হ্রদ অঞ্চলের কথা দিয়েই আমরা শুরু করি, কারণ টমাস ওখানেই থাকত, আর সেই নদীটার নাম ইসসা। এখানে ভূতের সংখ্যা আশ্চর্য রকমের বেশি। নদীর পাড় বরাবর ফাপা উইলােগাছ, কারখানা আর ঘন ঝােপঝাড়।
যেসব ‘প্রাণী’ উপযুক্ত পরিবেশ পেলে তবেই দেখা দেন, তাদের পক্ষে সুবিধাজনক আড়াল পাওয়া যায় এখানে। যারা তাদের দেখেছে, তারা বলে ভূতকে বরং বেঁটেই বলা যায়, এই নয়-দশ বছরের ছেলের মতাে ; পরনে সবুজ রঙের ফ্রককোট, কুচি-দেয়া জামা, বিনুনি করে বাঁধা চুল, উঁচু হিলওয়ালা চটি পরা।
ভূত নাকি তার পা লুকাবার খুব চেষ্টা করে, সেগুলাে দেখাতে তার ভারি লজ্জা !... এসব কাহিনী কিছুটা সতর্কভাবে বিশ্বাস করা উচিত। ব্যবসা-বাণিজ্য, আবিষ্কার-উদ্ভাবন আর বিজ্ঞানচর্চার কারণে জার্মানদেরকে লােকে ভীতির চোখে দেখে। এ কথা জেনেই হয়ত ভূতেরা ইম্যানুয়েল কান্টের কায়দায় বেশভূষা করে নিজেদের ভারিক্কি দেখাতে চায়!
তারা যে কখন কার মূর্তি ধরে আবির্ভূত হবে, তা আগে থেকে বলা যায় না। সেন্ট-অ্যান্ড্রু উৎসবের আগের সন্ধ্যায় একটি মেয়ে দুটি মােমবাতি জ্বালিয়ে আয়নার ভিতর তাকিয়ে আছে, ভবিষ্যতের ছবি ফুটে ওঠে তার মধ্যে। যে লােকের সঙ্গে তার জীবন বাঁধা পড়বে তার মুখটাই হয়ত দেখা যাবে। খ্রিষ্টধর্মের আবির্ভাবের সময় থেকেই ভূতের আবির্ভাব।
পুরনাে ঝােপের নিচের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসে এইসব ‘খুদেপ্রাণীরা রাতের বেলায় দিক-বিদিক ঘুরে বেড়ায়। অতীতের আদিবাসীদের থেকে কে তাদের আলাদা করে চিনতে পারবে, বলুন ? ভূত আর ওইসব পৃথক প্রাণীরা কি। তবে নিজেদের মধ্যে কোনাে চুক্তি করেছে ? নাকি, জেই-পাখি, চড়াই আর কাকের মতাে এরাও স্রেফ পাশাপাশি বাস করে ?
অনুমান করা যায়, পৃথিবীর গভীর জঠরে এক সংসদীয় অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছিল এত গভীরে যে পৃথিবীর তরল কেন্দ্রের আগুনের তাপে সেগুলাে গরম হয়ে উঠেছিল। ফ্ৰককোট গায়ে লক্ষ লক্ষ ‘খুদে-ভূত’ সেই অধিবেশনে যােগ দিয়েছে। নরকের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিনিধিরা বক্তৃতা দিচ্ছেন, আর এরা গম্ভীর মুখে তা শুনছে।
বক্তারা ঘােষণা করেন, মহান স্বার্থে জঙ্গলের সমস্ত নৃত্য বন্ধ করতে হবে ; বিশেষজ্ঞদের এমনভাবে কাজ করতে হবে যেন নশ্বর মানুষ কিছুতেই আমাদের অস্তিত্বের সন্ধান না পায়। প্রচুর সংযত করতালি পড়ে। কারণ উপস্থিত
প্রাণীরা বুঝতে পারে যে প্রগতি তাদের নিক্ষেপ করবে আরাে অন্ধকারে। সূর্যের পাটে বসা, মাছরাঙার উড়ে যাওয়া, তারার ঝিকিমিকি, আনন্দিত এ পৃথিবীর অনেক আশ্চর্যজনক জিনিস আর তারা দেখতে পাবে না !
ইয়ােরােপের এ অঞ্চল দীর্ঘ তুষারে ঢাকা আর তার নৈসর্গিক সৌন্দর্যেও যথেষ্ট পৌরুষ। পাথুরে, বেলে-জমি শুধু আলু, রাই, জই আর শণ চাষের উপযুক্ত। জঙ্গল যাতে নষ্ট না হয় তার এর জন্য এত যত্ন। বার্চ, ওক আর হর্নবিম গাছ প্রচুর আছে, তবে বিচ গাছ নেই।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা এখানে কান্তিহীন ঘুরে বেড়ানাে যায়। শহরগুলাের মতাে এখানের বৃক্ষগুলােরও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে কোথাও দ্বীপ আর কোথাও চক্রের সৃষ্টি করে। ঠেলাগাড়ির চাকায় তৈরি গর্ত, জঙ্গল—তত্ত্বাবধায়কের কুটির বা ভেঙে পড়া পুরনাে চোলাই কারখানার আগাছায় ভরতি চুল্লিগুলাে দিয়ে। প্রত্যেকটিকে আলাদা করা যায়। যে কোনাে পাহাড়ের মাথা থেকে তাকালেই চোখে পড়ে হ্রদের নীল ঢেউ আর তার সঙ্গে ঝক ঝক সাদা গখ্রীব-পাখি আর পাখাঝাপটানাে হাঁসের সারি। জলচর মােরগ আর সাইপের হু-হু পতপত শব্দে জলাগুলাে সবসময়ই প্রাণবন্ত।
প্রণয়লীলার একঘেয়ে কসরত দেখানাের সময় স্নাইপের লেজে বাতাসের ধাক্কা লেগে ঐ অদ্ভুত শব্দটা তৈরি হয় যা দূর থেকে ভেসে আসা গির্জার সঙ্গীতের মতাে।
যখন বরফ গলা শেষ হয় স্নাইপের ডানার শব্দ, কালাে মােরগের বকবকম, ব্যাঙের মকমক শব্দের সাথে ড্যাফনি ফুলে রং দেখা দিতে শুরু করে। ছােট ছােট পিঙ্ক আর লাইলাকে কুঁড়ি দেখা দেয় । দীর্ঘ রৌদ্রকরােজ্জ্বল হেমন্তের দিনে বৃষ্টিভেজা শণের গন্ধে রাজহাঁসগুলাের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়। আকাশে তাদের বন্য-স্বজনরা ডাক দিয়ে যায় ডানা মেলে দিতে, আর এরা অনভ্যস্ত অপটু ডানায় তাদের অনুসরণ করার ব্যর্থ প্রয়াসে লাফ দিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বাতাসে।
বাচ্চাদের কেউ কুড়িয়ে নিয়ে আসে ডানাভাঙা এক সারস সুদূর নীলনদ পর্যন্ত উড়ে যাওয়ার ক্ষমতা যাদের নেই। বনানী কান পেতে শােনে শিকারি কুকুরের কণ্ঠধ্বনি প্রথমে সরু চড়া আওয়াজ, তারপর গমগম করা পুরুষালি সুর—তাতে সব সময়েই বােঝা যায় শিকারের অনুসরণ করছে তারা ; হয় খরগােশের পিছনে, না হয় পুরুষ হরিণকে ধাওয়া ; যদিও ধ্বনির তীক্ষ্ণতা থেকে পার্থক্যটা আলাদা করা যায় না।
জীবনের জন্য প্রয়ােজনীয় সব কিছুই এই সেদিন পর্যন্ত বাড়িতেই তৈরি হত এ অঞ্চলে। ঘরে কাটা মােটা সুতা দিয়ে তৈরি হত পােশাক। মেয়েরা ঘাসে বিছিয়ে সেগুলাে রােদে সাদা করে নিত। হেমন্তের শেষ দিকে, দিনের যে সময়টা মানুষ গল্প করে, সরু আঙুলগুলাে সেই সময় চরকায় সুতা কেটে চলত।
এই সুতা দিয়েই ঘরনীরা তাঁতে কাপড় বুনত, কে কী নকশা বুনছে তা সযত্নে গােপন রেখে । কোনােটি দেখতে মাছের কাটার মতাে, কোনােটি বা তেরচা টুইলের জাফরি। টানায় এক রং, দীঘায় অন্য । লিন্ডেন গাছের ছাল দিয়ে তৈরি হালকা জুতাে এখনাে লােকে পরে।
প্রথম মহাযুদ্ধে সমবায় পদ্ধতিতে ডেয়ারি, মাংস আর শস্যের বাজার চালু হয়। গ্রামবাসীদের জীবনের প্রয়ােজনীয় সামগ্রীর পরিবর্তন ততদিন পর্যন্ত দেখা দেয়নি। কাঠের তৈরি কুটিরের ছাদ খড় দিয়ে না ছেয়ে পাতলা তক্তা দিয়ে থাক থাক করে সাজানাে। একটা দুভাগ হওয়া খুঁটিতে আড়াআড়ি কাঠের কড়ি বেঁধে, একদিকে পাথরের ভার চাপিয়ে কপিকল তৈরি করা হয়।
ইদারার পানি তােলার কাজে সেগুলাে লাগে। বাড়িতে ঢােকার মুখে ছােট্ট একটু বাগান মেয়েদের গর্ব আর আনন্দ। এইখানে মেয়েরা ডালিয়া আর ম্যালাে লাগায় এই গাছ কেবল মাটিতেই সুন্দর, তা নয়—দেয়ালেও ছড়িয়ে পড়ে।
নানা দিক থেকে উপত্যকাটি হ্রদ অঞ্চলের সঙ্গে বেমানান । ইসসা এক গভীর, কালাে নদী ; মন্থর স্রোত, পাড়ে ঘন নলখাগড়ার বন । লিলি ফুলের আস্তরে পানি প্রায় চোখেই পড়ে না। দুধারে উর্বর ঢালু জমি মাঠের মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে সে। কালাে মাটির আমিষপুষ্ট উপত্যকা সরস ফলবাগানের প্রাচুর্য আর দুনিয়া থেকে এত দূরত্বের কারণে সম্ভবত স্থানীয় অধিবাসীরা এর সৌন্দর্য নিয়ে মাথা ঘামায়নি। একটিমাত্র প্রধান সড়ক চলে গেছে নদীর কোল বরাবর।
এই অঞ্চলের গ্রামগুলাে তারই ধারে বা অনেক উপরে সমতল জায়গাতে হওয়ার জন্যে অন্যান্য। জায়গার থেকে অনেক সমৃদ্ধ। রাতে জানালায় আলাে জ্বলে, এ গ্রামের আলােগুলাে ঐ গ্রামের আলােগুলাের সঙ্গে চোখে-চোখে তাকায়।
মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটা প্রতিধ্বনি কক্ষের মতাে প্রতিটি হাতুড়ির শব্দ, কুকুরের ডাক আর মানুষের গলার আওয়াজকে ব্যঙ্গ করে। প্রাচীন গানের জন্য উপত্যকাটি কেন এত বিখ্যাত তার ব্যাখ্যাও সম্ভবত এইখানে। গানগুলাে কখনই একতানে গাওয়া যায় না। কোন গ্রামের লােকেরা বেশি সুরেলা করে প্রতিবেশীদের উপর টেক্কা দিতে পারে তারই চেষ্টা চলে।
ইসসা ভ্যালি বরাবর সেই আদিম কাল থেকে লােকসংগীত সংগ্রাহকেরা যেসব গান সংগ্রহ করেছেন, তাতে প্রধান বিষয়বস্তু হচ্ছে চাঁদ উঠছে তার বাসরশয্যা থেকে ; পত্নী সূর্যের সঙ্গে সেই শয্যায় তিনি নিদ্রা যাবেন।
ইসসা উপত্যকায় একদিন
গিনে গ্রামে টমাসের যখন জন্ম হয়েছিল বছরের সেই সময়টায়, বিকালের ঝিম ধরা প্রহরে যখন পাকা আপেল ধুপ করে খসে পড়ে মাটিতে ; হেমন্তের ফসল ঘরে। তােলার পর সদ্য তৈরি এলে-মদের জাগ রাখা হয় হলঘরে ঢােকার মুখে।
ওক গাছের ঘন বনে ঢাকা খুদে পাহাড়ের থেকে বেশি কিছু নয় এই গিনে। এখানে যে একটা কাঠের গির্জা ছিল- তা হতে পারে শান্তিপূর্ণ উত্তরণের প্রমাণ। কারণ একদিন বজ্র আর বিদ্যুতের দেবতার উদ্দেশ্যে পূজা হত এখানে।
গির্জাটার পিছন দিকে পাথরের একটা দেয়ালের ঠেস দেয়া আছে, সামনের সবুজ মাঠ থেকে নদীর বাঁকগুলাে চোখে পড়ে ; আরো চোখে পড়ে বড়াে নৌকোয় চাপিয়ে একটা গাড়ি ওপারে নিয়ে যাওয়া।
বুলবুল সরওয়ার অনুবাদ শুরু করেন কুরবান সাঈদের কালজয়ী ক্লাসিক্স আলী অ্যান্ড নিনাে। অনুবাদ দিয়ে। অনুবাদ-তার মতে রূপান্তর বা ভাষান্তর । নিজে কবি বলেই তিনি স্বীকার করেন, শ্রেষ্ঠ রচনার অনুবাদ আসলে কদাচিৎ সম্ভব!
তবুও তিনি বিশ্ব সাহিত্যের ভাণ্ডার থেকে বাংলা বইয়ে তুলে এনেছেন হ্যাগার্ডের মুন অভ ইজরাইল, সিংকিবীচের কুয়াে ভাদিস, পার লাগেৰ্কভিস্টের ‘বারাব্বাস, থিয়ােংগোর এ গ্রেন অভ হুইট’, সেলমা গাগেলোফের টেলস অভ এ ম্যানর’ এবং ন্যূট হামসূনের ‘ভিক্টোরিয়া ইত্যাদি তার প্রায় সব অনুবাদই স্বীকৃতি পেয়েছে মৌলিক সৃষ্টির মর্যাদায়।
ছয়টি অনুবাদসহ বুলবুলের এ-যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা উনিশ। তার জন্ম গােপালগঞ্জে ১৯৬২’র ২৭ নভেম্বর। ঢাকা মেডিকেলের স্নাতক শেষে এই কবি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন নিপসম ও কায়রাে ডেমােগ্রাফিক সেন্টার থেকে। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
পােলিশ-আমেরিকান কবি, অনুবাদক, সমালােচক ও ঔপন্যাসিক চেশােয়াভ মিলােসেভের জন্ম লিথুনিয়ায় ১৯১১ সালের ৩০ জুন। আইন নিয়ে পড়াশুনা করা মিলােসেভ কখনাে আইন পেশায় নিযুক্ত হননি। সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও শিল্পের সকল মাধ্যমে তিনি ছিলেন সর্বগ্রাহী।
কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করেছেন ফ্রান্স ও আমেরিকায়। বিশ্বাসের মতান্তরে মিলােসেভ প্রথমে প্যারিস, পরে আমেরিকায় অভিবাসী হন। থিতু হন শিক্ষকতায়। মিলােসেভের মৌলিক লেখার চেয়ে অনুবাদের সংখ্যা বেশি। পােলিশ ভাষায় বাইবেলের সফলতম অনুবাদক তিনি। ভাষা শেখায় তার আগ্রহ যে-কোন অ্যাকাডেমিককে হার মানায়।
১৯৮০-তে নােবেল-কমিটির ভাষ্যে বলা হয়, ‘আনকম্প্রোমাইজিং ক্লিয়ার-সাইটেডনেস ভয়েসেস ম্যানস এক্সপােন্ড কন্ডিশন ইন এ ওয়ার্ল্ড অব সিভিয়ার কনক্লিক্টস। পঞ্চাশটি বইয়ের লেখক বা অনুবাদক মিলােসেভ স্টালিনের সমালােচনা করায় নিজ দেশে নিষিদ্ধ ছিলেন প্রায় তিরিশ বছর। হয়ত এই দুর্ভাগ্যই তাকে পরিচিত করিয়েছে সারা দুনিয়ায় । Dolina Issy গ্রন্থের টমাস কবি মিলােসেভের নিজেরই শৈশব-চিত্র। ২০০৪’র ১৪ আগস্ট মিলােসেভের মৃত্যু হয় জন্মস্থানের পাশেই- ক্রাকাও’ এ।