সমকালীন মার্কিন গদ্যকবিতা : রনক জামান PDF

27 minute read
0

সমকালীন মার্কিন গদ্যকবিতা নামে কবি চার্লস সিমিক, জেমস টেট, রবার্ট হাস এর কিছু অসাধারণ কবিতা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন অগ্রন্থিত ওহী হিসেবে পরিচিত কবি ও অনুবাদক রনক জামান।

সমকালীন মার্কিন গদ্যকবিতা


সমকালীন মার্কিন গদ্য কবিতা 


সমকালীন হল সমসাময়িক বা বর্তমানকে ধারণ করা সময়কাল। আমি মনে করি বর্তমান সময়ে মার্কিন সাহিত্যের গদ্যকবিতায় সিমিক, টেট এবং হাস এর অবদান ও প্রভাব বুঝতে এই বইটি পাঠকের জন্য বেশ সহায়ক হবে।

সমকালীন মার্কিন গদ্যকবিতা : রনক জামান
কবি রনক জামানের সহজ-সরল, প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন ভঙ্গি, উপমার বৈচিত্র্যতা, কবিতার টুইস্ট যে কোন কবিতা পাঠককে কবিতার প্রতি আরো আগ্রহী করে তোলবে।

চার্লস সিমিক এর সমকালীন কবিতা 

“আমার বিবেচনায়, আটপৌরে জীবনের আনন্দ থেকে বিচ্যুত ‘সত্য’ মূল্যহীন। প্রত্যেকটি মহা থিওরি ও সেন্টিমেন্টকে প্রথমে রান্নাঘরে এবং পরে বিছানায় পরীক্ষা করে দেখতে হবে।”
—চার্লস সিমিক  

এইসব কথা হুড়মুড় করে কেবল চার্লস সিমিকের মুখ থেকেই শুনতে পাওয়া যায়; যিনি অবলীলায় বলতে পারেন, ‘বাবার জ্ঞাতিরা ছিলেন আরও এককাঠি সরেস। 

তাঁরা আকণ্ঠ মদ পান করতেন, হই-হুল্লোড়ের মাস্টার ছিলেন একেক জন। আমার সাযুজ্য তাঁদের সঙ্গেই বেশি।' 

জন্ম ১৯৩৮ সালের ৯ মে, যুগােশ্লাভিয়ার বেলগ্রেডে। ১৯৫৪ সালে যখন দেশ ছাড়েন সারাজীবনের জন্য নাম লেখান উদ্বাস্তুশ্রেণিতে। বাস্তুচ্যুতি, নির্বাসন তাঁর জীবনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। 

সমালােচকগণ মন্তব্য করেন, ‘সিমিকের কবিতার সুর কেমন বিদেশি। জবাবে সিমিক বলেন, ‘টের পাই, আমার কেইসটা জটিল, আমার শ্রেণিকরণে বেশ সমস্যা, আমি না-নির্বাসিত, না-অভিবাসী, কিন্তু এ ব্যাপারে আমার সত্যি কোনাে মাথাব্যথা নেই। 

বস্তুত, একাধিক ভাষার উপর দখলদারি, ইউরােপের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা, সাম্প্রতিক ইতিহাসের সঙ্গে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কারণে সিমিকের কণ্ঠস্বরে ইউরােপ ও অ্যামেরিকার একধরনের মিশেল তৈরি হয়েছে। 

উদ্বাস্তু হয়ে তিনি সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে আসেননি; প্রথমে ফ্রান্সে উদ্বাস্তু ছিলেন। সেখানেই সিমিকের প্রথমবারের মতাে কবিতার প্রতি অনুরাগ প্রকাশ পায়। 

ইংরেজি শেখার জন্য মায়ের কিনে আনা ‘লাইফ’, ‘লুক’ ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে স্নানের পােশাক পরা নারী মডেল দেখা, আর স্কুলে বােদলেয়ার-ভার্লেনের কবিতাপাঠ ছাড়াও তাঁর কবিতার প্রতি আকর্ষণের আরও কিছু অকাব্যিক কারণের মধ্যে একটি ছিল মার্কিন চলচ্চিত্র দেখা। 

দশ কী বারাে বছর বয়সেই সেসব সিনেমা দেখে বেলগ্রেডের ভয়াল রাত্রিগুলাে তাঁকে ‘পােয়েটিক’ এক আচ্ছন্নতায় জানালার পর্দা তােলার সাহস জোগাত। 

তাঁর কবিতায় অকাব্যিক বিষয়ের প্রভাব তাই লক্ষণীয়, যেমন জ্যাজ ও ব্রজের গীতিময় প্রভাব। প্রথম-জীবনে চিত্রশিল্পী হওয়ার গােপন বাসনা তিনি মনে মনে লালন করতেন। 

পােস্ট-ইম্প্রেসনিস্ট শিল্পীদের অনুকরণ করে যাত্রা শুরু করলেও পরে জার্মান এক্সপ্রেশনিস্টদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। 

বয়স ৩০ পেরুনাের আগেই সেই ভূত মাথা থেকে সরে যায়। এর আগে একুশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ বের হয়। 

১৯৬৬ সালে বের হয় পূর্ণাঙ্গ কাব্যগ্রন্থ ‘হােয়াট দ্য গ্রাস সেজ’ এবং ১৯৬৯ সালে বের হয় ‘সামহয়ার অ্যামাং আস অ্যা স্টোন ইজ টেইকিং নােটস'। 

মূলত এই দু’টি বই সিমিককে পাঠকসমাজে নিন্দিত ও নন্দিত করে তােলে। আঠারাে বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে লিঙ্কন পার্কের এপার্টমেন্টে প্রতিবেশি হিসেবে যখন সান-টাইমসের এক সহকর্মীকে পান, তখন থেকেই সিমিকের কাব্যবােধ জেগে ওঠে। 

অধিবিদ্যায় নয়, জোর দিতে হবে যুক্তিতে; কল্পনাকে সন্দেহ, কবিতা সম্পর্কে সিরিয়াস গভীর ভাবনা-সবকিছুই তখন সিমিকের কবিতার বিদ্রোহী ভূমিকে ওলট-পালট করে দেয়। 

সিমিকের এই সহকর্মীই হয়ে ওঠেন তাঁর কবিতার প্রথম পাঠক। প্রথম দিকে হাট ক্রেনকে অনুকরণ করে সিমিক বহু কবিতা লেখেন। হার্ট ক্রেনের শব্দবন্ধ হুবহু চার্লস সিমিকের ২৫টি কবিতার তর্জমা করেছেন কবি, অনুবাদক রনক জামান। 

অনুবাদ করা হলাে কোনাে কবিতার সবচেয়ে নিবিড়তম পাঠের উপায়। মূল টেক্সটের দাস হয়ে নয়, অনুবাদক অনুবাদ করেছেন প্রেমিক হয়ে। 

সিমিকের কবিতায় এরকম অনেক লাইন পাওয়া যাবে যেগুলাে অনুবাদ করা রীতিমতাে অসাধ্য কাজ। 

মূল ইংরেজিতে সিমিক-পাঠের যে মজা, সেই একই সিমিককে আক্ষরিক বাংলায় খুব সহজে ধরা যায় না। 

অনুবাদক তাই বলছেন, “অনুবাদে মূলকবি ও তর্জমার মধ্যে তর্জমাকারীর অস্তিত্ব না রাখারই চেষ্টা ছিল।” 

সীমাবদ্ধতা অনুবাদের নাকি অনুবাদকের সেটা পাঠক বিচার করবেন। অদৃশ্য বিচারকের মতাে অনুবাদক ও সিমিকের মধ্যে রয়েছেন পাঠক। 

পাঠকদের উদ্দেশেই সিমিকের অনূদিত কবিতাগুলি প্রকাশিত হলাে।

– মেহরাব ইফতি, কবি


সমকালীন মার্কিন গদ্যকবিতা থেকে চার্লস সিমিকের চৌদ্দটি কবিতা


কসাইখানা

কখনাে গভীর রাতে হাঁটতে হাঁটতে এক বন্ধ কসাইখানার সামনে দাঁড়াই। 
ভেতরের বাতি একা জ্বলতে থাকে 
যেন মৃদু সে আলােয়, কয়েদিরা সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে পালাবার।

দেয়ালে ঝােলানাে অ্যাপ্রন : রক্ত লেগে আছে মানচিত্রের মতাে রক্তাক্ত মহাদেশ, নদী ও সাগর

ক্ষুরধার ছুরিগুলাে ঝিলিক দিচ্ছে 
চেনা অন্ধ-মন্দির-বেদির মতাে 
পঙ্গু জড়বুদ্ধি-প্রাণীদের চিকিৎসা করতে 
ওতে ধরে আনে ওরা।

