
যদি অনুভব কর তােমার আছে অনেক | তবেই তুমি সত্যিকারের ধনী তুমি যদি থাক সবকিছুর কেন্দ্রে
তবেই বিব্রত হবে মৃত্যু মৃত্যুর সাধ্য কি তােমাকে মারে !
৩৪
মহান তাও মিশে থাকেন সবকিছুতে সবকিছু জন্মায় তার হৃদয় থেকে। যদিও সব কিছুকে তিনি জন্ম দেননি তাও প্রবাহিত কাজের মাঝে যদিও নেই তার বাহাদুরি তিনি মিশে আছেন অসীম পৃথিবীর ভেতর।
তিনি সকল কিছুর মধ্যে বাস করেন সব হৃদয়ে তার বাস। সব হৃদয় বাস করে তার হৃদয়ে।
মহান যখন ভুলে যান তিনি মহান তখনই তিনি প্রকৃত মহান।
যে ধারণ করতে পারে মহান তাওকে সে যেতে পারে যেখানে খুশি বিপদ তাকে স্পর্শ করে না।
অনুভব করতে পারে সে মহাবিশ্বের সংহতি যে কোনাে যন্ত্রণা সইতে আপত্তি থাকে না তার কারণ তার হৃদয় জুড়ে বিরাজ করে প্রশান্তি।
সংগীত বা রান্নার গন্ধ মানুষকে আনন্দিত করে বিমােহিত করে তাও বিবর্ণ শব্দমালার মতাে তাকালে কিছুই দেখতে পাবে না শুনতে চাইলেও কিছুই শুনতে পাবে না যখন তুমি ধারণ করতে চাইবে ধরা সে দেবে হৃদয়ে তােমার ।
যদি কোনাে কিছুকে সংকুচিত করতে চাও তবে প্রথমে একে প্রসারিত হতে দাও যদি কোনাে কিছুকে শুষ্ক করতে চাও তবে প্রথমে একে প্রস্ফুটিত হতে দাও যদি কোনাে কিছু গ্রহণ করতে চাও তবে প্রথমে কিছু প্রদান কর - এই হচ্ছে কাজের মর্মসূত্র।
নরম কঠিনকে অতিক্রম করে কঠিনকে মন্থরতা রূপান্তরিত হয় দ্রুততায় তােমার কাজটি থাকুন রহস্যাবৃত মানুষকে প্রদর্শন কর কাজের ফলাফল।
৩৭
যদিও সব কিছুই হয়ে যায় তবে তাও কোনাে কিছুই করে না ।
শক্তিমান নর-নারী নিজেদের এর সাথে জড়িত করে সহজ স্বাচ্ছন্দ্যে সারা পৃথিবী রূপান্তরিত হবে।
মানুষ সারল্যে প্রাণিত হয়ে খুঁজে পাবে প্রাত্যহিক সংহতি, মুক্ত হবে ইচ্ছার দাসত্ব থেকে।
যখন থাকে না কোনাে অভিলাষ তখনই পাওয়া যায় প্রশান্তি।
৩৮
শক্তিমান কখনাে চেষ্টা করে না শক্তিমান হতে সাধারণ চেষ্টা করে অসাধারণ হতে
শেষে সাধারণই থেকে যায়
গুরু কিছুই করেন না।
তবে কিছুই অসমাপ্ত থাকে না সাধারণ মানুষ অনেক কাজ করতে চায় তাতে অনেক কাজই থেকে যায় অসমাপ্ত। দয়ালু মানুষ কিছু কাজ করতে চায় কিছু কাজ থেকে যায় অসমাপ্ত সঠিক মানুষ কিছু কাজ করতে চায় কিছু কাজ ফেলে রাখে অসমাপ্ত নৈতিক মানুষ কিছু কাজ করতে চায় যখন কেউ দেয় না সাড়া। তিনি প্রয়ােগ করেন শক্তি।
তাও-এ লুপ্ত হলে প্রথমে আসে ভালাে, ভালােয় লুপ্ত হলে আসে নৈতিকতা, নৈতিকতা লুপ্ত হলে আসে প্রথা।
প্রথা হচ্ছে সত্যের আবর্জনা, সকল সংঘাতের সূত্রধর।
এ জন্যই গুরু উপরে নয় বাস করেন গভীরে, কাণ্ডের সঙ্গে, ফুলের সঙ্গে নয়।
তার থাকে না কোনাে নিজস্ব অভিলাষ, তিনি বাস করেন বাস্তবতায়। থাকেন মুক্ত, মায়ার বন্ধন থেকে...
প্রাচীন চীনের দার্শনিক লাও ৎস রচিত ক্লাসিক গ্রন্থ তাও তে চিং-এর স্টিফেন মিশেলকৃত ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থটি আমাকে উপহার দেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী কবি দেলােয়ার হােসেন মঞ্জু।
বইটি পড়তে গিয়ে, ইলেকট্রিকের তারে ভেজা হাত পড়লে যে অবস্থা হয়-আমারও হয় সে দশা। এটি গ্রাস করে ফেলে আমাকে। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি—যে কাজ জীবনে করিনি—অর্থাৎ অনুবাদ—শুরু করব।
মনে হলাে লাওৎস আমাতে ভর করেছেন । বন্ধু মুজিব ইরম উৎসাহ দেন। বন্ধুবড়ভাই সাদ কামালী প্ররােচনা দেন। কানাডা থেকে সাদী ভাই পাঠালেন ডায়ান ড্রেহার প্রণীত দা তাও অফ ইনার পিস। পড়লাম । শুরু করলাম ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি। পেয়ে গেলাম বেশ কটা ওয়েব সাইট। কিন্তু বিপদে পড়লাম একেক জনের একেক ধরনের অনুবাদ দেখে।
হঠাৎ প্রশ্ন জাগল, আচ্ছা বইটির কি কোনাে বঙ্গানুবাদ বের হয়নি? বাংলা একাডেমী লাইব্রেরি চষে ফেল্লাম। পাই না পাই না। হঠাৎ পেয়ে গেলাম তাও তে-চিং : লাও-ৎস কথিত জীবনবাদ ১৯৬০ সালে নিউ দিল্লি সাহিত্য অকাদেমী প্রকাশিত অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গ্রন্থটিকে।
জ্বর থামল ঘাম দিয়ে; লাও ৎস-এর বাংলা হয়ে গেছে, তবে আমার আর অনুবাদ করার দরকার কী? কিন্তু 'আবিষ্কৃত এই বই আমাকে যথেষ্ট অবাক করল। ইন্টারনেটে খুঁজে পাওয়া 'তাও' অনুবাদ, স্টিফেন মিশেল-এর অনুবাদ আর অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবাদে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি।
বেশ বিভ্রান্ত হলাম। অমিতেন্দ্রনাথও বিভ্রান্ত হয়েছিলেন আমারই মতাে। তার বক্তব্য : “তাও-তেচিং-এর অনুবাদের শুরু করার আগে আমার জানা ছিল না যে নানান পণ্ডিত এই সূত্রগুলির নানা রকম ভাষ্য দিয়েছেন।
এমনকি কোনখানে কি শব্দ লেখা ছিল, আজ কি লেখা আছে, আর কি শব্দ লেখা উচিত এ নিয়েও তর্কের শেষ নেই।”
অনুবাদের রকমফের সম্পর্কে পাঠকদের একটু ধারণা দেবার জন্য তাও তে চিং-এর প্রথম অধ্যায়টির তিনটি অনূদিত টেক্সট তুলে ধরছি:
অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়-১৩১৭ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে ‘প্রবাসী' পত্রিকায় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাও-তে-চিং-এর আংশিক বাংলা অনুবাদ করেছিলেন।
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবাদটি দেখতে পাইনি তবু মনে হলাে শৈল্পিক গুণের দিক থেকে মিশেল-এর ইংরেজি অনুবাদই সেরা। আমাকে থামলে হবে না অনুবাদ করতেই হবে, মনে মনে ভাবলাম।
তাও দর্শন পাঠ করলে সহজেই কতগুলাে প্রশ্ন মনে উদিত হয়। তাহলে কি তাও জীবন-বিরােধী? নিশ্চলতা তৈরি করাই কি তাও দর্শনের কাজ?
প্রাথমিকভাবে তা মনে হতে পারে। কিন্তু গভীরভাবে, দার্শনিক চিত্ত দিয়ে বিবেচনা করলে মনে হবে লাও আসলে জীবনের পাশবিক উত্তেজনা থেকে মুক্ত হবার আহ্বান জানিয়েছেন, জীবন থেকে পলায়নের মন্ত্রণা দেননি।
লাও মানুষকে প্রতিযােগিতার উঁদুর দৌড় থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। প্রতিযােগিতার মদমগ্নতা মানুষকে উপহার দেয় উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা, যার অনিবার্য উপসংহার মনােবিকলন।
আমার কাছে মনে হয়েছে...তাও এর লক্ষ্য নিরাসক্ত-আনন্দ, নিঃশর্ত-উত্তেজনা নয় ...তাও এর লক্ষ্য-শৈল্পিক নির্জনতা- অসৎ কোলাহল নয়।
একটি সতেজ, সহজ, প্রশান্ত, আনন্দদায়ক ও সজ্ঞাতাড়িত জীবনের জন্য যারা যথেষ্ট পরিমাণে লালায়িত তারাই কেবল তাও দর্শন থেকে লাভবান হবেন। প্রলুব্ধ নয়, তাও জীবনের দিকে উদ্বুদ্ধ করে, কারণ তাও তে চিং অবশ্যই মৃত মানুষের উদ্দেশে রচিত কোনাে গ্রন্থ নয় ।।
৬ষ্ট শতাব্দীতে আরব দেশে আবির্ভূত মহাপুরুষ ‘জ্ঞানার্জনের জন্য চীন দেশে যাও বলে কেন আহ্বান জানিয়েছিলেন এই বইটি না পড়লে বুঝতে পারতাম না।
বইটি প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ভাষা ও সাহিত্য উপবিভাগের উপপরিচালক জনাব মােহাম্মদ মিজানুর রহমান; বাংলা একাডেমী প্রেসের ব্যবস্থাপক জনাব মােবারক হােসেন; ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও পত্রিকা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জনাব মােহাম্মদ আবদুল হাই আমাকে নিরন্তর উৎসাহ দিয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন।
এই উপবিভাগের কর্মকর্তা জনাব আফরােজা পারভীন গ্রন্থ প্রকাশের জন্য দরকারি দাপ্তরিক কাজে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন।
প্রফেসর আবু তাহের মজুমদার এবং নাট্যজন ও অনুবাদক খায়রুল আলম সবুজ। -এর কাছে আমি বিশেষভাবে ঋণী। অনুবাদগুলাে সর্বপ্রথম ‘দৈনিক সংবাদে ছাপা হয়েছিল কবি ওবায়েদ আকাশ-এর সৌজন্যে। এরপর ‘লেখাবিল’ ও ‘অগ্রবীজ' নামের দুটি লিটল ম্যাগাজিনও বেশকিছু অনুবাদ প্রকাশ করে।
বইটি প্রকাশের জন্য অনুমােদন দিয়েছেন আমার শিক্ষক বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ড. সৈয়দ মােহাম্মদ শাহেদ।