পথে প্রবাসে PDF - অন্নদাশঙ্কর রায় : Pothe Probase by Annada Shankar Ray

16 minute read
0

পথে প্রবাসে বইটি অন্নদাশঙ্কর রায় এর লেখা প্রথম ভ্রমণ সাহিত্য বিষয়ক বই।

পথে প্রবাসে

বারাে বছর বয়সে প্রমথ চৌধুরীর লেখা চার ইয়ারী কথা' পড়ে আমার মনে ইংলণ্ড ও ফ্রান্স দর্শনের কৌতূহল অঙ্কুরিত হয়েছিল। ফ্রান্সে গেলে দেখতে পেতুম ভেনাস ডি মাইলােকে। 

আর ইংলণ্ডে গেলে কতরকম অ্যাভেঞ্চার হতাে। পরে এই দুই দেশ সম্বন্ধে বহু গল্প-উপন্যাস পড়ি। তাছাড়া কলেজে গিয়ে ইউরােপের ইতিহাস প্রায় ছ' বছর ধরে অধ্যয়ন করি। 

ইণ্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সফল হয়ে শিক্ষানবিশির জন্য যখন দু' বছরের মেয়াদে বিলেত যাই তখন স্থির করে ফেলি অন্যান্য ইউরােপীয় দেশও ছুটির সময় ঘুরে দেখব। 

সৌভাগ্যক্রমে সাথী পেয়ে গেলুম মণীন্দ্রলাল বসুকে। তিনিই হলেন আমার গাইড। তার স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর আমার সাথী হলেন জয়স টারিং। আমার পরম সৌভাগ্য। 

দান্তের বিয়াত্রিসের মতাে তিনি আমাকে পথ প্রদর্শন করে নিয়ে যান। এদের দু'জনের সঙ্গ না পেলে আমার একাকী ভ্রমণ নিতান্ত নীরস হতাে। 

তাই ভ্রমণকাহিনীও সাহিত্যের স্তরে উঠতাে না। পথে প্রবাসের অনেকগুলি সংস্করণ হয়েছে কিন্তু হার্ড কভার এডিশন আর পাওয়া যায় না। 

পথে প্রবাসে pdf

সেই অভাবটা পূরণ করতে যাচ্ছেন সেই অবনীন্দ্রনাথ বেরা। এতে অলংকরণও থাকছে, তাই এর নাম হয়েছে শোভন সংস্করণ। 

তার চেয়েও বড় কথা অবনীন্দ্র এটিকে সম্পূর্ণ নির্ভুল করার জন্য যত্নবান হয়েছেন। আগেকার সংস্করণগুলিতে বেশ কিছু মুদ্রণ প্রমাদ ছিল এবং আমার নিজেরও কিছু ভ্রান্তি। এটিকে প্রামাণ্য সংস্করণ বলা যায়।

২৮.১০.৯৭
অন্নদা শঙ্কর রায়

পথে প্রবাসে এর ভূমিকা 

আমি যখন ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় প্রথম ‘পথে প্রবাসে' পড়ি, তখন আমি সত্য-সত্যই চমকে উঠেছিলুম। কলম ধরেই এমন পাকা লেখা লিখতে হাজারে একজনও পারেন না। 

শ্ৰীযুক্ত অন্নদাশঙ্করের লেখা পড়লেই মনে হয় যে, তার মনের কথা মন থেকে কলমের মুখে অবলীলাক্রমে চলে এসেছে। এ গদ্যের কোথাও জড়তা নেই এবং এর গতি সম্পূর্ণ বাধামুক্ত। 

আমরা যারা বাঙলা ভাষায় মনােভাব প্রকাশ করতে চেষ্টা করি, আমরা জানি যে, ভাষাকে যুগপৎ স্বচ্ছ ও স্বচ্ছন্দ করা, কৃতদূর আয়াসসাধ্য। 

সুতরাং এই নবীন লেখকের সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত স্বপ্রকাশ ভাষার সঙ্গে যখন আমার প্রথম পরিচয় হয়, তখন যে আমি চমৎকৃত হয়েছিলুম, তাতে আর আশ্চর্য কি?