কাঠের পাটাতন জুড়ে ভাঙা হাড়গােড় 
চাদরের শরীরে রক্তের শুকনাে নদী 
রাত্রি গভীর হলে, ওতে ডুবে যেতে থাকা কারাে চিৎকার শুনি।


আলো সবখানে

সম্রাটকে কিছুতেই বলা যাবে না যে রাত্রি নামছে। সৈন্যরা যত্রতত্র মােকাবিলা করছে ছায়ার আর রাতের নৈঃশব্দকে গ্রেপ্তার করে জ্বালিয়ে দিচ্ছে গ্রাম ও শহর। 

রাজধানীতে বাজেয়াপ্ত হচ্ছে ঘড়ি ও সময়। বিপ্লব পুড়িয়ে এঁকে দিচ্ছে নতুন সূর্যোদয়, প্রতিটি ছাদে, পরস্পরকে ওরা ‘সুপ্রভাত' জানাবে বলে। 

মােরগের কণ্ঠে কাকা। জোর করে ফোটানাে হচ্ছে ফুল। তবু আঁধার রয়ে গেল, রাজদরবারের মেঝে বরাবর, বাতিটির বিলকুল নিচে।


দুটো কুকুর 

চার্লস এবং হােলি'র জন্য

দক্ষিণে, অচেনা শহরে এক বৃদ্ধ কুকুর ভয় পেত নিজের ছায়াকে। 

গল্পটা যে শুনিয়েছিল সে মহিলা অন্ধ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ গ্রীষ্মের সুন্দর এক সন্ধ্যাবেলা 
ছায়াগুলাে প্রশস্ত হচ্ছিল হ্যাম্পশায়ার বনের ধারে দীর্ঘ গলিজুড়ে তখন কেবল এক চিন্তাগ্রস্ত কুকুর, একজোড়া হাঁস-মুরগী, সূর্য ডুবে যাচ্ছিল। দক্ষিণাঞ্চলীয় সেই নামহীন শহরটিতে।

মনে করিয়ে দেয়, জামান সৈন্যরা যখন মার্চপাস্ট করে পেরিয়ে যাচ্ছিল উঠোন, ১৯৪৪-এ। 
রাস্তার দু'ধারে দাঁড়িয়ে, আড়চোখে দেখছিল সবাই কম্পমান পৃথিবীতে হেঁটে যাওয়া মৃত্যু... 
একটি ছােট্ট সফেদ কুকুর, দৌড়ে এসে কামড়ে ধরে এক সৈন্যের পা। 
পরক্ষণে একটা লাথি—এমন উড়িয়ে দিলাে, যেন তার ছিল একজোড়া ডানা। 

আমি তাই দেখতে থাকি! রাত্রি নেমে আসে। 
আমার দৃশ্যজুড়ে : ডানাওয়ালা একটি কুকুর, উড়ছে।


হােটেল ইনসােমনিয়া

প্রিয় জানালা, ওপাশে ইটের প্রাচীরে আটকে গিয়েছে দৃশ্য। পাশের কামরায় পিয়ানাে ছিল। 

কখনাে সন্ধ্যাবেলা, একজন পঙ্গু বুড়াে এসে 
নীলাভ স্বর্গ-বাজাতাে।

অধিকাংশ সময় যদিও নৈঃশব্দ্য। কামরায় কামরায় কালাে কোট পরিহিত মাকড়শা— সিগারেটের ধোঁয়ায় বােনা জালে, শিকার করতাে। 

এতটা আঁধার, নিজের মুখটাও আয়নাতে পাওয়া যেত না।

ভাের ৫ টা, নগ্ন পায়ের আওয়াজ জিপসি জ্যোতিষীর, সারারাত কাম সেরে পেশাব করতে চলেছে। 

কাছেই কোথাও এক শিশুর কান্না শুনি। 
খুব কাছে। এত কাছে, মাঝে মাঝে মনে হতাে, আমারই বুঝি।


ছবিভর্তি বই

আব্বা— ধর্মতত্ত্ব পাঠ করছিলেন। পরীক্ষার সময়। মা–পাশে বসে জামা বুনছিল। আমি—নিঃশব্দ, পড়ার টেবিলে। খােলা বই, বইভর্তি অসংখ্য ছবি। 

বাইরে রাত্রি। মৃত সব রাজা-রানীদের চিবুক স্পর্শমাত্র ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে হাত।

উপরে শােবার ঘরে, কালাে রেইনকোট ঝুলছিল সিলিংয়ের তারে, কেন? মায়ের দীর্ঘ সুই এফোঁড়-ওফোঁড়। কালাে জামা। আমার মাথার গভীরের অন্ধকারটির মতাে।

বইটির ওল্টানাে পাতা, পাখির ডানার মতাে শব্দ তােলে। “আত্মা, স্বভাবে পাখির মতাে,” আব্বা বলতেন। 

আর তখন, ছবিভর্তি বইয়ের ভেতর বেঁধে গেল তুমুল যুদ্ধ : বর্শা, তরবারি, ঝনঝন—শীতের বনভূমি কেঁপে ওঠে। আর, ক্ষত-বিক্ষত হয়—আমার হৃদয়।


তরমুজ

সবুজ বুদ্ধ ওরা ফলদানিতে। রক্তাভ হাসিটুকু খেয়ে দাঁতগুলাে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলি।


একটি হারানাে জিনিসের বিবরণ

এর কোনাে নাম ছিল না। কোথায় কীভাবে পেয়েছি, তাও মনে পড়ে না। পকেটে নিয়ে ঘুরতাম ছিড়ে যাওয়া বােতামের মতাে। তবে বােতাম ছিল না।

সিনেমা, ক্যাফেটেরিয়া, অন্ধ সরাইখানা, সুইমিং পুল বা বৃষ্টিস্নাত গলিতে, যত্রতত্র—সাথে থাকতাে।

যেন অস্তিত্বহীন। যেন স্বপ্নের ভেতরের ছায়া, বা সূচাগ্রে বসে থাকা দেবতার মতাে স্থির। তারপর, একদিন হারিয়ে গেল। বছরের পর বছর কেটে গেল নামহীন স্টেশনে। যতক্ষণ না কেউ বলে দিচ্ছে জায়গার নাম; জানা হয় না।

আমিও কেমন বােকা! নেমে গেছি শূন্য প্লাটফর্মে। যেখান থেকে শহরে পোঁছাবার কোনাে রাস্তাও নেই।


ফোনকল

তাের জন্য মেসেজ রয়েছে, বােকাচোদা : আমাদের সাথে তুই পল্টি মেরেছিস। দোহাই, তােকে ক্রুশবিদ্ধ করে মারা দরকার।

কাকে? আমাকে?

রুটির গুড়ােগুলাে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেছে টেবিলের নিচে। ভয়ে জড়ােসড়াে। কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে আছে। কাপুরুষ কোথাকার!

আর এই যে এখন, দূর-ছাই!

আমার ভ্যাবাচ্যাকা খােলামুখ, জানালার কাঁচে দৃষ্টি। আগস্ট। আমার আততায়ী যেন বাইরের অন্ধকার। কালাে টুপি পরিহিত।

আপনি রসিকতা করছেন সম্ভবত। নয়তাে মস্ত ভুল বােঝাবুঝি । রং নাম্বার হতে পারে কি?

নাম্বার ঠিক আছে, বেয়াদব! অন্যের মগজ থেকে বলছি কেবল।


রাস্তায়

ছেলেটি জুতাের ফিতে বাঁধতে ঝুঁকেছিল। ভঙ্গিটিকে বিবাহ-প্রস্তাব ভেবে মেয়েটি রাজি হয়ে গেল:

– ওঠো। উঠে দাঁড়াও সুশ্রী যুবক, জ্বলজ্বলে চোখে বলল মেয়েটি। পথের অন্য সবাই পাশ কেটে হনহন চলে গেল গন্তব্যে। যেন মৌমাছি তাড়া করেছে।

– সমস্ত দিন বেলুনে উড়বাে আমরা, মেয়েটি সােৎসাহে ঘােষণা করে।

– ওতে উঠলে কানে তালা লেগে যায়, ছেলেটি জানায়।

– অনেক উঁচুতে উঠতে উঠতে আমরা ছুঁড়ে ফেলব যাবতীয় পােশাকসমূহ।

– আমার সিগারেট-আগুন খসে এদিক সেদিক পড়ে অগ্নিকাণ্ড হবে যে!

–ও নিয়ে ভেবাে না, কালাে মেঘের স্পর্শে নিভে যাবে সব। আর মেঘের শরীর গলে আমরা চলে যাবাে অন্য কোথাও। 

আমার গােপন সেই দরজা খুলে।


উনিশশাে আটত্রিশ

সে বছর নাৎসিরা ভিয়েনায় এলাে। সে বছর অ্যাকশন কমিকে সুপারম্যান প্রকাশিত হয়। সহকর্মী বিপ্লবী যারা, সবাইকে স্টালিন খতম করে। সেবারই প্রথম চালু হলাে ডেইরি কুইন। তখন আমি দোলনায় শুয়ে থাকা শিশু, হিসু করে তােয়ালে ভেজাই।

“খুব আদুরে বাচ্চা ছিলেন মনে হয়,” বিং ক্রসবি গেয়ে উঠলাে। সে বছর খবরের কাগজে এলাে, পাইলট নিউইউর্ক থেকে বিমান নিয়ে ভুল করে আয়ারল্যান্ড না নেমে কোরিগান চলে গিয়েছে। আমি তখন মায়ের কোলে, শালদুধ খাই।

সে বছর সেপ্টেম্বরে ঘূর্ণিঝড় হলাে। ওয়েস্ট হ্যাম্পটনের এক সিনেমা হল ভেসে গেলাে সমুদ্র-বুকে। সে বছর মানুষ ভাবলাে, দ্রুতই পৃথিবী ধ্বংস হবে। সমুদ্রের গভীরে, এক মাছ সেই সিনেমা হলে বসে ভাবছিল, সাত কোটি বছর তার আয়ু। পরদিন দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলে জেলেদের জালে সে ধরা পড়ে যায়।

আমি তখন দোলনায় শুয়ে, দিনগুলাে ক্রমশ ছােট আর শীতলতর হচ্ছিল। বাড়িটাকে ঘিরে ঝরছিল তীব্র তুষার। আমাকে ঘিরে ছিল স্তব্ধতা। সে বছর আমি শুধু কান্নার স্বর শুনেছিলাম, নিজেরই কান্নাসমগ্র ।


চঞ্চল মন

আমার প্রতিবেশিনী, আমাকে তার অন্ধ বিড়ালের গল্প শােনায়।

বিড়ালটি প্রতিরাতে বাইরে কাটায়।
কোথায় সে যায়? আমি জিজ্ঞেস করি।

আমার স্বর্গত মা ডাকলাে তখন, টেবিলে প্রস্তুত রাতের খাবার। 

আমি উঠে চলে আসি। গাঢ় অন্ধকার মাথার ভেতর।

সেখানে এক অন্ধ বিড়াল, শিকার করছে ইঁদুর, নিঃশব্দে।


আমার স্বীকারােক্তির পালা

একটি কুকুর, কবিতা লিখছে। বিষয় : সে কেন ঘেউ ঘেউ করে। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, কুকুরটি আমিই। লাইব্রেরি থেকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে বের করে দিচ্ছে আমাকে। আমি বললাম, প্রভু সর্বশক্তিমান, যদিও অদৃশ্য বহুদিন। কিন্তু ওরা কোনাে প্রভুকে দোচে না। আমার লেজ ধরে টেনে-হিঁচড়ে বের করে দেয়।

পার্কের পাখিগুলাে সভা ডেকেছে : নিজেদের কিচিরমিচিরে কেন অতিষ্ঠ ওরা! বেঞ্চে বসা এক বৃদ্ধা, সম্মুখে আয়না ধরে নিজেরই সাদা চুল কেটে ফেলছিল অদৃশ্য কাঁচিতে। আমি কিছু বলিনি তখন।

সে রাতে, মেঝেতে শুয়ে, কাঁচুমাচু হয়ে, কবিতার পেন্সিল কামড়ে ধরে, দীর্ঘশ্বাস ফেলছি। এবং ঐ দূর আকাশে—নাগালের বাইরের কারাে প্রতি রাগ হচ্ছিল। কোনদিন যার কোনাে নাম দিইনি।


তাসের ঘর

তােমাকে মনে পড়ে, শীতের সন্ধ্যা। তােমার ওই মৃদু আলােটিকে। 

মায়ের রুদ্ধস্বর। খাবার টেবিলে বসে সেইরাতে আমরাও শ্বাসরুদ্ধ। মায়ের হাতে বানানাে এই তাসের ঘরটির পতনের অপেক্ষায় ছিলাম। 

রাস্তায় বুটের শব্দ হেঁটে যাচ্ছে। আমাদের সতর্ক ভঙ্গিতে কান খাড়া। 

তারপর, আর কিছু নয়। শুধু বন্ধ দরজা, শুধু জানালায় বিবর্ণ কাঁচ। বাইরের উঠোনে একা বৃক্ষ দাঁড়িয়ে। পাতাহীন-কদাকার-নগ্ন পায়ে।


ভাঙারি দোকানে

ছােট্ট বেতের ঝুড়ি মেডেল বােঝাই, পুরনাে যুদ্ধগুলাের, ক্রমশ মিয়মাণ।
একটা মেডেলে টোকা দিয়ে মনে হচ্ছিল— একদা বীরের বুকে ঝুলছিল সেও।

জেমস টেট এর সমকালীন কবিতা 

জেমস টেট। পুরাে নাম জেমস ভিনসেন্ট টেট। আমেরিকান কবি। জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালে কানসাস সিটিতে। 

স্থানীয় কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন এবং Iowa writers Workshop থেকে MFA ডিগ্রি। আমেরিকান সমকালীন গদ্যকবিতার অন্যতম পথিকৃৎ জেমস টেট। 

বিশটির বেশি কবিতাগ্রন্থ রচনা করেছেন। যার মধ্যে আছে The Ghost Soldiers (২০০৮); Worshipful Company of Fletchers (১৯৯৪), যা তাকে ন্যাশনাল বুক এওয়ার্ড জয়ী করে; Selected Poems (১৯৯১), যা তাকে কবিতায় পুলিৎজার পুরষ্কার এনে দেয়; Distance from Loved Ones (১৯৯০); Constant Defender (১৯৮৩); Viper Ja (১৯৭৬); এবং The Oblivion Ha-Ha (১৯৭০)। 

এছাড়াও আরাে কিছু পুরষ্কার জয়ের পাশাপাশি তাকে Academy of American Poets-এর চ্যান্সেলরশিপে ভূষিত করা হয়। ২০১৫ সালে এই কবি মৃত্যুবরণ করেন। 

তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ The Lost Pilot (১৯৬৭), গ্রন্থ শিরােনামের কবিতাটি উৎসর্গ করেছিলেন তার বাবাকে। বাবা পাইলট ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিমানে বােমার আঘাতে তিনি নিহত হন। 

টেটের বয়স তখন মাত্র পাঁচ মাস। জেমস টেট বর্তমান আমেরিকান গদ্যকবিতায় ভিন্ন এক মাত্রা যােগ করে গেছেন। 

তার কবিতায় চরিত্রায়ন, হিউমার সেন্স নিজস্ব ভঙ্গিমায় উপস্থাপনের পাশাপাশি তার কবিতা বিশ্লেষণ করলে আরাে অনেকগুলাে দিক উঠে আসে। যেমন- বিরহ, ব্যাঙ্গরস, এবসার্ডিটি, করুণ, আশাবাদ, একাকীত্ব এবং স্যুররিয়ালিজম। এবং তার কবিতায় বিশেষ ব্যাপারটি হচ্ছে, তিনি একটি কবিতায় একইসাথে এই ব্যাপারগুলাে ব্যবহার করতে পারতেন। 

প্যারিস রিভিউতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই বলেছিলেন, “পাঠককে লেখার গভীরে প্রবেশ করাতে পারার চেয়ে ভালাে আর কী হতে পারে। আমি আমার মজার কবিতাগুলােও ভালােবাসি, কিন্তু একইসাথে পাঠকের হৃদয়ে ব্যথাও জাগাতে চাই। আর একাজটা যদি একসাথে করা যায়, তবে সেটাই উৎকৃষ্টতম। কোনাে কবিতা পড়তে পড়তে আপনি হাসবেন, কিন্তু শেষে গিয়ে আপনার দুঃখ জাগবে, কান্না জাগবে। একইভাবে কোনাে কবিতার করুণ দৃশ্যগুলাে দেখতে দেখতে একটা দুর্দশার মুখােমুখি হতে হবে। সে অবস্থায় হঠাৎ ব্যাঙ্গাত্মক রসবােধ আপনাকে হাসাবে, আনন্দ দেবে, একইসাথে আফসােস জাগাবে, অর্থাৎ আপনার হৃদয়ে গিয়ে বাজবে। এই ব্যাপারটিই সেরা।” 

তার কবিতার চরিত্রগুলাে বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও নিজের খেয়াল চাপানাের ব্যাপারটি লক্ষ করা যায়। চরিত্রগুলাের বর্ণনায় গিয়ে তিনি ক্লিশে করে ফেলেননি। 

অথচ চরিত্রগুলােকে পাঠকের খুব পরিচিত কেউ বলেই মনে হয়ে উঠবে শেষমেশ। চরিত্র স্পষ্ট হতে থাকে তাদের কথায়, যাপনে বা ঘটনার প্রবাহে, চরিত্রের স্বাভাবিক প্রয়ােজনে। 

ফলে চরিত্রকে আলাদা করে সাজানাের প্রয়ােজন হয়নি। ‘এরকমই হয়' শিরােনামের কবিতা লক্ষ করলে ব্যাপারটি স্পষ্ট হবে আরাে। 

কবিতাটিতে আমরা একটা ছাগল দেখতে পাই, যার সাথে অন্য কোনাে ছাগলের বিশেষ তফাৎ নেই, সাদামাটা এক ছাগল। কিন্তু সে কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ, তার এই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা প্রকাশ পায় শহরজুড়ে তার অস্তিত্বের প্রভাবে। 

এই প্রভাব স্বাভাবিক, অতিরঞ্জিত নয়। জেমস টেট সেই স্বাভাবিক প্রভাবকেই কৌতুকদীপ্ত করে উপস্থাপন করেছেন। 

“নিখুঁত লক্ষ্যভেদ” নামক কবিতাতেও অদ্ভুত খেয়াল দেখতে পাই। যেখানে বাড়ির উপর এসে বােমা পড়ে, বাড়ির মালিক ভ্যাবাকান্ত হয়ে বলে, “এই সরকারকেই আমি ভােট দিয়েছিলাম। তাদের তাে আমার বাড়িটাকে উড়াবার কথা না।” 

পরিস্থিতি অনুযায়ী কথাটি উদ্ভট, কিন্তু অযৌক্তিক নয়। এখানেই টেটের হিউমার সেন্সের দক্ষতা, যে দক্ষতাই তাকে আলাদা অবস্থান তৈরি করে দেয়।

সমকালীন মার্কিন গদ্যকবিতা pdf


Book Publisher Author  F Size
সমকালীন মার্কিন গদ্যকবিতা হাইজেনবার্গ প্রকাশ রনক জামান ১ মেগাবাইট
Bookshop Price Language  T Page
Durdin Magazine Only 0.00 Taka Bangla 52

Read More: তাই তে চিং PDF

উঠোনের তারে

মিলি, উঠোনের তারে সে ভেজা জামা রৌদ্রে শুকায়। আমি জানালায় বসে তাই দেখতে থাকি। দৃশ্যটা এত ভালাে লাগে! সহস্র উপায়ে আমি ভালােবাসি ওকে, ওর ধবধবে জামা, তাতে ওই বাতাসের দোল। 

যেন অনন্তকালীন, যেন নতুন সূচনা, যেন আগামীকালের এক প্রতিশ্রুতি। আহ, ওই ক্লিপগুলাে! আমি ওই ক্লিপগুলাে বড় ভালােবাসি। আরাে ক্লিপ জমা করে রাখাও জরুরি; কেননা কে জানে কবে—বন্ধ হয় যদি ক্লিপ তৈরি? 

আমি চিত্রকর হলে চিন্তা ছিল না, মিলির ঐ ভেজা জামা মেলবার দৃশ্যটি এঁকে রাখতাম। আমার সে চিত্রটি ভালাে লাগতাে, অথবা সংগােপনে বেদনা জাগাতাে। 

কেননা জানি না আমি, তখন ওর মনে কোন ভাবনার ভিড়! ছােট বা বড়, নাকি ভাবনাবিহীন? ওর মাথার উপরে ঐ চিল উড়ছে, সে কি দেখতে পাচ্ছে তা? ধােয়া কাপড়চোপড় তারে শুকোতে দেয়া-ওর অপছন্দ? ও কি পালাতে চাইছে কোনাে নাবিকের সাথে? 

প্রাচীন জাহাজে, ভেজা জামাগুলাে সব সমুদ্র-ঢেউয়ের মতাে তরঙ্গায়িত। বিদায়ী পতাকার মতাে ঐ মােজাগুলাে পতপত ওড়ে। মিলি, ও মিলি, আমাকে কি ভুলে যাচ্ছাে? 

আমি সেই নাবিক তােমার, প্রচণ্ড ঝড়ের কবলেও যে তােমাকে ভালােবাসবে।


ফেরার ক্যাম্পে

একটা নড়বড়ে গাছের ডালে বসে দোলনা ছাড়াই দুলছিলাম। দুলতে দুলতে পায়ের জুতা খসলাে, ওভাবেই চলে আসলাম। 

তখন ছােটবােন বাড়ির ভেতর থেকে দৌড়ে আসে, বলে, “কাল আমি ক্যাম্পে যাবাে।” বলি, “মিথ্যা কথা।” বলে, “সত্যি, মা বলছে!” তারপর সারাদিন কথা হলাে না। 

ওকে আদর দিতাম, তাই ভাবছিলাম—কী করা উচিত। রাতে খাবার টেবিলে মা’কে জিজ্ঞেস করি, “মা, কী ক্যাম্প এটা?” মা বলে, “বাকিসব ক্যাম্পের মতােই।” কী বােঝালাে, বুঝলাম না! পরদিন প্রতিবেশীদের কাছে আমাকে জমা রেখে—সাজিয়ে গুছিয়ে তারা বােনটিকে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। 

বাবা-মা ফিরলাে যখন, সব স্বাভাবিক, শুধু মেইজিকে আমার মনে পড়ছিল খুব। দিন যতাে যায় ততাে মনে পড়ে আরাে। আগে কি জানতাম, সে আমার কতাে আদরের? 

বাবা মা'র কাছে তাই বারবার প্রশ্ন করি, “আর কতাে দেরি?” একটাই জবাব তাদের, “অতি জলদি।” স্কুলে, সহপাঠীদের বলি, আমার বােনটি আজ কতদিন নেই! 

একজন ফট করে বলল, “ঐটা মরার ক্যাম্প, আর ফিরবে না।” ছেলেটার কথা এসে বাবাকে বলি। বাবা ধমকে বলেন, “সব ফালতু কথা, সে জানে না কিছু।” 

অথচ এইভাবে এক সপ্তাহ যায় দুই সপ্তাহ যায়, আমার তাে ধীরে ধীরে অবাক লাগে। তারপর তারা একদিন, মেইজি’র ঘরদোর সাফ করলাে। জিজ্ঞেস করি, “তােমরা কী করাে? মেইজি তাে ফিরে আসবে। 

তুমি বলছিলে না?” মা বলল, “মেইজি ফিরবে না। সে ওখানেই বেশি খুশি আছে।” “মিথ্যা কথা, ভুগােল বােঝাও কেন?” 

তখন আমার দিকে এমন চোখে বাবা তাকাচ্ছিলেন, যেন কথা না শুনলেই আমার পালা এরপর। আমি আর কোনদিন, মেইজির কথা তুলি নাই।


জুতাের শােক এবং পা-বিহীন সুখী ব্যক্তি

ভেবেছিলাম একাকীত্ব সম্পর্কে বেশ ভালাে জানি আমি, কিন্তু , তুমি চলে গেলে মাংস-বিতানে, শুয়ােরের কান কিনে এনে জুড়ে দিলে তােমার ওই বিছানার পাশে। 

বললে, “এ আমার প্রিয় বন্ধু, যার সাথে বাতচিত করে সুখ পাই।” আর তখন থেকেই ভাবছি : কারাে খাঁ খাঁ শূন্য হৃদয়, (তুমিই প্রথম চাষী) দারুণ ফুল ফোটাবার জন্য শ্রেষ্ঠ জমিন।


দরজায় টোকা

ওরা জিজ্ঞেস করলাে, পৃথিবীর ধ্বংস নিয়ে আমার মাথাব্যথা কেমন। আমি বললাম, “ভেতরে আসেন, বসেন। খােদার ওয়াস্তে আজ দুপুরের খানাপিনা আমার ঘরেই সেরে নেন।” -ওরা খায় আর কথা তােলে পরকাল নিয়ে। “আরে,” বললাম আমি, “শাকের মধ্যে মাছি এসে বসছে, দেখে খান।” 

তখন মুক্তির কথা তুলল, তাঁর পাশে বেছে বেছে আনা সব ভক্ত মুরিদ। “কেনে?” মুরিদগুলােকে ইশারায় দেখিয়ে বলি, “বসে বসে মুক্তি?”
কথা মাটিতে পড়ার আগেই আহত জোম্বির মতাে ঘিরে ধরলাে আমাকে। বললাম, “আহা! আসেন, আমরা লেবুর শিফন পাই খাই। 

গতকাল কিনেছিলাম থ্রি ডগ বেকারি থেকে”। কিন্তু তারা কথা বলবে অন্য বিষয়ে, আমার আত্মা নিয়ে। ঝিমুনি পাচ্ছিল। বললাম, “আপনারা ঘুমিয়ে নেবেন হালকা? আমার তাে ঘুম পাচ্ছে...”

এই কথা শুনে উঠে দাঁড়ায় তারা, বেরিয়ে গেল সােজা দরজা দিয়ে। তারপর হেঁটে হেঁটে চলে গেল প্রতিবেশি দরজার দিকে। 

তখন একটা কালাে মেঘ ওদের মাথার 'পর ভেসে যাচ্ছিল, অথচ ওরা এর কিছুই দেখতে পেলাে না। ওদের চোখে-মুখে-দৃষ্টিতে আসন্ন কেয়ামত-এর দুশ্চিন্তা।


যিশুর সুন্দর সময়

একদিন সকালবেলা—যিশুর ঘুম ভাঙে অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু দেরিতে। স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। এত গভীর যে তার মাথায় আর কিছুই অবশিষ্ট নেই কী দেখছিলেন যেন? দুঃস্বপ্ন, সব মৃত লােকজন কিলবিল করছিল চারপাশে তার। 

উলটানাে চোখ, খসে পড়া চামড়া...অথচ তিনি একদমই ভয় পাননি। দিনটা সুন্দর ছিল। এক কাপ কফি হলে কেমন হয়? কিছু মনে করবেন না। ঘুরে আসুন না আমার গাধার পিঠে চেপে; আমি, গাধাটাকে খুব ভালােবাসি।

...ধ্যাত্তেরি, আমি তাে সব্বাইকেই ভালােবাসি!”


নিখুঁত লক্ষ্যভেদ

হঠাৎ বােমা ফাটার শব্দ শুনলাম বাইরে কোথাও। কোনমতে পােশাকটা চাপিয়েই রাস্তায় এলাম। দেখলাম, হােয়ালেনদের বাড়িটা ভেঙে চুরমার চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। হল আর রেবেকা রাস্তায় দাঁড়ানাে, অক্ষত। প্রতিবেশীরা ঘরদোর উজার করে ঝাঁকে ঝাঁকে পথে ছুটে এলাে। 

“হলােটা কী?” হলকে প্রশ্ন করি। “ভাগ্যিস, প্লেনটা উড়ে যাবার সময় বাগানে ছিলাম আমরা, খােদা, লাখ লাখ শােকর তােমার! তারপর যা হলাে তা দেখতেই পাচ্ছাে। বাড়িটাই উড়িয়ে দিয়েছে,” সে বলল। 

“নির্ঘাত ভুল বােঝাবুঝি, সম্ভবত দুর্ঘটনা,” বললাম আমি। “তা ঠিক আছে, এই সরকারকেই আমি ভােট দিয়েছিলাম। তাদের তাে আমার বাড়িটাকে উড়াবার কথা না,” সে বলল। 

“ভাতৃত্বসুলভ হামলা বােধহয়,” বললাম। “সেটা আবার কী জিনিস?” সে বলল। “অন্য কাউকে উড়াতে গিয়ে ভুল করে তােমাকে মেরেছে,” বললাম। 

“তাই বলে বসতিপূর্ণ জায়গায়? আমাকে যা খুশি ভাবুক নাহয়, কিন্তু, এখানে তাে আরাে লােক থাকে! বাচ্চা, বুড়াে, কুত্তাগুলােও,” সে বলল। “দেখাে, কর্তৃপক্ষ তােমাকে ক্ষমা চেয়ে পত্র পাঠাবে। হয়ত আরেকটা বাড়িও পাবে,” বললাম। 

“ভাগ্যিস, আঁতকে গিয়ে হার্ট এটাক হয়নি আমার,” রেবেকা হােয়ালেন বলল। 

জো মিজেল এগিয়ে আসে। “একদম নিখুঁত লক্ষ্যভেদ, ওরা জেনে বুঝেই করেছে একাজ। দ্যাখাে, আশেপাশে আর কারাে কিছু হয়নি,” সে বলল। 

“তুমি কীভাবে জানাে ওরা তােমার ঘর ওড়াতে গিয়ে ভুল করে আমার ঘরে বােমা ফেলেনি?” হল বলল। 

“ও জিসাস, ওভাবে তাে ভেবে দেখিনি। কিন্তু আমি কোনাে দোষ করিনি। এই সরকারকেই ভােট দিয়েছিলাম আমি। যদিও মনে করি, সে একটা বেজন্মা শুয়াের,” জো বলল।

“আমাদের সবকিছু শেষ,” রেবেকা কাঁদতে কাঁদতে বলে, হাতে তার অশ্রুসিক্ত টিস্যু। হল তাকে স্বান্তনা জানায়, “সব ঠাণ্ডা হলে, স্তুপের ভেতর থেকে জিনিসপত্র কিছু বের করে আনতে পারি।” 

“আমি একাজে সাহায্য করতে পারি,” বললাম। “তােমার রুপার দস্তানাটা বেঁচে গেছে সম্ভবত, ওটা গলবার কথা না,” জো বলল। বাকি প্রতিবেশীরা চারপাশে জড়াে হয়ে নিজেদের মাঝে ফিসফিস করে কথা বলতে থাকে। 

“আমাদের নিরাপত্তার দাম এভাবে চুকাতে হচ্ছে?” “খােদার অশেষ কৃপা, গণতান্ত্রিক দেশে বসবাস করি আমরা।” 

“নিশ্চিত, ওরা জেনে বুঝেই কাজটি করেছে।” “আমার কনগ্রেসের লােকদের চিঠি লিখব আমি।” 

হল আমার দিকে ঘুরে বলল, “আমারই দোষ হয়ত। হয়ত এমনকিছু করেছিলাম, এটা তার উচিত পরিণাম। সব তাে মনে পড়ে না, তবু প্রতিদিন একটু একটু করেও যদি জমে, ভেবে দ্যাখাে, কত অন্যায় করে ফেলেছি! 

আমারই কর্মফল নিশ্চয়ই, কেউ হয়ত নালিশ করেছিল আমার নামে। ও খােদা, এসব নিয়ে আমি আর ভাবতে পারছি না, কী জঘন্য ব্যাপার!” 

“শােনাে হল, আমার এখনাে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা দুর্ঘটনা। এরকম প্রায়ই হয়ে থাকে। নালিশপত্রগুলাে কত হাত ঘুরেফিরে প্রসাশনে যায়, হতে পারে তখন ঠিকানাটা ভুল হয়ে গেছে,” বললাম। 

“আমার বাচ্চাদের ছবি, কত স্মৃতি, আর কি ফিরে পাওয়া সম্ভব!” রেবেকা ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। “তােমার এক আত্মীয় আছে না, সরকারি চাকরি করে?” জো বলল। 

“ওয়াশিংটনে এক সামান্য কেরানী সে,” হল বলল। “যাই হােক, সন্দেহের বাইরে রাখা ঠিক না তাকে,” জো বলল। “তুমি কিন্তু খোঁচা মেরে কথা বলছাে, জো,” হল বলল। 

প্রতিবেশীরা সব ঘরে ফিরে গেল, কৌতুহল মিটে গেছে কানায় কানায়। জো-ও চলে যাচ্ছিল, যাবার আগে বলল, “সামান্য কৌতুক ঢােকাতে চাইছিলাম প্রসঙ্গটিতে। কিছু মনে করে থাকো যদি, দুঃখিত।”

এর উপযুক্ত কোনাে প্রত্যুত্তর হল দিতে পারল না। তারপর, আমরা তিনজন ধূলিসাৎ ধ্বংসস্তুপের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম ভ্যাবলার মতাে। 

“উম বেশ, তােমরা চাইলে আমার বাড়িটাতে উঠতে পারাে,” আমি বললাম শেষমেশ। হল তাকায় আমার দিকে, কথার সততা যাচাই করে নিলাে। তারপর বলল, “এটা আমাদের আসল বাড়ি না। 

আমাদের একটা গােপন বাড়ি আছে, যেখানে সব মূল্যবান জিনিস রেখেছি। বাড়িটা কোথায় তা কেউ জানে না, এমনকি আমাদের বাচ্চাগুলােও না। 

এখানে তাে পুরনাে ভাঙ্গারিতে ভরে রেখেছিলাম। জানতাম, আজ বা কাল হােক, এমনটা করবেই ওরা। আর দ্যাখাে, গাড়িটার ক্ষতি হয়নি, তাে আমাদের সমস্যা হবে না কোনাে। 

রেবেকা এতক্ষণ প্রতিবেশীদের দেখে ভণিতা করছিল। জানাে তাে, অধিকাংশ প্রতিবেশী বিশ্বাস অযােগ্য?”

আমরা করমর্দন করলাম, কোলাকুলি করলাম। তারপর, ওরা গাড়িতে চড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেল এখান থেকে। শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আমি, ওদের গাড়ির লাইসেন্স প্লেট নাম্বার—৩৫৭০১৯—মুখস্ত করে রাখলাম।


একটা উল্লুককে যেভাবে কবিতা লিখতে শেখাবেন

উল্লুকটাকে কবিতা লিখতে শেখানাে তেমন কঠিন ছিল না কিছু। একটা চেয়ারে তাকে বেঁধে ফেলা হলাে প্রথমত, তারপর পেন্সিল বেঁধে দিলাে হাতের সাথে (সম্মুখে আগেই প্রস্তুত রীম রীম খাতা!) 

অতঃপর ডক্টর রুসপায়ার তার কাঁধের কাছে ঝুঁকে কানে কানে বললেন, “স্যার! দেখে মনে হয়, আপনি নয়, বসে আছে স্বয়ং ঈশ্বর! কোনাে ঐশী গ্রন্থ কেন ল্যাখেন না, স্যার?”


একই স্তনযুগল

আরাে অনেক দিনের মতাে একটি দিন। হেঁটে যাচ্ছিলাম আমি রাস্তা দিয়ে। থিয়েটারের বাইরে ঝােলানাে বিলবাের্ড; তার পােস্টারে ঝুলছিল সুদর্শন স্তনযুগল। 

চোখ আটকে গেল তাতে। তখন দুপুরবেলা, জাহান্নামের মতাে তীব্র গরম বাইরে। বললাম, “হােয়াট দ্যা হেল!” 

তারপর ২.৫০ ডলার খরচ করে ভেতরে ঢুকলাম আমি। মাঝখানের সারিতে একা একাই গিয়ে বসে পড়লাম। একা একাই পর্দা উঠল। মঞ্চের মাঝখানে একই পােস্টার। 

আমি বসে বসে ঘামতে থাকি। শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম, এই জাহান্নাম থেকে আমি বেরিয়ে যাবাে। বাইরে তখনাে দুপুর, জাহান্নামের মতাে তীব্র গরম।


নিযুক্ত শ্রমিকদল

কাজটির জন্য পর্যাপ্ত বলদ কি আছে তােমাদের? আজ্ঞে না, ঘাটতি আছে। 

বেশ, কাজটি ঠিকঠাকমতাে করতে আর কতগুলাে বলদ দরকার? আরাে দশটির মতাে, স্যার। 

দেখি তােমাদের জন্য কী ব্যবস্থা করতে পারি!
আজ্ঞে, স্যারের দয়া।

অবশ্যই আমার দয়া! আর হ্যাঁ, লােকদের খাবারের জন্য কি মাছের কাবাব আছে পর্যাপ্ত?
আজ্ঞে না, ঘাটতি আছে। 

পঞ্চাশজনের জন্য মজুদ রয়েছে, আরাে লাগবে। ঠিক আছে, আমি পরদিন পাঠিয়ে দেব। 

তােমাদের কি মানচিত্র দরকার? পর্বতগুলাের আর মাটির তলার? পর্বতগুলাের মানচিত্র আছে আমাদের, কিন্তু স্যার, মাটির তলার মানচিত্রের ঘাটতি আছে। 

অবশ্যই ঘাটতি আছে। কারণ মাটির তলার কোনাে মানচিত্রই নেই। তাছাড়া, তােমরা ওখানে যেতে রাজি হবে না। খুব গুমােট জায়গা। 

সেখানে যাবার কোনাে ইচ্ছাই আমাদের নেই। মূলত এ কাজের জন্য অন্য কোথাও যাবার ইচ্ছা আমাদের নেই। আপনার প্রশ্নের সাপেক্ষে আমি জবাব দিয়েছি, স্যার। 

আপনিই বলেছেন, মানচিত্র লাগবে কিনা! হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমারই তাে ভুল। আমি সব মানচিত্র লুটে নিয়েছি। 

বলাে, আর কী কী দরকার তােমাদের? শস্যবীজ দরকার, লাঙল দরকার, কাস্তে দরকার, মুরগি, শুয়াের, গাভী, ঝুড়ি আর কিছু মেয়েমানুষ দরকার।

মেয়েমানুষ?

আজ্ঞে স্যার, মেয়েমানুষ। আমাদের কাছে কোনাে মেয়েমানুষ নেই। 

অতি দুঃখের কথা। আজ্ঞে, আমরা দুঃখী। 

কিন্তু তােমাদেরকে কোনাে মেয়েমানুষ দিতে পারব না আমি। আমরাও তাই ধরে নিয়েছি, স্যার। 

তাহলে? মেয়েমানুষ ছাড়া তােমরা করবেটা কী? ভুগব, স্যার। তারপর এই অভাব নিয়েই একে একে মারা যাবাে আমরা। 

তােমাদের মাঝে কেউ গান গাইতে পারে? জি স্যার, আমাদের মাঝে অনেকেই চমৎকার গান গাইতে পারে। 

তাদেরকে নির্দেশ দাও যেন গান গাওয়া শুরু করে দেয়। তাহলে তােমাদেরই হয়ত খুঁজে নেবে কোনাে যুবতীরা, নয়তাে তােমরা গান গাইতে গাইতে শান্তিতেই মরতে পারবে। 

আর এরমাঝে তােমরা নিজেদের কাজগুলাে সেরে নিও ঠিকঠাক।

আজ্ঞে স্যার, যুবতী না পাওয়া পর্যন্ত আমরা আপ্রাণ কাজ করে যাবাে।


রনক জামান pdf

 একটু উপরে 

এই মােটেল, অবিকল প্রণয়-বান্ধব। আদর আর পূর্ণপ্রেমে-একটু একটু করে ভাঁজ খুলছি তােমার। 

নব-আবিষ্কৃত ভূখণ্ড চুমে চলেছি। আর তুমি—ওইতাে শুয়ে আছে আমারই বাহুর সীমানায়। 

সরু ও শুভ্র শরীর, বন্দি পাখির মতাে কেঁপে কেঁপে উঠছাে। 

আমাদের মাঝখানে গাঢ় নীরবতা। কোনাে মাপমতাে শব্দ—আপাতত দরকার নেই। 

নমনীয় ঋতু। বিছানার চারপাশে উপগ্রহের মতাে ঘুরছি শুধুই, আর তুমি মৌন সম্মতিতে চোখ তুলে তাকিয়ে আছো। 

অথচ বলছি না, তুমি তন্বী-তরুণী। 

তােমার স্তনদ্বয় খুব মুঠো উপচানাে; আমার ভালাে লাগে ছােট আকৃতি, এই হাতের মাপে।

তােমার উরুদ্বয়- মাংসল; অতিদূর থেকে হেঁটে আসা সুগন্ধি তাতে। আমার দাঁতের নিচে একটু একটু করে... একটু একটু করে... জীবনের আহার্য যেন, অপরিহার্য এক ক্ষুধার দাবি। 

এখন, তােমার ঐ ঠোঁট নড়ছে। এখন, তােমার দুইহাত ছুটে আসছে এই আমারই দিকে। আর আমি তােমার শরীর থেকে একহাজার-দুহাজার ফিট উর্ধ্বে, যেন ভাসমান মেঘ। 

তােমার ঐ ঠোঁট থেকে একটা বুদ্বুদ উঠে আসছে। ভেতরে একটিই শব্দ : “এসাে”। 

বিশ্বাস করাে, আমি তাে আসতেই চেয়েছি চিরকাল। অথচ এখন, এত উপর থেকে কিছুই সম্ভব লাগছে না আর

কিছুই দৃশ্যমান লাগছে না আর! শুধু ভেসে আসছে এক উষ্ণতা, আহ্বান; শরীরী ভাষায়।


দেরি, তবে খুব দেরি হয়নি তখনাে

পার্টি থেকে ফেরত যাওয়াদের দলে আমিই শেষ বান্দা ছিলাম। স্টেফানি আর জেরাডকে বললাম, শুভরাত্রি। 

ওরা শুয়ে পড়েছিল, আসলে বিছানায় প্রেম করছিল। তাে প্রণয় থামিয়ে ওরা জবাব দিলাে আর পার্টিতে এসেছি বলে ধন্যবাদ জানালাে হাসিমুখে। 

রাস্তায় হেঁটে হেঁটে ফিরছি তখন, সমস্ত পথ যেন জোছনার রৌদ্রে আলােকোজ্জ্বল। আমি ভাবছি কষে, কে ছিল ওরা, আমাকে কেনইবা দাওয়াত দিলাে? 

নিজেকে গােয়েন্দা লাগে, অকাজের তথ্যে মাথা ভর্তি। অপরিচিতের কাছে প্রাণখুলে সব বলে দিলাে? 

ব্যাপারটা আরাে অদ্ভুত! আমি কেলগ স্ট্রিট থেকে ডানদিকে উইন্ডসােরের পথে মােড় ঘুরলাম। দেখি, ল্যাম্পপােস্টের নিচে এক মহিলা দাঁড়ানাে। তাকে ভীত লাগছিল। 

“সাহায্য লাগবে কোনাে?” বললাম। তাকে বিব্রত মনে হচ্ছিল, শেষে বলল, “আমি হারিয়ে গিয়েছি।” “তাে কোথায় যাবেন?” বললাম। “রিচার্ড স্ট্রিটে,” মহিলা জানালাে, “আমার খালাম্মা থাকে সেখানে।” 

“বেশি দূরে না তাে,” বললাম তাকে, “চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি আমি।” এরপর, একসাথে হাঁটতে থাকি আমরা। তাকে শঙ্কিত লাগছিল খুব। 

তার বাস নাকি বেশ দেরিতে আসে, স্টেশনেও কেউ নিতে আসেনি, আর ফোন করলেও নাকি ধরছে না কেউ। তার খালার বাসার কাছে পৌঁছে গেলাম, বাড়িটাতে বাতি নিভে ছিল। 

দরজায় বারবার, বারবার ধাক্কা দিলেও কেউ খুলছিল না। কেমন খালা? “শুনুন,” বললাম, “আমি তাে কাছেই থাকি, চলুন সেখানে যাই, পুলিশকে ফোন করে জানানাে যাবে। তারাই ব্যাপারটা দেখবে তখন।” 

রাজি না হয়ে তার উপায় ছিল না যেহেতু, আবার আমরা হাঁটতে থাকি নীরবে; স্নিগ্ধ সে হাঁটা, ভীষণ সুরেলা। মহিলা, কৃতজ্ঞতার ভাষা হাত ছুঁয়ে জানালাে আমাকে। 

তখন গভীর রাত, কিন্তু তখন—যেন মাত্রই শুরু হলাে জীবন আমার।


প্রশস্ত পথজুড়ে

ঘুম ঘুম গাড়িগুলাে শিশিরস্নাত পথ ধরে আঁচরে চলেছে। যতটা অন্ধকার, তারও বেশি গাঢ়, চালকের মনে ও মগজে। 

আর আশা আর হতাশার মাঝখানে আটকে আছে এ শহর।

ঋতুদের আনাগােনা তেমন যায় না বােঝা,শুধু ওই রাস্তা সাফাইয়ের লােকদের মনে ও মগজে কিছুটা : 

‘ হান্স, জলদি এসাে। একটা পাতা ঝরছে, আমার ভেতর!’


উপরের দিকে থুতু ফেলা নিষেধ

“বরফ ভাঙবার শাবল নিয়ে এই কাঁচের লিফটে ওঠা ঠিক না মােটেই।”

আমি বললাম শিলার কানে। লিফটেই, এরূপ এক মহিলা আমাদের পাশে দাঁড়ানাে। বাইরের দৃশ্যে মন না দিয়ে আমি বন্ধ দরজা-পানে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকি; বাইরে দেখার কিছু নেই! 

বরং ভাবছিলাম ঐ মহিলা যদি আচমকা ক্ষেপে যায় শাবল-সমেত? যদি প্রকাণ্ড মুরগির মতাে উনি ডানা ঝাপটায়? শিলা কী ভাবছে তখন—ভাবতেই অবাক লাগে, ওর নজরও কি ওই শাবলের দিকে? 

শাবলটি মনে মনে নৃত্যরত; স্থির দাঁড়িয়েই, ভেতরে ভেতরে আমি পালাতে থাকি। 

কাঁচঘেরা লিফটে লক্ষ্যই করল না কেউ: আমার আর শাবলের মাঝে, শাবল আর কাঁচের মাঝে, কাঁচ আর আমার মাঝে—দাঁড়িয়ে রয়েছে কত দুশ্চিন্তা।


এরকমই হয়

বিড়ি ফুকতেছিলাম, সেন্ট সিসিলিয়া গির্জার বাইরে খাঁড়িয়ে। আচম্বিত এক বকরি এসে পাশে খাঁড়ালাে। বকরিটা সাদাকালাে, বাদামি ছােপ ছােপ গা’য়। 

আমি হাঁটা দিলে সেও পেছনে আসে।। বিষয়টা ভালাে ঠেকল, যদিও ভাবছিতেলাম আমি, বকরির মূলনীতি কী? 

কুত্তা নাহয় হলে বুঝতাম প্রভুভক্তি; কিন্তু এ বকরি বেলায়? পথের লােকজন মুচকি হাসে আর বকরির তারিফ করে। 

আমি বলি, “আমার না তাে! শহরের বকরি এটা, খেয়াল রাখার পালা চলতেছে আমার।” 

“আমাগাে বকরি আছে? জানতামই না,” বলে একজন, “তাইলে আমার পালা কবে আইবাে?” 

“অতি জলদি! ধৈর্য রাখাে মিয়া, একদিন তােমাগাের সবার পালাই আইবাে।” 

বকরিটা পাশে পাশে থাকে, ভাইয়ের মতাে। যদি থামি সেও থেমে যায়। আমার মুখের পানে মুখ তুলে চায়, আমি তার চোখে চোখ রাখি। 

যেন আমার ব্যাপারে সে যা জানার জেনে ফেলছে। আমরা হাঁটতে থাকি। এক পুলিশ দেখে বলে, “আপনার বকরিটা বেশ।” 

“শহরেরই বকরি,” বললাম তাকে। “গত তিনশ বছর ধরে খানদানসমেত পাশে হাঁটতেছে। একদম সূচনা থেকে।” 

অফিসার বকরিটা ছুঁতে চাইলাে, “ছুঁইলে কি মাইন্ড করবেন?” “ছোঁয়ামাত্রই আপনার জীবন বদলে যাবে,” 

বললাম তাকে, “ভেবে নেন আগে।” অফিসার মিনিটখানেক ধরে জোরসে ভাবে, তারপর বলে, “নাম কী উনার?” “শান্তির দূত।” 

“ইয়াল্লা, কী অদ্ভুত শহর! আমি তাে বাচ্চাশিশু, শ’হাজার রহস্য ফাঁদে শুধু চোর আর পুলিশ খেলি। যদি কেঁদে বসি, মাফ করবেন।”

“আমরা আপনাকে মাফ করলাম, অফিসার। হলপ করেই বুঝলাম, এই মহিমান্বিত দূতটিকে ছোঁয়া আপনার কেন অনুচিত!” বলে, আমি ও আমার বকরি হাঁটা দিই সেখান থেকে। 

চারদিকে সন্ধ্যা নামতেছিল। আমরা দুইজন ভাবতে থাকি, এই রাতটা যে কই কাটাবাে?


রবার্ট হাস এর সমকালীন কবিতা 

রবার্ট হাস (১ মার্চ, ১৯৪১-বর্তমান) সবচেয়ে জনপ্রিয়, উদযাপিত, বহুলপঠিত সমকালীন গদ্যকবিদের একজন। 

কাজ করেছেন “পােয়েট লরেট অব দ্যা ইউনাইটেড স্টেটস”-এ ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। ২০০৭-এ ন্যাশনাল বুক এওয়ার্ড লাভ করেন, ২০০৮-এ লাভ করেন পুলিৎজার পুরষ্কার “টাইম এন্ড ম্যাটেরিয়ালস-পােয়েস ১৯৯৭-২০০৫”-এর জন্য। 

২০১৪ সালে একাডেমি অব আমেরিকান পােয়েটস থেকে লাভ করেন ওয়ালেস স্টিভেনস এওয়ার্ড।

কবি হিসেবে ব্যাপক সফলতার পাশাপাশি একজন সফল সমালােচক ও অনুবাদক। 

পােলিশ কবি সেজলাে মিলােজ, জাপানিজ হাইকু মাস্টার বাশাে, বুশন, ইসসা-প্রমুখদের অনুবাদের মাধ্যমেও প্রশংসিত হন। 

সমালােচকদের দৃষ্টি কাড়েন তার মৌলিক কবিতার অনবদ্য বৈশিষ্ট্য স্বচ্ছতা, পরিষ্কার ইমেজারির মাধ্যমে, যেগুলাে নৈমত্তিক জীবন থেকেই গৃহীত।

“রবার্ট হাস জাপানিজ হাইকু অনুবাদে বিশেষ পারদর্শীতা এবং নিজস্ব অনুরাগের ছাপ রেখেছে স্পষ্টভাবে। এছাড়া তাঁর মৌলিক কবিতাগুলাে গুরুত্বপুর্ণ। একাধারে মিউজিক্যাল, বর্ণনাত্মক ও গভীর চিন্তাশীল সব কবিতাই।”

–কবি ফরেস্ট গান্ডার

নিউ ইয়র্ক টাইমস রিভিউ-তে ক্যারােলিন কাইজার লিখেছেন, “সে (রবার্ট হাস) এতটাই মেধাবী ও বুদ্ধিমান যে তাঁর কবিতা অথবা গদ্য পাঠ করা বা তাঁর কথা শােনা এক প্রকার অপার্থিব ও সূক্ষ্ম প্রশান্তি দেয়।” 

হাস শিকাগাে রিভিউ-তে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজেই বলেন, “কবিতা হচ্ছে বেঁচে থাকার এক বিশেষ পদ্ধতি। ঠিক যেমন মানুষ খুব যত্নের সাথে, প্রেমের সাথে রুটি বানায় বা বাস্কেটবল খেলে, তেমনই দৈনন্দিন ও জীবনঘনিষ্ট।”

রবার্ট হাস-এর প্রথম কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে, “ফিল্ড গাইড”, যা ইয়েল সিরিজ, তরুণতম কবি পুরষ্কার এনে দেয় তাঁকে। 

এরপর ১৯৭৯ সালে “প্রেইজ” কবিতাগ্রন্থের মধ্যে দিয়ে একজন গুরুত্বপুর্ণ আমেরিকান কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন যেখানে নিজের সামর্থ্যের বিপুল সম্ভাবনার সফল প্রয়ােগ করেছিলেন। 

এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ১৯৮৪ সালে প্রকাশ করেন “টুয়েন্টিন্থ সেঞ্চুরি প্লেজারস-কবিতায় গদ্যশৈলী”। 

যেখানে সন্নিবেশিত হয় তাঁর পূর্ব প্রকাশিত প্রবন্ধ ও রিভিউসমূহ। এরপর কবিতার পাশাপাশি প্রবন্ধ রচনাতেও মনােনিবেশ করেন। 

১৯৮৯ সালে প্রকাশ পায় কবিতাগ্রন্থ “হিউম্যান উইশেস”, যেখানে গদ্য কবিতার ব্যাপক এক্সপেরিমেন্ট ছিল এবং তিনি ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেন।

এরপর ১৯৮৪-তে “এসেনশিয়াল হাইকু : বাশাে, বুশন, ইসসা” এর হাইকুর চমৎকার অনুবাদের মাধ্যমে সাহিত্যগােষ্ঠীকে চমকে দেয়া অব্যাহত রাখেন। 

১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় কবিতাগ্রন্থ “সান আন্ডার উড”। যে বইটিকে তিনি তাঁর আত্মজীবনীমূলক বলেই আখ্যায়িত করেন, সেখানে উঠে আসে তাঁর এলকোহলিক মা এর গল্প, নিজের শৈশব।

বর্তমানে রবার্ট হাস ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়াতে শিক্ষকতা করেন, বসবাস করছেন ক্যালিফোর্নিয়াতেই, তার স্ত্রী কবি ব্রেন্ডা হিলম্যানের সাথে।


প্রশংসা

কাপ্তান-কে প্রশ্ন করেছিলাম, যদি বিশালাকৃতির, হিংস্রতম ও অপ্রত্যাশিত কোনাে পশুর সামনে পড়েন, কী করবেন, প্রথমত? 

সামান্য ইতস্তত হয়ে ফের বিচক্ষণ ভঙ্গিতে তিনি জবাব দিলেন— “ওর প্রশংসা করবাে, সম্ভবত।”


এক পাঠিকার প্রতি

লক্ষ করেছি, স্মৃতি তােমাকে আরাে আহত করে— আর কিছু নয়, কেবল ঈর্ষা জাগছে তােমার প্রতি। 

বিস্তৃত ভেজা এই ঘাসের উপর শুয়ে আমি কোনাে প্রার্থনা করিনি তাে অদৃশ্য কিছুতে, শুধু ভেবে গেছি— সৈকত ধরে হেঁটে যাচ্ছে জানুয়ারি বিধৌত আকাশ আর শঙ্খচিল উড়ছে। 

আর দেখেছি, সমুদ্রাভিমুখে : যা কিছু ছিল না তাই : ভােরের প্রথম আলােয় এক বিশালাকৃতি পাখি, ক্রমশ ধনুকের মতাে বেঁকে, ডানা মেলে উড়ে চলে যায় আমাদের স্পর্শ বা কল্পনার সীমানা পেরিয়ে, সত্যিকার কোনাে সৈকত পানে...


সেপ্টেম্বরের ডায়রি : আখ্যান

আবছায়া পথ, ঘণ্টায় ৮০ মাইল বেগে ছুটছে গাড়ি আর কথার পর কথা বলে যাচ্ছে ওরা। (বাতাস ধোঁয়াচ্ছন্ন। দাবানল জ্বলছে বনের কিনারে...) লােকটির গল্পটি ব্যথিত। মহিলার—অস্থির, বিপদাপন্ন।

অনুকল্প

একজন লােক ও একজন মহিলা। তারা পুরনাে বন্ধু। থিয়েটারে সিনেমা দেখছে। সিনেমাতে একজন লােক ও একজন মহিলা। পুরনাে বন্ধু তারা, গ্রীষ্মের পাহাড়ি পথ ধরে গাড়ি করে যাচ্ছে। 

মহিলা—নিজের বিবাহবিচ্ছেদের গল্প শােনাচ্ছে, আর কাঁদছে। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে একেবার অট্ট-হেসে ফের কাঁদছে আবার। 

লােকটির চোখ—পথের উপর; শুনছে, নিজেরই অনাকাঙ্খিত অশান্তিসমূহ। কেননা খানিক আগে, রেস্টুরেন্টে বসে মহিলাটি শােনাচ্ছিল তার বিবাহবিচ্ছেদ, কাঁদছিল। 

দুজনেই দ্বিধান্বিত, কোথায় মূলত তারা? থিয়েটারে? নাকি কোনাে পাহাড়ি পথে?
ঝুঁকিময় বাঁকের কাছে, বিপরীত দিক থেকে আচমকা মালবাহী ট্রাক ছুটে এলে—দুজনেই চমকে ওঠে।

হেঁটে হেঁটে পানশালার ভেতরে ঢুকে গেল—দুটো কৌতুক। একটা খাঁচা—বেরিয়ে পড়ল পথে, মাপসই পাখির খোঁজে। 

তিনজন ইহুদি দরবেশ—হাঁটতে হাঁটতে একদিন পেঙ্গুইন হয়ে গেল।


সম্পদের সুষমবণ্টন-সংক্রান্ত গল্প

একদা একদেশে ছিল—এক বুড়াে ও এক বুড়ি যারা খুব...খুব গরীব ছিল।

হলুদ বাইসাইকেল

আমি যাকে ভালােবাসি, সে মহিলা ভীষণ লােভী যদিও এ কথা সে মরলেও স্বীকার করে না। 

ঋজুভাবে হাঁটে, সে কী চায়—জিজ্ঞেস করি, “একটি হলুদ বাইসাইকেল,” জবাবে জানায়।

সূর্য, সূর্যমুখী, কোল্টফুট– ফুটে আছে পথের কিনারে স্বর্ণাভ ফিঞ্চ, আর এইসব হলুদাভ ফুলগুলােকেই শুধু দায়ী মনে হয়-প্রেমিকার আগুনরঙা চুল, বিড়ালের চোখ, আমাদের খিদে, আর একটি হলুদ সাইকেল-এর জন্য।

এক মধ্যরাতে, মিষ্টি প্রণয় শেষে দুজনেই সিদ্ধান্ত নিই—খিদে পেয়েছে— তাই পােশাক পাল্টে চলাে খােলা কোনাে ডােনাট শপে। ড্রাইভ করে শহরের দোকানগুলােতে পোঁছে—দোকানের বাইরে, ফুটপাতে মেক্সিকান ভবঘুরে শিশুগুলাে ঘুমিয়ে আছে। কয়েকটি মাতাল টলােমলাে হেঁটে যাচ্ছে। 

মাদক বেচছে এক কৃষ্ণাঙ্গ। দোকানে ঢােকার সময় এককোণে শতচ্ছিন্ন পােশাক, এক বৃদ্ধা দাঁড়ানাে চোখে পড়ে। খালি পা’য়। কুঁচকানাে মুখের চামড়ায় অসংখ্য ক্ষত। 

যেন অসুখ বাড়ছে সােডিয়াম আলাের নিচে পাংশুটে হলুদ আলােয়, ভিজছে। ক্ষুধার্ত। দোকানিরা এইরাতে পলিথিনে গরম খাবার করে ফুটপাতে বিলােচ্ছিল। তাকেও সাধে। 

তখন বৃদ্ধটি ছােট দুই চোখ মেলে একবার, সামান্য মাথা নেড়ে নরম কণ্ঠে বলল, “লাগবে না।”


প্রেমিকার হলুদ বাইসাইকেলীয় গান

উপসাগরের ঐ নৌকাগুলাে তােমারই অনাত্মীয়, হে আমার মসৃণ, বিপন্ন মরাল।


রনক জামান এর সমকালীন মার্কিন গদ্যকবিতা বইটি পাঠ করে কেমন লেগেছে জানাতে আমাদেরকে ইমেইল করতে পারেন। 

লিখতে পারেন সমালোচনা কিংবা রিভিউ। ৫০০-১২০০+ শব্দে লিখে পাঠিয়ে দিন সম্পাদকীয় ইমেইলে। 

Tags

Post a Comment

0Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
Post a Comment (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !