সিদ্দিক আহমেদ এর থ্রিলার উপন্যাস বই নটরাজ প্রকাশিত হয়েছে। আলোঘর প্রকাশনা থেকে ২০১৬ সালে বইটির হার্ডকপি প্রকাশিত হয়। বইটি পাওয়া যাবে দুর্দিন ম্যাগাজিন ফেসবুক পেইজে।
নটরাজে জিতু
বান্দরবান জায়গাটা সুন্দর হবে জিতু ভাল করেই জানত। কিন্তু এত সুন্দর হবে সেটি তার কল্পনায়ও ছিল না।
নীলগিরি রিসাের্ট থেকে থানচি আসতেই চোখ জুড়িয়ে যায়।
আশপাশে দেখতে দেখতে সিহাবকে খোঁচা দেবার লােভ জাগল জিতুর, “কিরে ব্যাটা, আসতেই তাে চাচ্ছিলি না?'
সিহাব বুঝল এখন কিছু বলা মানে জিতুর ফাদে ধরা পড়ার আশঙ্কা। তাই কিছু না বলে একটা রহস্যময় হাসি ফিরিয়ে দিল।
জিতু মােটেও হাসিতে ভােলার পাত্র নয়। তাই সে খোঁচা দিয়ে আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই তাদের গাড়িটা ব্রেক কষে থেমে গেল।
‘থানচি চলে আসছি, ভাইজান। ড্রাইভার সবাইকে শুনিয়ে আওয়াজ দিল।
জিতু কোনাে বাক্য ব্যয় না করে গাড়ি থেকে নেমে তার ব্যাক প্যাকটা তুলে নিল। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে গাড়ির ভাড়াটা মিটিয়ে দিল।
তার দেখাদেখি সিহাব ও নাবিলা ব্যাগগুলাে কাঁধে ঝুলিয়ে লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল।
‘এখান থেকে রেমাক্রি যাবার সিস্টেম কী ড্রাইভার সাহেব? ‘রেমাক্রি কই যাবেন? ‘ঠিক রেমাক্রি যাব না, যাব বড় মদক।
‘তাইলে নৌকা নিয়েন একটা, ওরাই রেমাক্রি হয়া বড় মদককের ওইখানে পৌছায় দিবেনে, মনে কইরা গাইড নিয়ে একখান।
বন গাইড নিয়েন, হেরা ঐসব অঞ্চল আবার ভাল চিনে। অনেক মাঝিও আবার গাইড হিসেবে কাম করে। চাইলে অগােরেও নিতে পারেন।
কিন্তু জিতুদের নৌকা ঠিক করবার আগে যে কাজটা করতে হল সেটাকে একরকম যুদ্ধই বলা চলে।
বিজিবিকে নিজের চোদ্দগােষ্ঠীর ঠিকানা দেবার পরেতাদের থেকে রেমাক্রি বাজার যাবার অনুমতি পাওয়া গেল।
আর তারা পইপই করে বলে দিল রেমাক্রি পৌছেই যেন তারা সেখানকার বিজিবি ক্যাম্পে রিপাের্ট করে। অনুমতি পাবার কিছুক্ষণের ভেতর জিতুরা একটা নৌকা ঠিক করে নিয়ে সাঙ্গু নদীতে ভাসতে একমুহূর্ত দেরি করল না।
তবে নৌকার মাঝিদের সঙ্গে কথা ঠিক হল যে, তারা শুধু রেমাক্রি যাবে, রেমাক্রি যাবার পর ভেবে দেখবে তারা বড় মদক আদৌ যাবে কি-না।
বাংলাদেশের এই একমাত্র পাহাড়ী নদীতে ভাসতে শুরু করবার কিছুক্ষণ পরেই দলের সবাই দুই পাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ডিএসএলআর ক্যামেরায় বন্দী করতে ঝাপিয়ে পড়ল।
চারপাশে পাহাড় থেকে পাথর ভেঙে ভেঙে সাঙ্গুর দুধারে গড়িয়ে এসে জমা হয়েছে। সেটি খালি চোখে দেখতেই অসম্ভব সুন্দর। ক্যামেরায় তাে সেটা আরও ভাল লাগবেই।
তার ওপর কিছুক্ষণ পরপর গুহার মতাে কিছু জায়গা থেকে ছােট ছােট ঝরনা নদীর দুধার থেকে বয়ে এসে সাঙ্গু নদীতে মিশেছে। সেটাও আরেক ধরনের অদ্ভুত ব্যাপার।
শহুরে দলটির কেউই এমন প্রাকৃতিক ঝরনা আগে দেখেনি বলেই তাদের কাছে এটি অপার বিস্ময়ের। আনমনে ছবি তুলতে তুলতেই জিতুরা বড়িয়ারি চলে এলাে।
আর বড়িয়ারিতে এসেই শুরু হল আসল যুদ্ধ। জিতুরা সামনে তাকিয়ে দেখেই বুঝতে পারল পানি অনেকটা সিঁড়ির মতাে ধাপে ধাপে তাদের নৌকার নিচের দিকে এসে পড়ছে।
এখানে প্রত্যেক নৌকার মাঝিকেই স্রোতের বিরুদ্ধে নৌকা নিয়ে যেতে প্ৰবল যুদ্ধ করতে হচ্ছে।
জিতুরা তাদের নৌকার মাঝির কথায় নৌকা থেকে নেমে পাড় ধরে সামনে এগােতে লাগল। নদীর পাড়ে আদিবাসী মেয়ে কী যেন কুড়াচ্ছে, সেটা দেখে নাবিলা একজনের কাছে গিয়ে তার পিঠের ঝুড়িতে গিয়ে উঁকি দিল।
ঝুড়ির ভেতর উঁকি দিয়ে দেখতে পেল সেখানে অনেকগুলাে ছােট শামুক পড়ে আছে। কেউ বলে না দিলেও নাবিলা বুঝতে পারল, এই শামুকগুলাে উপজাতি মানুষদের একধরনের খাবার বিশেষ।
উপজাতি মেয়েদের সবাই যে নদীর পাড়েই শামুক কুড়াচ্ছে এমন না, তাদের কেউ কেউ আবার নদীর পানিতে নেমেও শামুক কুড়াচ্ছে। জিতু ঝটপট এমন মাজা পানিতে উপজাতি মেয়েদের শামুক কুড়াবার দৃশ্য তার ক্যামেরায় ধারণ করে ফেলল।
ছবি তুলতে তুলতে কিছুদূর এগিয়ে জিতু পাড় থেকে স্রোতের যে গর্জন শুনতে পেল সেটা রীতিমতাে গা শিওরে ওঠার মতাে।
নৌকাটা কোথায় খুঁজতে সাঙ্গুর পাড় থেকে জিতুরা দেখতে পেল মাঝি ও তার দলবল পেছনের একটা জায়গায় নৌকাটাকে স্রোতের বিপরীতে টেনে নেবার অবিরাম যুদ্ধে লিপ্ত।
জিতুরা আর না এগিয়ে একটা পাথরের উপর বসে নৌকাটার অপেক্ষা করতে শুরু করল।
আধ ঘণ্টার অক্লান্ত যুদ্ধ শেষে মাঝিদের জয় হল, তারা নৌকাটি আগের তুলনায় একটু স্থির পানিতে টেনে নিয়ে যাবার পর আবার শুরু হল রেমাক্রি যাত্রা।
স্রোতের বিপরীতে সাঙ্গুর বুক চিড়ে এবার নৌকা চলতে শুরু করল খুবই ধীর গতিতে, মাঝির ভাষায় নৌকা এখন উজানে যাচ্ছে তাই কষ্ট বেশি। নৌকা যত ভেতরে যেতে থাকল নিচের পানি তত স্বচ্ছ হতে শুরু করল।
সিহাবের মনে হল এটাই তার সবচেয়ে ভাল ভ্রমণ। না আসলে অনেক কিছু দেখা বাদ থেকে যেত।
নাবিলা এদের ভেতর সবচেয়ে চুপচাপ, কথা বলে না বললেই চলে।
সেও শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে মুখ খুলল, “দোস্ত, মনে হচ্ছে স্বর্গে চলে এসেছি।
কিন্তু স্বর্গে যেতে গেলেও যে কষ্ট লাগে সেটার প্রমাণ তা টের পেলাম একটু পরেই।
তিন্দু পার হয়ে বড় পাথর এলাকাটা আসবার পর, নদীর পানির মাঝখানে বিশাল বড় বড় পাথরের চাঁই খাড়া হয়ে আছে। আর তাদের নৌকাকে যেতে হবে এই পাথরের ফাঁক গলে।
পাথরের ফাঁকে ঢােকার আগে এক মাঝি তাদের ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বলে দিল তারা যেন এই জায়গায় চুপচাপ থাকে, এটা ধর্মীয়ভাবে পবিত্র স্থান।
জিতুরা চুপ করে গেলে পাথরের ফাকে-ঢােকার আগে চাকমা মাঝি তার নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল, তারপর হাতের বাঁশের লগি দিয়ে ঠেলে
পাথরের ফাঁক দিয়ে নৌকা বের করে নিয়ে যেতে শুরু করল।
এই পাথরের ফাঁক দিয়ে যাবার সময় তারা বুঝতে পারল ব্যাপারটা কতটা বিপজ্জনক। দুই পাথরের ফাঁক থেকে নৌকার দুপাশের দূরত্ব মাত্র কয়েক ইঞ্চি, তার উপর প্রবল স্রোতে নৌকার ভারসাম্য প্রায়ই হারিয়ে গিয়ে পাশের পাথরে বাড়ি খাচ্ছে হুটহাট।
কিন্তু শুধু এটা হলেও হত, নিচে স্বচ্ছ নদীর পানির নিচে যে ডুবাে পাথরগুলাে দৃশ্যমান হয়ে আছে তা নৌকার জন্য খুবই বিপজ্জনক যে কোনাে সময় তাল হারালে তলে পাথর লেগে নৌকাটাই উল্টে যেতে পারে।
নৌকার চাকমা মাঝি দুবার তাল সামলাতে যেয়ে লগি থেকে তার হাত পিছলে গেল, সেটা দেখে জিতুরা আর রিস্ক নিল না।
একবার ডুবাে পাথর লেগে নৌকার তলা ফেটে গেছে, উল্টে গেলে বড় মদক যাওয়া মাথায় উঠবে, তাই তারা পুরাে গ্রুপ নিয়ে নদীর পাড়ে নেমে বড় বড় পাথরের পাশ ধরে হাঁটতে শুরু করল।
হাঁটতে হাঁটতে জিতু দেখতে পেল তুলনামূলক বিশাল একটা পাথরের কাছে এসে মাঝি ১০ টাকার একটা নােট পাথরের দিকে তাক করে পানিতে ভাসিয়ে দিল।
বড় পাথর এলাকাটা পার হয়েই তারা আবার নৌকায় চড়ে বসল। জিতু এবার নৌকায় চড়েই জিজ্ঞাসা করল, আপনি তখন ১০ টাকা পানিতে ছেড়ে দিলেন কেন?
চাকমা মাঝি ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় যা বলল তা হল, এটা রাজা পাথরের উদ্দেশ্যে দেওয়া ভেট।
এবার জিতু লাগল রাজা পাথর জিনিসটা কি সেটা বের করতে। জিতুর অবিরাম প্রশ্নের মুখে চাকমা মাঝির কাছ থেকে জানা গেল, বর্ষায় সব ডুবে গেলেও এই রাজা পাথর কখনাে ডুবে যায় না।
স্থানীয়রা বিশ্বাস করে এই রাজা পাথর আসলে জীবন্ত এবং এটা তিন্দু নামে একজন রাজার মুকুট। বড় পাথরের ঠিক আগেই যে তিন্দু বাজার তারা পার করে এসেছে আসলে সেই নামে খুমিদের একজন রাজা ছিলো।
খুমি জাতিগােষ্ঠীর এই রাজার সঙ্গে একবার তং রাজার যুদ্ধ হয়, যুদ্ধে তং রাজা জয়ী হয় আর তিন্দু রাজা পরাজিত হয়ে তার রানী ও মন্ত্রী সান্ত্রী নিয়ে পালিয়ে আসে এবং একদিন কোনাে এক কারণে সবাই মিলে জীবন বিসর্জন দেয় এই সাঙ্গু নদীতে।
কিন্তু খরস্রোতা সাঙ্গু নাকি তাদের এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। তাই এই বড় পাথর এলাকার কোনো পাথর মন্ত্রী কোনটা রাণি আবার কোনােটা কলসি বা মুকুট।
জিতুরা এমন আজব গল্প শুনে বাকি রাস্তাতে আর তেমন কথা বলল না। শুধু একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে লাগল।
সবমিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর ইঞ্জিন চালিত নৌকাটা স্রোতের বিপরীতে যুদ্ধ করে তাদের রেমাক্রি বাজারে নামিয়ে দিল।
রেমিক্রি বাজারে নেমে জিতুরা সিদ্ধান্ত নিল আজই বড় মদক যাত্রা করবে, তাই নৌকাটা না ছেড়ে দিয়ে বড় মদক পর্যন্ত ঠিক করে নিল।
সবার আগে যেতে হল বিজিবি ক্যাম্পে। কারণ ক্যাম্প থেকে নদীর ঘাট পুরােটা দেখা যায়। সুতরাং ক্যাম্পের লােকদের গুরুত্ব দিয়ে এখনই বলতে না গেলে দেখা যাবে বড় মদক যাবার অনুমতিই পাওয়া যাবে না।
ক্যাম্পে পৌছে প্রথমে অনুমতিই পাওয়া গেল না। কারণ বিজিবি ক্যাপ্টেন এখন ক্যাম্পে নেই। তাই সাধারণ বিজিবি জওয়ানদের কেউ দায়িত্ব নিয়ে তাদের অনুমতি দিতে রাজি হল না।
আর জিতুদের সঙ্গে একজন মেয়ে আছে এটাও নাকি অনেক বড় সমস্যা। মাত্র দুদিন আগেই কয়েকজন পর্যটক নৌকাডুবি হয়ে মারা গেছে।
তবে নাছােড়বান্দা সিহাব, বসেই থাকল বিজিবি ক্যাপ্টেনের আসবার অপেক্ষায়। ক্যাপ্টেন আসলে সবার অনুরােধে সে শেষ পর্যন্ত তাদের অনুমতি দিল বটে, তবে বার বার স্মরণ করিয়ে দিল তারা যেন বেশি ভেতরে না যায় এবং খুব সাবধানে থাকে।
কারণ হিসেবে সে জানালাে বড় মদকের পর আর কোনাে বিজিবি চেকপােস্ট নেই। তাই সেখানে যে কোনাে ধরনের বিপদ হতে পারে। আর বিপদ হলে সাহায্য পাবার আশা শূন্য।
নটরাজ এর আন্ধারমানিকে যাত্রা
অনুমতি পাবার কিছুক্ষণ পরেই শুরু হল বড় মদকযাত্রা। এবার নৌকার আগের লােকদের সঙ্গে মানুষ হিসেবে বাড়ল গাইড পাতেং বম। তাদের থানচি নিয়ে আসা চান্দের গাড়ির ড্রাইভার বলেছিল, এই এলাকা বমরাই সবচেয়ে ভাল চেনে, তাই তাকে সঙ্গে নেয়া।
সিহাব দলের সবার ওপর বিরক্ত। বড় মদক পর্যন্ত ঠিক আছে কিন্তু আন্ধারমানিক কেন যেতে হচ্ছে? আন্ধারমানিকে এমন কী আছে। যা মদকে নেই?
গাইড পাতেং বম ভাঙ্গা কথায় কথায় বাংলায় বলেছিল আন্ধারমানিক নামক এই জঙ্গলে কেউ যায় না। আর সঙ্গে সঙ্গে জিতুর মাথায় চেপে গেল ঐখানে যেতেই হবে।
কারণ হিসেবে অবশ্য সে অনেকগুলাে যুক্তি দিয়েছে যার কোনােটাই ফেলনা না। প্রথমত এখানে আর কবে আসা হবে তার ঠিক নেই, দ্বিতীয়ত সাঙ্গু নদীর উৎপত্তি এই আন্ধারমানিকের ভেতর থেকে।
এরচেয়ে বড় যুক্তি হল সাঙ্গু নদী বাংলাদেশের একমাত্র নদী যেটার উৎপত্তিস্থল দেশের ভেতরেই।
জিতুর সঙ্গে যুক্তিতে সে জীবনে পারেনি পারবেও না। কিন্তু নাবিলা কিভাবে ওর কথায় বিনাবাক্যে রাজি হয়ে গেল। এটাই এখনাে ওর মাথায় ঢুকছে না।
সিহাব অনেক তর্ক করেও ফল না হওয়ায় সেও চলেছে আন্ধারমানিক, তবে বলতে বাধা নেই যত ভেতরে ঢুকছে ততই সে অবাক হচ্ছে।
নীলগিরি থেকে থানচি আসতে মনে হয়েছিল এটাই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জায়গা, আবার থানচি থেকে রেমাক্রিতেও তাই মনে হয়েছিল, তবে বড় মদক থেকে আন্ধারমানিক আসতে আগের সব কিছুকে তুচ্ছ মনে হচ্ছে।
এমন নৈসর্গিক দৃশ্য আগে শুধু সে বাইরের দেশের মুভিতে বা ফটোগ্রাফিতে দেখেছে। বাস্তবে এই প্রথম সে নিজের চোখে দেখল।
ভাগ্যিস এই সেমিস্টার ব্রেকে মত পাল্টে জিতুর সঙ্গে এসেছিল না হলে এমন দৃশ্য দেখার সুযােগ সে কবে পেত কে জানে?
জিতুর উপর অযথা কষ্ট করে আন্ধারমানিক যাবার জন্য যে রাগ উঠেছিল সেটা এমন সুন্দর জায়গা দেখাবার জন্য মন থেকে মাফ করে দিল।
তবে সেটা জিতুকে বুঝতে না দিয়ে বেশ একটা রাগ রাগ ভাব নিয়ে থাকল।
কিছুক্ষণ পরে একটা ছােট্ট সরু খালের মতাে জায়গায় নৌকা চলতে শুরু করল। যার দুপাশে খাড়া পাহাড়। এখানে সাঙ্গুর পানিতে আর আগের মতাে স্রোত নেই বরং পানি অনেক স্থির আর সবুজাভ স্বচ্ছ হয়ে গেছে।
এই খালের মতাে নদীর দুধারের পাহাড়ে ঝরনার সংখ্যা অনেক বেশি, আর হরহামেসায় নদীর ধারে গাছের শেকড় উপড়ে মৃতগাছ উল্টে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
উপড়ানাে গাছ দেখতে বেশ অদ্ভুত লাগে, কোনাে গাছ হয়ত পাহাড় ধসে আবার কোনােটা হয়ত ঝড়ের কারণে উল্টে গেছে, তবে এই বিজন বনে ব্যাপারটার ভেতর যুক্তির চেয়ে গা ছমছমে ব্যাপারটাই বেশি কাজ করে, তার ওপরে দিন দুপুরে ঝিঝির ডাক এর উপর কয়েক পরত রং চড়িয়ে দিয়েছে।
প্রবল ঝিঝির ডাক, কিছু হুটহাট পাখির ডাক ছাড়া বনে তেমন কোনাে শব্দ নেই। থানচি থেকে রওনা দেবার সময় অনেক নৌকা তাদের আশপাশে যাওয়া আসা করেছে।
কিন্তু রেমাক্রির পর থেকে আশপাশের নৌকার সংখ্যা কমতে কমতে বড় মদকের পর সেটা শূন্য হয়ে গেছে। এখন তাদের নৌকার ইঞ্জিনের ভটভট শব্দ ছাড়া পুরাে বনের সব জায়গা এক রহস্যময় কারণে হঠাৎ সুনসান হয়ে আছে।
একটা জায়গায় এসে মাঝি নৌকার ইঞ্জিনটাকে থামিয়ে দিয়ে লগি ঠেলে এগােতে শুরু করল, চাকমা মাঝি জানাল এখানে পানির গভীরতা ৪০ হাতের মতাে হবে।
মাঝির লগির ছপছপ আওয়াজ শুনতে শুনতে জিতুরা খেয়াল করল খালটা সরু হয়ে এসেছে। খালের দুপাশে গাছের পাতা নুয়ে পড়েছে। আর
কিছুদূর এগােতেই নৌকা যাবার রাস্তা আর পাওয়া গেল না।
কারণ সামনে খালের মতাে জায়গাটাতে মাঝারি সাইজের পাথরের কুচি দিয়ে বন্ধ হয়ে আছে যার উপর দিয়ে নৌকা যাওয়া অসম্ভব। এই পাথরের ফাঁক দিয়ে চিকন একটা পানির নালা বের হয়ে মূল খালের মতাে সাঙ্গু নদীতে এসে পৌঁছেছে।
এটাই নৌকা পৌছানাের মতাে সাঙ্গুর শেষ সীমানা।
গাইড পতেং বম জানাল সামনের জঙ্গলটা হেঁটে পার হবার পরের অঞ্চলটাই আসল আন্ধারমানিক, যেখানে আসলে কেউ ফিরে যায় না এবং তারা এই থিম মাং (অন্ধকার বন) এর ভেতর যাবেও না।
এখান থেকেই সবাইকে ফিরে যেতে হবে। নৌকার চাকমা মাঝিও বলল, সেও এই বনের ভেতর যাবে না, বংশগতভাবেই তাদের এই বনের ভেতর যাওয়া নিষেধ।
সিহাব দেখল জিতুর চোখ চকচক করছে। সিহাব ভাল করে জানে যেসব জায়গায় কেউ যেতে চায় না বা যেতে, ছােটবেলা থেকেই জিতু সেসব জায়গায় যেতে সবার আগে প্রস্তুত হয়ে যায়।
তাই জিতুকে কিছু বলবার আগেই সে বলল, ‘হা ভেতরে বিপদ-আপদ থাকতে পারে। চল ফিরে যাই?
জিতু সিহাবের কথার উত্তরে কিছু বলবার আগেই নাবিলা মুখ খুলল, ‘এতদূর এসে চলে যাব এটা সম্ভব না। ফিরতে হলে তাে বড় মদক থেকেই চলে যেতাম।
‘গাইডরা কেউ ভেতরে যেতে চাচ্ছে না। যদি পথ হারায় ফিরব কি করে?
নাবিলা কিছু বলতে গেলে জিতু তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “শােন আমরা বাচ্চা না যে, হারিয়ে যাব। তাছাড়া বেশি ভেতরে যাব না। অন্তত ফিরে যেয়ে সবাইকে বলতে পারব আন্ধারমানিক গেছিলাম যেখানে কেউ যায় না, পুরাে আনএক্সপ্লোরড এরিয়া।
তাছাড়া গাইডদের না হয় জঙ্গলে ঢােকায় নিষেধ আছে, আমাদের তাে আর সেটা নেই?
‘তা নেই, তবু?
‘কিন্তু যদি এগুলাে ছাড়, আগে বাড়। জিতু কথা শেষ করে লাফ দিয়ে নদীর পাড়ে নেমে গেল। তার দেখা দেখি নাবিলাও।
গাইড বাধা দিতে গেলে জিতু তাদের বলল একটু ভেতরে দিকে ঘুরেই চলে আসবে।
গাইডরা বার বার না না করা সত্বেও জিতু ভেতরে ঢুকে গেল, নাবিলা তাকে অন্ধ বিশ্বাসে অনুসরণ করল দেখে সিহাব নিজেকে একটা গালি দিয়ে লাফ দিয়ে, নৌকা থেকে নেমে সেও তাদের অনুসরণ করতে শুরু করল।
সিহাব জঙ্গলের আড়ালে চলে যাবার আগে পেছন ফিরে দেখল নৌকার মাঝি আর গাইডরা অবাক হয়ে তাদের অবাধ্য দলটার দিকে তাকিয়ে আছে।
সিদ্দিক আহমেদ একজন সৃজনশীল থ্রিলার লেখক। তার অন্যান্য প্রকাশনাগুলো পড়তে ভিজিট করুন বই নিবো পিডিএফ রিভিউজ।