এই নবীন লেখকের ইন্দ্রিয় ও মন দুই সমান সজাগ, আর তার চোখে ও মনে যখন যা ধরা পড়ে তখনই তা ভাষাতেও ধরা পড়ে। আমি আগেই বলেছি যে, এই নবীন লেখকের ইন্দ্রিয় ও মন দুই খােলা, আর প্রবাসে গিয়ে তার চোখ কান মন আরও বেশ খুলে গিয়েছিল। 

তিনি বলেছেন– “আমার চোখজোড়া অশ্বমেধের ঘােড়ার মত ভূপ্রদক্ষিণে বেরিয়েছে।’’

তিনি যে চোখ বুজে পৃথিবী ভ্রমণ করেন নি, তার প্রমাণ পথে প্রবাসের পাতায় পাতায় আছে। আমরা, অর্থাৎ এ যুগের ভারতবাসীরা অর্ধসুপ্ত জাত, আমরা এই বিচিত্র পৃথিবীতে আসি, আর কিছুদিন থেকে চলে যাই। 

মাঝামাঝি সময়টা একরকম ধ্যানস্তিমিত লােচনেই কাটাই। এর কারণ নাকি আমাদের স্বাভাবিক বৈরাগ্য। 

আমাদের এই মনােভাবের প্রতি কটাক্ষ করে তিনি বলেছেন :

‘চুপ করে ঘরে বসে ভ্রমণকাহিনী লেখা ভালাে, বৈরাগ্যবিলাসীর মতাে সমস্ত ইন্দ্রিয় নিরুদ্ধ করে সর্ব প্রলােভনের অতীত হওয়া ভালাে, সুরদাসের মতাে দু’টি চক্ষু বিদ্ধ করে ভুবনমােহিনী মায়ার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া ভালাে’—কিন্তু এ ভালাে তিনি চাননি, কারণ তিনি বৈরাগ্যবিলাসী নন। 

এর ফলে তার পথে প্রবাসের মধ্যে থেকে, মানবমানবীর শােভাযাত্রা থেকে কত রঙের পােশাক কত ভঙ্গির সাজ কত রাজ্যের ফুলের মতাে মুখ' পাঠকের চোখের সুমুখে আবির্ভূত হয়েছে।

শ্রীমান অন্নদাশঙ্কর লিখেছেন, যে নতুন দেশে এলে কেবল যে সব কটা ইন্দ্রিয় সহসা চঞ্চল হয়ে ওঠে, তা নয়; সমস্ত মনটা নিজের অজ্ঞাতসারে খােলস ছাড়তে ছাড়তে কখন যে নতুন হয়ে ওঠে, তা দেশে ফিরে গেলে দেশের লােকের চোখে খট করে বাঁধে, নিজের চোখে ধরা পড়ে না।

সমগ্র ‘পথে প্রবাসে' এই সত্যের পরিচয় দেয় যে ইউরােপের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয়ে লেখকের মন বিশেষ চঞ্চল ও ইন্দ্রিয় পুরোমাত্রায় সপ্রাণ হয়ে উঠেছে। এর কারণ, ইউরােপ আমাদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন দেশ। 

আর যিনি কখনাে ও-দেশে গিয়েছেন, তারই কাছে এ সত্য ধরা পড়েছে যে, সে দেশটা ঘুমের দেশ নয়, মহাজাগ্রত দেশ। 

জাগরণ অবশ্য প্রাণের ধর্ম, আর তার বাহ্য লক্ষণ হচ্ছে পথে প্রবাসে দেহ ও মনের সক্রিয়তা। কবি দ্বিজেন্দ্রলাল বাঙলা দেশের বিষয়ে বলেছেন যে, এ দেশটা স্বপ্ন দিয়ে তেরি আর স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।

এক কথায় যদি ইউরােপের বর্ণনা করতে হয় ত বলতে হয় যে, সে দেশটা গতি দিয়ে তৈরি আশা দিয়ে ঘেরা।

প্রথম বয়সে যখন আমাদের ইন্দ্রিয় সব তাজা থাকে, আর যখন মন বাইরের রূপ বাইরের ভাব স্বচ্ছন্দে ও সানন্দে গ্রহণ করতে পারে, তখন ও-দেশের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে যেটা আমাদের দেশের যুবকরা সব প্রথম মনে ও প্রাণে অনুভব করে, সে হচ্ছে ও-জগতের প্রাণের লীলা। 

আমি যখন যৌবনে পদার্পণ করে তারপর ইউরােপে পদার্পণ করি, তখন আমারও মন এই বিচিত্র প্রাণের লীলায় সাড়া দেয়। 

শ্ৰীমান অন্নদাশঙ্করের একটি কথায় আমাদের সকলেরই মন সায় দেয়, কারণ আমাদের লুপ্তপ্রায় পূর্বস্মৃতি সব আবার স্বরূপে দেখা দেয়
ইউরােপের জীবনে যেন বন্যার উদ্দাম গতি সর্বাঙ্গে অনুভব করতে পাই, ভাবকর্মের শতমুখী প্রবাহ মানুষকে ঘাটে ভিড়তে দিচ্ছে না, এক একটা শতাব্দীকে এক একটা দিনের মতাে ছােট করে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। 

সবচেয়ে স্বাভাবিক বােধ হচ্ছে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদিনের প্রতি কাজে সংযুক্ত থেকে নারী ও নরের এক স্রোতে ভাসা। আজকালকার ভাষায় যাদের তরুণ বলে, তাদের মন এর প্রতি কথায় সাড়া দেবে।

কারণ সে হচ্ছে যথার্থ তরুণ, যার হৃদয়মন সহজে ও স্বচ্ছন্দে যা স্বাভাবিক, তাতে আনন্দ পায়। অর্থাৎ যারা কোন শাস্ত্রের আবরণের ভিতর থেকে দুনিয়াকে দেখে না, সে শাস্ত্র দেশীই হােক আর বিলেতিই হােক; শঙ্করের বেদান্তই হােক আর Karl Marx এর Das Kapital-ই হােক। 

শ্রীমান অন্নদাশঙ্কর আমার বিশ্বাস বিলেত নামক দেশটা চোখ চেয়ে দেখেছেন, পুস্তকের পত্র-আবডালের ভিতর থেকে উকি মেরে দেখেন নি। এর ফলে তার ভ্রমণবৃত্তান্ত বইটি যথার্থ সাহিত্য হয়েছে।

‘পথে প্রবাসে’ এর ভূমিকা আমি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে লিখতে বসেছি দুকারণে। বাঙলায় কোন নতুন লেখকের সাক্ষাৎ পেলেই আমি স্বভাবতঃ আনন্দিত হই। 

বলা বাহুল্য যে যিনি নতুন লিখতে আরও করেছেন তিনিই নতুন লেখক নন। যিনি প্রথমতঃ লিখতে পারেন, আর দ্বিতীয়তঃ যাঁর লেখার ভিতর নূতনত্ব আছে, অর্থাৎ নিজের মনের বিশেষ প্রকাশ আছে, তিনি যথার্থ নতুন লেখক। 

পথে প্রবাসে’র লেখকের রচনায় এ দুটি গুণই ফুটে উঠেছে। আমরা, যারা সাহিত্যজগতে এখন পেনসন প্রার্থী—আমরা যে নতুন লেখকদেরও যথার্থ গুণগ্রাহী, এ কথাটা পাঠকসমাজকে জানাতে পারলে আমরা আত্মতুষ্টি লাভ করি।

দ্বিতীয়তঃ, আমি সত্য সত্যই চাই যে, বাঙলার পাঠকসমাজে এ বইখানির প্রচার ও আদর হয়। 

এ ভ্রমণবৃত্তান্ত যে একখানি যথার্থ সাহিত্যগ্রন্থ এ বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই, এবং আমার বিশ্বাস সাহিত্যরসের রসিক মাত্রেই আমার সঙ্গে এ বিষয়ে একমত। 

তবে আমি আশা করি যে, ও রসে বঞ্চিত কোনও প্রবীণ অথবা নবীন পাঠক, পুস্তকখানিকে শাস্ত্র হিসাবে গণ্য করবেন না, কারণ তা করলেই সােনা ফেলে আঁচলে গেরাে দেওয়া হবে। 

পৃথিবীতে জলবুবুদের ন্যায় নানা মত উঠছে ও মিলিয়ে যাচ্ছে। মনােজগতে এই জাতীয় মতামতের উত্থানপতনের ভিতরও অপূর্বতা আছে। কিন্তু এই সব মতামতকেই মহাবস্তু হিসাবে দেখলেই তা সাহিত্যপদভ্রষ্ট হয়ে শাস্ত্র হয়ে পড়ে। 

মতামতের বিশেষ কোন মূল্য নেই, যদি না সে মতামতের পিছনে একটি বিশেষ মনের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। আর এ লেখকের মতামতের পিছনে যে একটি সজীব মনের স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়, সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই।

শ্রী প্রমথ চৌধুরী

পথে প্রবাসে পূর্বকথা

আমার পথের আরম্ভ হলাে শ্রাবণের এক মধ্যরাত্রে, তিথি মনে নেই, কিন্তু শুক্লপকের আকাশে কোন চাঁদ ছিল না।

ভারতবর্ষের দক্ষিণ ঘুরে ভারতবর্যের বাইরে আনার পথ—কটক থেকে বম্বে, বম্বে থেকে লণ্ডন। 

বঙ্গোপসাগরের কূলে কূলে, পূর্বৰ্ঘাট পর্বতমালার ধারে ধারে, চিল্কাদের কোল ঘেঁষে, গােদাবরীর বুক চিরে, হায়দরাবাদের তেপান্তরী মাঠ পেরিয়ে, পশ্চিমঘাট পর্বতমালার সানু জুড়ে আমার পথ—কটক, ওয়ালটেয়ার, বেজওয়াডা, সেকেন্দ্রাবাদ, পুনা, বম্বে।

চিল্কার সঙ্গে এবার আমার দেখা আঁধার রাতের শেষ প্রহরে, সুন্দরী তখন আলাের স্বপ্ন দেখছে, তার দিগন্তজোড়া চোখের পাতায় যােগমায়ার অঞ্জন শ্বেতাভ হয়ে আসছে।

তমালবন দেখতে পেলুম না, কিন্তু চিল্কা থেকে গােদাবরী পর্যন্ত—হয়তাে আরাে দক্ষিণেও—তালীবনের অন্ত নেই। 

পথের একধারে পাহাড়ের পর পাহাড়, কিন্তু সব ক'টাই রুক্ষ, গায়ে তরুলতার শ্যাম প্রলেপ নেই, মাথায় নিঝরিণীর সরস স্নেহ নেই। 

পথের অন্যধারে ক্ষেত—কিন্তু বাংলার মতাে তরল হরিৎ নয়। প্রকৃতির এই বর্ণ-কার্পণ্য মানুষ তার পরিচ্ছদের বর্ণবৈচিত্র্য দিয়ে পুষিয়ে দিয়েছে। 

বিধাতা যেখানে শিল্পী সাজেন না মানুষকে সেখানে শিল্পী সাজতে হয়। মেয়েরা তাে রঙিন ছাড়া পরেই না, পুরুষেরাও রঙিন পরে, এমন দেখতে পেলুম। 

এ দেশে অবরােধ প্রথা নেই, পথে ঘাটে সুবেশা সুকেশীর সাক্ষাৎ মেলে—সুকেশী, কারণ এ দেশের মেয়েরা মাথায় কাপড় দেয় না, বিধবারা ছাড়া। 

এ দেশের জীবননাট্যে নারীর ভূমিকা নেপথ্যে নয়। দক্ষিণ ভারত নারীকে তার জন্মস্বত্ব থেকে বঞ্চিত না করে পুরুষকে সহজ হবার সুযােগ দিয়েছে। 

মুক্ত প্রকৃতির কোলে Wordsworth এর Lucy যেমন ফুলের মতাে ফুটেছিল, মুক্ত সমাজের কোলে মানুষও তেমনি মাধবী লতার মতাে সুন্দর এবং সহকারের মতাে সবল হতে পায়। 

বদ্ধ সমাজের অর্ধজীবী নারী-নর এহেন সত্য অস্বীকার করবে জানি, কিন্তু এ দেশের লােককে তর্কের দ্বারা বােঝাতে হবে না যে, মানুষ মানে পুরুষ ও মানুষ মানে নারী। 

নারীকে নিজের কাছে দুর্লভ করে আমরা উত্তর ভারতের লােক নিজেকে চিনতে ভুলেছি এবং যে আনন্দ আমরা হেলায় হারিয়েছি তার ধারণাও করতে কষ্ট পাচ্ছি। 

জন্মান্ধের যেমন আলােকবােধ থাকে না আমাদের তেমনি নারী-বােধ নেই, যা আছে তার নাম দিতে পারা যায় কামিনী-জননী-বোধ'।

এখন যার নাম হায়দরাবাদের নিজামরাজ্য আগে তার নাম ছিল গােলকোণ্ডা। 

দেশটি সুদৃশ্য নয়, সুজলা সুফলাও নয়। যতদূর দৃষ্টি যায় কেবলি প্রাত্তর, কদাচ কোথাও শৈলণ্ডষ্ঠিত, কদাচ, কোথাও শস্যচিত্রিত। মাঝে মাবে দেখা যায়—পাহাড়ের গায়ে দুর্গ। সন্দেহ হয় পাহাড়টাই দুর্গ, না দুৰ্গটাই পাহাড়। 

সমস্ত দেশটাই যেন একটা বিরাট ঘুমন্তপুরী—জনপ্রাণী নেই, গাছপালা নেই, পাখি-পাখাল নেই। তা বলে হায়দরাবাদের লােকসংখ্যা বড় অল্প নয়--প্রায় দেড় কোটি। 

এর পূর্বভাগে তেলেণ্ডদের বাস, পশ্চিমভাগে মরাঠা ও কানাড়ীদের। আর এ দেশের রাজার জাত মুসলমানেরা। রেলে যাদের দেখলাম তাদের বেশির ভাগ মুসলমান। উর্দুজবান জানা থাকলে ভ্রমণের অসুবিধা নেই।

কানাড়ী মেয়েদের অবরােধ নেই। তারা পুরুষের সঙ্গে পুরুষেরই মতাে কঠিন খাটছে, এমন দেখা গেল। পথের ধারে ক্ষেত, কিসের ক্ষেত জানিনে, ধানের নয়, জোয়ারের কিংবা বাজরার কিংবা অন্য কিছুর। 

ছাব্বিশজন পুরুষের মাঝখানে হয়তাে একজন মেয়েও খাটছে, লজ্জা সরম' নেই! নারী যে কর্মসহচরীও।

মহারাষ্ট্র পাহাড় পর্বতের দেশ-বহিঃপ্রকৃতি রুদ্র সুন্দর। নরনারীর মুখে চোখে কমনীয় প্রত্যাশা করাই অন্যায়। 

বেশভূষায় নারী যেন পুরুষের দোসর। মালাবারে যেমন পুরুষেও কাছা দেয়, মহারাষ্ট্রে তেমনি মেয়েমানুষেও কাছা দেয়। ফলে, পায়ের পশ্চাদ্ভাগ অনাবৃত ও কটু দেখায়। 

কিন্তু নারীকে যদি পুরুষের মতাে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা ও দুটোছুটি করতে হয় তবে এছাড়া উপায়ান্তর নেই। আমেরিকায় কর্মী-মেয়েরা পায়জামা পরে কাজ করে। 

মারাঠা মেয়েরা কর্মী-প্রকৃতি। তাদের অবরােধ নেই, তরুণীরা পায়ে হেঁটে স্কুল-কলেজে যাচ্ছে, বয়স্কারা attache case হাতে বাজার করতে বেরিয়েছেন, কত মেয়ে একাকী ট্রামে উঠছে, ট্রেনে বেড়াচ্ছে, ভয়ডর নেই, লজ্জা সঙ্কোচ নেই, পুরুষের সঙ্গে সহজ ব্যবহার। 

পায়ে বর্মা চটির মতাে হালকা খোলা চটি, পরনে নীল বা বেগুনী—একটু গাঢ় রঙের—ঈযৎ কেঁচা কাছা দেওয়া শাড়ি, পিঠের ওপর একরঙা শাড়ির বহুরঙা আঁচল চওড়া করে বিছানাে, মাথায় কাপড় নেই, কবরীতে ফুলের পাপড়ি গোঁজা কিংবা ফুলের।

মালা গােল করে জড়ানাে, হৃষ্টপুষ্ট সুবলয়িত দেহাবয়বে অল্প কয়েকখানা অলঙ্কার, প্রশস্ত সুগােল মুখমণ্ডলে সপ্রতিভ পুরুষকারের ব্যঞ্জনা–মহারাষ্ট্রের মেয়েদের দেখে মােটের ওপর মহাসম জাগে। 

তন্বী ওদের মধ্যে চোখে পড়ল না। কিন্তু পৃথুলাও চোখে পড়ে না। সুস্থ সবল ও সপ্রতিভ বলে এদের অধিকাংশকেই সুশ্রী দেখায়, কিন্তু রমণীয় দেখায় বললে বােধ হয় বেশি বলা হয়। 

এদের চালচলনে-চেহারায় পৌরুষের ছায়া পড়েছে বলে এদের নারীত্বের আকর্ষণ কমেছে এমনও বলা যায় না। 

পুরুষের কাছে নারী যদি কাবুলী পায়জামার ওপরে গেরুয়া আলখাল্লা ও গাড়ােয়ানী ফ্যাশানের দশ আনা ছ'আনা চুলের ওপরে চিমনী প্যাটার্নের সিল্ক টুপি পরে, তবু পুরুষের কাছে সে এমনি চিত্তাকর্ষক থাকবে। 

মারাঠা পুরুষের চোখে মারাঠা মেয়েদের যে অপূর্ব রমণীয় ঠেকে এ তাে স্বতঃসিদ্ধ, আমার চোখেও তাদের নারীর মতােই ঠেকেছে। 

দৃষ্টিকটু বােধ হচ্ছিল কেবল শ্ৰমিক-শ্রেণীর মেয়েগুলিকে; মালকোচ্চা মারা পালােয়ানদের বুকে একটুকরাে জামার উপর ময়লা নীল কাপড় জড়িয়ে বাঁধলে যেমন দেখাত এদেরও অনেকটা তেমনি দেখায়। 

যেমন এদের ভারবহন ক্ষমতা, তেমনি এদের ছুটে চলার কিপ্ৰতা। আমাদের অঞ্চলের পুরুষরা পর্যন্ত এদের তুলনায় কুঁড়ে।

মারাঠা পুরুষদের বাহুবল সম্বন্ধে যে প্রসিদ্ধি আছে সেটা সত্য নয়, আত্ততঃ আপাতদৃষ্টিতে। এদের মনের বল কিন্তু অসাধারণ। 

মুখের ওপর আত্মসম্মানবতার এমন সুস্পষ্ট ছাপ অন্য কোনাে জাতের মধ্যে লক্ষ্য করিনি। অর্থনৈতিক জীবনযুদ্ধে কিন্তু মরাঠারা গুজরাটীদের কাছে হটতে লেগেছে। 

বম্বে শহরটার স্থিতি মহারাষ্ট্রেরই জিওগ্রাফীতে বটে, বম্বে শহরের জিওগ্রাফীতে কিন্তু মহারাষ্ট্রের স্থিতি গলির বস্তিতে আর গুজরাটের স্থিতি শড়কের চারতলায়। 

বাঙালী বাঘের ঘরে যেমন মাড়ােয়ারী ঘােঘের বাসা, মারাঠা বাঘের ঘরে তেমনি গুজরাটী ঘােষের বাসা। 

গুজরাটী মানে পারসীও বুঝতে হবে। পারসীদেরও মাতৃভাষা গুজরাটী। ইদানীং অবশ্য ওরা কায়-বাক্যে ইংরেজ হবার সাধনায় লেগেছে।

গুজরাটী জাতটার প্রতি আমার কোন এক রকম পক্ষপাত আছে। শুনেছি ওদের সাহিত্য বাংলা সাহিত্যেরই ঠিক নিচে এবং রবিহীন বাংলা সাহিত্যের জনক। 

গান্ধীর মতাে ভাব-শিল্পী যে জাতির মনের স্তন্যে পুষ্ট সে জাতির মনকে বাঙালীমনের অনুজ ভাবা স্বাভাবিক। 

গুজরাটীরা পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে নানা দেশের ধনের সঙ্গে সঙ্গে নানা দেশের মনেরও আমদানী করছে এবং বিদেশী মনের সােনার কাঠি আমাদের মতাে ওদের সাহিত্যকেও সােনা করে দিচ্ছে। 

তফাৎ এই যে, আমরা যা বইয়ের মারফৎ পাই ওরা তা সৎসর্গের দ্বারা পায়। গুজরাটা পুরুষরা যে পরম কষ্টসহিষ্ণু ও কর্মঠ এ তাে আমরা দেশে থেকেও জানি, তাদের ব্যবসায়বুদ্ধিও বহুবিদিত।

গুজরাটী মেয়েদের মধ্যেও এই সব গুণ আছে কিনা জানি নে। তাদের পর্দা নেই, তবে উত্তর ভারতের সঙ্গে সংস্পৃষ্ট বলে গতিবিধির স্বাধীনতা মরাঠাদের চেয়ে কিছু কম। 

গুজরাটী মেয়েদের পরিচ্ছদ-পারিপাট্য আমাদেরি মেয়েদের মতাে; কাপড় পরার ভঙ্গিতে ইতরবিশেয থাকলেও মোটের ওপর মিল আছে। 

মারাঠা মেয়েরা সচরাচর যে অন্তর্বাস পরে তার ঝুল বুকের নিচে পর্যন্ত—কোমরের কাছটা অনাবৃত ও শাড়ি দিয়ে ঢাকতে হয়। 

গুজরাটী মেয়েরা কিন্তু আপদিচুম্বী অন্তর্বাস পরে তার ওপরে শাড়ি পরে। শুনেছি আমাদের মেয়েদের অন্তর্বাস পরা শুরু হয় গুজরাটেরই অনুকরণে ও সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের পত্নীর দ্বারা।

আমাকে সকলের চেয়ে মুগ্ধ করল গুজরাটী মেয়েদের দেহের তনুত্ব ও মুখের সৌকুমার্য। মরাঠাদের সঙ্গে এদের অমিল যেমন স্পষ্ট, বাঙালীদের সঙ্গে এদের মিলও তেমনি স্পষ্ট। 

তবে বাঙালী মেয়েদের দেহের গড়নের চেয়ে গুজরাটী মেয়েদের দেহের গড়ন অনেক বেশি সুসমঞ্জস; এবং বাঙালী মেয়েদের মুখশ্রীতে যেমন স্নিগ্ধতার মাত্রাধিক্য, গুজরাটী মেয়ের মুখশ্রীতে তেমন নয়।

পারসীরাই হচ্ছে এ অঞ্চলের Leaders of fashion। তারা কাঞ্চনকুলীন তাে বটেই, রীতিরুচিতেও অভিজাত। পারসী মেয়েদের জাঁকালাে বেশভূষার সঙ্গে ইসবঙ্গদের পর্যন্ত তুলনা করা চলে না। 

অন্ততঃ তিনপ্রস্থ অন্তর্বাস বাইরে থেকে লক্ষ্য করতে পারা যায়; প্রৌঢ়াদেরও শাড়ির বাহার আছে। মরাঠাদের যেমন আঁচলের বাহার পারসীদের তেমনি পাড়ের বাহার। 

হালকা রঙের আদর এ অঞ্চলে নেই। হাজার হাজার নানা বয়সী মেয়ের মধ্যে মাত্র কয়েকজন কিশােরীকেই হালকা রঙের শাড়ি পরতে দেখলুম। 

শাদার চল একমাত্র গুজরাটীদের মধ্যেই পরিলক্ষ্য। বলতে ভুলে গেছি গুজরাটী ও পারসীরা মাথায় কাপড় দেয়, কিন্তু ঘােমটার মতাে করে নয়, খোপার সঙ্গে এঁটে। 

গহনার বাহুল্য নেই—আমাদের মেয়েদের তুলনায় এরা নিরলঙ্কার। পারসী মেয়েরা ইংরেজী জুতাে পায়ে দেয়—জরাটী মেয়েরা সচরাচর কোনাে জুতােই পায়ে দেয় না—মারাঠা মেয়েরা চটি পরে।

বম্বে শহর কলকাতার চেয়ে আকারে ছােট কিন্তু প্রকারে সুন্দর। প্রায় চারিদিকে সমুদ্র, অদূরে পাহাড়, ভিতরেও মালাবার হিল' নামক অনুচ্চ পাহাড়, তার ওপরে বড় বড় লােকের সাজানাে। শহরের রাস্তাগুলি যেন প্ল্যান করে তৈরি। 

বম্বেসীদের রুচির প্রশংসা করতে হয়-টাকা তাে কলকাতার মাড়ােয়ারীদেরও আছে, কিন্তু তাদের রুচির নিদর্শন তাে বড়বাজারের ইটের পর ইট’! বম্বের প্রত্যেকখানি বাড়িরই যেন বিশেষত্ব আছে—প্রত্যেকেরই ডিজাইন স্বতন্ত্র। 

শহরটা ছবিল কিন্তু আমার মনে হয় এ সত্ত্বেও বম্বে ভারতীয় নগর-স্থাপত্যের ভালাে নিদর্শন নয়। বম্বের বাস্তশিল্পের গায়ে যেন ইংরেজী গন্ধ পেলুন, তাও খাঁটি ইংরেজী নয়। তবু কলকাতার নাই-শিল্পের চেয়ে বম্বের কাণ শিল্প ভালাে।

পথে প্রবাসে pdf


Book Publisher Author  F Size
পথে প্রবাসে মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত) অন্নদাশঙ্কর রায় ৫ মেগাবাইট
Bookshop Price Language  T Page
Durdin Magazine Only 190 Taka Bangla 128

Read More: সমকালীন মার্কিন গদ্যকবিতা PDF

ভারতবর্ষের মাটির ওপর থেকে শেষবারের মতাে পা তুলে নিলুম আর সদ্যোজাত শিশুর মতাে মায়ের সঙ্গে আমার যোগসূত্র এক মুহূর্তে ছিন্ন হয়ে গেল। 

একটি পদক্ষেপে যখন সমগ্র ভারতবর্ষের কক্ষচ্যুত হয়ে অনন্ত শূন্যে পা বাড়ালুম তখন যেখান থেকে পা তুলে নিলুম সেই পদ-পরিমাণ ভূমি যেন আমাকে গােটা ভারতবর্ষেরই স্পর্শ-বিরহ অনুভব করিয়ে দিচ্ছিল; প্রিয়জনের আঙুলের ডগাটুকুর স্পর্শ যেমন প্রিয়জনের সকল দেহের সম্পূর্ণ স্পর্শ অনুভব করিয়ে দেয়, এও যেন তেমনি।

জাহাজে উঠে বম্বে দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি করুণ। 

এত বড় ভারতবর্ষ এসে এতটুকু নগরপ্রান্তে ঠেকেছে, আর কয়েক মুহূর্তে ওটুকুও স্বপ্ন হবে, তখন মনে হবে আরব্য উপন্যাসের প্রদীপটা যেমন বিরাটাকার দৈত্য হ'য়ে আলাদীনের দৃষ্টি জুড়েছিল, ভারতবর্ষের মানচিত্রখানা তেমনি মাটি জল ফুল পাখি মানুষ হয়ে আজন্ম আমার চেতনা ছেয়েছিল, এতদিনে আবার যেন মানচিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে।

আর মানচিত্রে যাকে ভারতবর্ষ ও আফ্রিকার মাঝখানে গােপদের মতাে দেখাত সেই এখন হয়েছে পায়ের তলার আরব সাগর, পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ কোনাে দিকে চক্ষু তার অবধি পায়।

ঢেউগুলাে তার অনুচর হয়ে আমাদের জাহাজখানাকে যেন গলাধাক্কা দিতে দিতে তার চৌকাঠ পার করে দিতে চলেছে। 

ঝটার নাম বর্ষা ঋতু, মনসুনের প্রভঞ্জনাহতি পেয়ে সমুদ্র তার শত সহস্র জিহ্বা লকলক করছে, জাহাজখানাকে একবার এদিকে কাৎ করে একবার ওদিক কাৎ করে যেন ফুটন্ত তেলে পাথরের মতাে উল্টে পাল্টে ভাজছে। 

জাহাজ টলতে টলতে চলল, আর জাহাজের অধিংশ যাত্রি-যাত্রিণী ডেক ছেড়ে শয্যা আশ্রয় করলেন। অসহ্য সমুদ্রপাড়ায় প্রথম তিন দিন আচ্ছন্নের মতাে কাটল, কারুর সঙ্গে দেখা হবার জো ছিল না, প্রত্যেকেই নিজের নিজের ক্যাবিনে শয্যাশায়ী। 

মাঝে মাঝে দু'একজন সৌভাগ্যবান দেখা দিয়ে আশ্বাসন করেন, ডেকের খবর দিয়ে যান। আর ক্যাবিন স্টুয়ার্ড খাবার দিয়ে যায়। 

বলা বাহুল্য জিহ্বা তা গ্রহণ করতে আপত্তি না করলেও উদর তা রক্ষণ করতে অস্বীকার করে।
ক্যাবিনে পড়ে পড়ে বানে ও উপবাসে দিনের পর রাত রাতের পর দিন এমন দুঃখে কাটে যে, কেউ-বা ভাবে মরণ হলেই বাঁচি, কেউ-বা ভাবে মরতে আর দেরি নেই। 

জানিনে হরবন্নভের মতাে কেউ ভাবে কি না যে, মরে তাে গেছি, দুর্গানাম করে কী হবে। 

সমুদ্রপীড়া যে কী দুঃসহ তা ভুক্তভােগী ছাড়া অপর কেউ ধারণা করতে পারবে না। 

হাতের কাছে রবীন্দ্রনাথের ‘চয়নিকা’,—মাথার যন্ত্রণায় অমন লােভনীয় বইও পড়তে ইচ্ছা করে না।

ইচ্ছা করে কেবল চুপ ক'রে পড়ে থাকতে, পড়ে পড়ে আকাশ পাতাল ভাবতে।

  1. পথে ও প্রবাসে ২১
  2. পথে ও প্রবাসে ২০
  3. পথে প্রবাসে ১৯
  4. পথে প্রবাসে ১৮
  5. পথে প্রবাসে ১৭


পথে প্রবাসে pdf বইটি পড়ে আপনাদের কেমন লেগেছে জানাবেন। 

Tags

Post a Comment

0Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
Post a Comment (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !