স্বার্থান্ধ ও অন্যায় ভাবনার মাধ্যমে দুর্বল ও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। সঠিক ভাবনার মাধ্যমে অর্জিত বিজয়কে সতর্কতার সাথে ধরে রাখতে হয়। অনেকে নিশ্চিত বিজয়ের পর পুনরায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ব্যবসা, মেধা বা আত্মিক সব ধরনের সফলতা সুনিশ্চিত ভাবনার ফল আর একই নিয়মে একই প্রক্রিয়ায় অর্জিত হয়; কেল বিষয় বস্তুর মধ্যে একমাত্র পার্থক্য নিহিত থাকে। যে অল্প পরিমাণে অর্জন করে, সে সামান্য ত্যাগ করে যে অধিক অর্জন করে সে অধিক উৎসর্গ করে; আর যে সর্বোচ্চ। পায়, সে বিপুল পরিমাণ ত্যাগ করে।
স্বপ্নবিলাসী মানুষ হল জগতের পরিত্রাতা। দৃশ্যমান পৃথিবী যেহেতু অদৃশ্যতায় মােড়ানাে থাকে, মানুষ তার চমৎকার কল্পনাশক্তির মাধ্যমে সমস্ত পাপ, পূণ্য ও অদেখা জগতকে চিত্রায়ন করে। মানবসভ্যতা তার স্বপ্নদ্রষ্টাকে কখনও ভূলে না, তার আদর্শকে ম্লান হতে দেয় না। সে স্বপ্নের মধ্যেই বেঁচে থাকে, এর মধ্যেই ভবিষ্যত দেখে। সুরকার, ভাস্কর, শিল্পী, কবি, নবী, সাধক এরা সকলে পরলােকের স্রষ্টা, স্বর্গের নির্মাতা। তাদের কারণেই পৃথিবী সুন্দর, তারা না থাকলে মানবসভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে যেত।
যে ব্যক্তি জেমস এলেন পড়ে, সুন্দর কল্পনা লালন করে, হৃদয়ে কোন আদর্শ পােষণ করে, সে একদিন সেটা বাস্তবায়িত করে, কলম্বাস আরেকটি বিশ্বের স্বপ্ন দেখতেন, তিনি সেটা আবিস্কার করেছেন। কোপার্নিকাস একাধিক বিশ্ব ও বিস্তৃত ব্রহ্মাণ্ডের কল্পনা করেছেন আর তিনি তা প্রকাশ করেছেন। বুদ্ধ নিষ্কলুষ সৌন্দর্য ও অপার শাস্তির একটি আত্মিক জগতের কল্পনা করতেন আর তিনি তাতে প্রবেশ করেছেন।
কল্পনাকে লালন করুন, আদর্শকে লালন করুন; হৃদয়ে যে সঙ্গীত বাজে, তাকে লালন করুন, মনে যে সৌন্দর্য আকার নেয়, তাকে যত্নে সাজান। আপনার নির্মল ভাবনায় যে কমনীয়তা জন্ম নেয়, একদিন তা বাস্তবে রূপ নেয়, যদি আপনি আস্থাশীল হন, আপনার পৃথিবী একদিন গড়ে উঠবেই। আকাঙক্ষাই হল অর্জনের পূর্বশর্ত। মানুষের মূল ইচ্ছাশক্তি পরিপূর্ণতা পায় আর উচ্চাকাক্ষা মুখ থুবড়ে পড়ে, এমন কি
হয়? ওটা নিয়মের আওতায় পড়ে নাঃ এ ধরনের পরিস্থিতি কখনও লাভ করা যায় না যে
“বললাম আর হয়ে গেল।”
উচ্চতর স্বপ্ন দেখুন, যেমন স্বপ্ন দেখবেন, আপনি তেমনই হবেন, একদিন আপনি যা হবেন, তার প্রতিজ্ঞাই হল আপনার কল্পনা। আপনি শেষ পর্যন্ত যা করতে পারবেন, তার ভবিষ্যদ্বাণী হল আপনার আদর্শ। যেকোন বড় অর্জনই সর্বপ্রথমে ও কিছু সময়ের জন্য স্বপ্ন হিসেবে থাকে। বৃক্ষ শস্যকণায় ঘুমিয়ে থাকে, পাখি ডিমের মধ্যে অপেক্ষা করে আর আত্মার সর্বোচ্চ কল্পনায় জন্ম নেয় একজন দেবদূত। স্বপ্ন হল বাস্তবতার বীজ।
পরিস্থিতি আপনার প্রতিকূলে থাকতে পারে, তবে আপনি কোন আদর্শের আদলে যদি লড়তে থাকেন, তাকে অতিক্রম করা যাবে। আপনি এর মধ্যে ৰা একে ছাড়া চলতে পারবেন না। এক তরুণ দাদ্রি ও শ্রমের চাপে নিষ্পেষিত হচ্ছিল। অস্বাস্থ্যকর ওয়ার্কশপে তাকে দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে হত। স্কুলে যাওয়া ও অন্যান্য সকল সুযােগ থেকে বঞ্চিত ছিল। কিন্তু সে ভালাে কিছুর স্বপ্ন দেখত।
সে বুদ্ধি, নির্মলতা ও সৌন্দর্যের কথা চিন্তা করত । মনে মনে জীবনের একটি আদর্শ পরিস্থিতি ও ব্যাপক স্বাধীনতার কথা ভাবত। এক বৃহত্তর সুযােগ তাকে দখল করে নিল, ক্রমাগত কাজ করার তাগিদ দিল আর সে তার বাড়তি সময় ও শ্রম সুপ্ত প্রতিভা ও ক্ষমতার উন্নয়নে ব্যবহার করল। এত দ্রুত তার মন বদলে গেল যে সে ভাবল এই ওয়ার্কশপ তাকে ধরে রাখতে পারবে না। এই কাজের সাথে তার মানসিক সংযােগ এমনভাবে বিচ্ছিন্ন হল যেন শরীরের পােষাক খসে পড়ে গেল। আর সে বৃহত্তর সুযােগের সাথে শক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে এগিয়ে গেল সামনে।
কয়েক বছর পর এই তরুণ পরিণত হয়ে উঠল। মানসিক শক্তির এমন এক কারিগর হয়ে উঠল সে সারা বিশ্বে যার প্রভাব স্থান দখল করল। তার হাতে তখন বিশাল দায়িত্ব। সে বলে আর জীবন বদলে যায়। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই তার কথা শুনে, নিজেদের চরিত্র পুনঃনির্মাণ করে। সূর্যের মতই সে স্থির ও উজ্জল কেন্দ্রে পরিণত হয় যার চারপাশে অসংখ্য মানুষ ঘুরতে থাকে। সে তার তারুণ্যের কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। সে তার আদর্শের মত হয়ে উঠেছে।
আর আপনি, তরুণ পাঠক, হৃদয়ের কল্পনাকে (অলস ভাবনা নয়) বুঝে নিন, কারণ আপনি যা গােপনে ভালােবাসেন, তার প্রতি আকৃষ্ট হবেন। নিজের ভাবনার ফলাফল আপনার হাতেই।
আপনি বইটি পড়ে যা অর্জন করেছেন, তাই আপনি পাবেন, বেশিও নয়, কমও নয়। আপনার বর্তমান পরিবেশ যেমনই হােক না কেন, আপনার ভাবনা, কল্পনা ও আদর্শের সাথে আপনি পতিত হবেন, টিকে থাকবেন বা উথিত হবেন। স্ট্যানটন কিরখম ডেডিস যেমন তার চমৎকার বাক্যে বলেছেন যে নিয়ন্ত্রিত আকাক্ষার মতই ছােট ও সুপ্ত উচ্চাকাক্সক্ষার মতই বড় হওয়ার কথাঃ “যে দরজাকে এক সময় সীমানা মনে হতাে, তাকে পার হয়ে আপনি বেরিয়ে যান, দেখবেন সামনে বিস্তৃত পথ- কলম এখনও কাগজের উপর, আঙ্গুল বেয়ে কালি পড়ছে আর আপনার আকাক্সক্ষা আপনাকে তাড়া দিচ্ছে।
আপনি হয়ত ভেড়ার পাল নিয়ে যাচ্ছেন, নগর তােরণ ও খােলা প্রান্তর পেরিয়ে যান, দেখবেন স্পৃহা আপনাকে পরিচালনা করছে। খানিক পর সে। বলবে, “তােমাকে শেখানাের আমার কাছে আর কিছু নেই।” এখন আপনি অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন, ভেড়া তাড়ানাের সময় যিনি বড় স্বপ্ন দেখতেন।
পরবর্তী প্রজনের দায়িত্ব এখন আপনার কাঁধে। চিত্তামত, অজ ও অলস ব্যক্তি যেকোন ঘটনার বাহ্যিক প্রতিক্রিয়া দেখে নিজেদের ক্রটি দেখেনা, কেবল ভাগ্য ও সুযােগের কথা বলে। কাউকে ধনী হতে দেখলে তারা বলে, তার কি ভাগ্য!" অন্য কাউকে প্রতিভাবান হয়ে উঠতে দেখলে তারা বলে, “সে কত সুযােগ পেয়েছে?” কারাে পুত:চরিত্র ও অন্যান্যদের উপর প্রভাব দেখলে মন্তব্য করে, “প্রতিটি ক্ষেত্রে সে কত সাহায্য পেয়েছে।
তারা সেই চেষ্টা, ব্যর্থতা ও সংগ্রাম কখনও দেখতে পায়, লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে এই মানুষগুলো যেগুলাের মুখােমুখি হয়েছে। সেই ত্যাগ, চেষ্টা ও বিশ্বাস সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাই নেই। যেগুলাে অতিক্রম করে তারা হৃদয়ের কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। তারা সেই অন্ধকার ও যন্ত্রণাকে দেখতে পায় না, দেখে শুধু আলাে ও আনন্দ আর 'ভাগ্য' হিসেবে বিবেচনা করে।
তারা সেই দীর্থ ও কষ্টকর যাত্রা দেখতে পায় না। দেখে কেবল আনন্দদায়ক গন্তব্য আর সৌভাগ্য' বলে ডাকে। তারা প্রক্রিয়া বুঝে না, বুঝে শুধু ফল আর নাম দেয় সুযােগ। মানুষের সকল কাজে চেষ্টা ও ফল থাকে আর চেষ্টার শক্তি হল ফলের মাপকাঠি। সুযােগ বলে কিছু নেই। আশীর্বাদ, ক্ষমতা, বস্তু, বুদ্ধি ও আত্মিক সম্পদ হল চেষ্টার ফল; এগুলাে ভাবনার পরিপূর্ণতা, কর্মের সম্পদন, কল্পনার বাস্তবায়ন।
যে কল্পনাকে মনে জায়গা দিয়েছেন, যে আদর্শকে হৃদয়ে স্থাপন করেছেন, সেগুলাের মাধ্যমে আপনি জীবন গড়ে তুলবেন, আপনি নিজেকে নির্মাণ করবেন।
মনের প্রশান্তি হল জ্ঞানের একটি সুন্দর সম্পদ। এটি হল আত্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ ও সহিষ্ণু চেষ্টার ফল। এর উপস্থিতি ব্যাপক অভিজ্ঞতার এক নিদর্শন এবং নিয়ম ও ভাবনার সাধারণ জ্ঞানের চেয়ে বেশি অর্থবহ। একজন মানুষ শান্ত হওয়া মানে হল যে বুয়ে সে মানুষ চিন্তাশীল প্রাণী, কারণ এই ধরনের জ্ঞান অন্যদের ভাবনার ফলাফলকে বুঝতে পারে। আর যখন সে ঠিকভাবে বুঝে, সে কারণ ও ফলাফলের প্রকৃত সম্পর্ক অনেক পরিস্কারভাবে দেখতে পায়, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ভয় ও কষ্ট থেকে বিরত রাখে এবং স্থির নিশ্চল ও শান্ত থাকে।
শান্ত মানুষ জানে যে নিজেকে কিভাবে পরিচালনা করতে হয়, ও অন্যদের সাথে কিভাবে খাপ খাওয়াতে হয় আর পালাক্রম তারা নিজেদের শক্তি ও অনুভূতি দিয়ে অন্যদের বুঝায় যে তারা । তার কাছ থেকে শিখতে পারে, তার উপর নির্ভর করতে পারে। মানুষ যত বেশি শান্ত হবে, তার অর্জন প্রভাব ও কল্যাণের ক্ষমতা তত বাড়বে।
এমনকি একজন সাধারণ ব্যবসায়ী পড়ে যত বেশি আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ও প্রশান্তির উন্নয়ন ঘটাবে, তার ব্যবসা বৃদ্ধি পাবে, কারণ মানুষ সেরকম শান্ত মেজাজের মানুষের সাথে কাজ করতে পছন্দ করে। শক্তিশালী, শান্ত মানুষ সব সময় ভালবাসা ও সম্মান পায়, সে হল শুষ্ক ভূমিতে ছায়া প্রদানকারী বৃক্ষ ৰা ঝড়ে আশ্রয়দাতা পাথরখন্ডের মত।
একটি শান্ত হৃদয়, মিষ্টি মেজাজ ও ভারসাম্য পূর্ণ জীবন কে না ভালােবাসে? বৃষ্টি হােক বা রােদ ও স্থির
যেমন পরিবর্তনই আসুক না কেন এরা সব সময় মিষ্টি, প্রশান্ত ও স্থির থাকে। চরিত্রের এই চরম রূপ, যাকে আমরা প্রশান্তি বলে ডাকি, এটি সংস্কৃতির সর্বশেষ শিক্ষা, হৃদয়ের ফসল । এটি জ্ঞানের চেয়েও দামী, স্বর্ণমুদ্রার চেয়েও বেশি আকাক্ষিত। একটি শান্ত জীবনের সাথে তুলনা করলে অর্থকে কত ক্ষুদ্র দেখায়- এমন একটি জীবন যেটা সত্যের সমুদ্রে বাস করে। ঢেউয়ের পিছনে থাকে, তুফান যাকে ছুঁতে পারে না, পার্থিব শান্তির জীবন!
আমরা জানি কত মানুষ তাদের উগ্র মেজাজের জন্য জীবনকে তিক্ত করে তােলে, যা কিছু মিষ্টি ও সুন্দর, তাকে ধ্বংস করে, চরিত্রের নির্মলতা হারায় ও রক্তকে দূষিত করে। আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাবে বেশিরভাগ মানুষ তাদের জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ও সুখ ব্যাহত করে। খুব কম মানুষ চমৎকার ভারসাম্য বজায় রাখে, যাদের চরিত্রে সেই নির্মল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। হ্যা, মানুষের জীবন অনিয়ন্ত্রিত আকাক্ষা, প্রচন্ড দুঃখ, উদ্বেগ ও সংশয়ে আবৃত।
কেবল বুদ্ধিমান মানুষ পড়ে যার ভাবনা নিয়ন্ত্রিত ও নির্মল, আত্মার বাতাস ও তুফানকে মানাতে পারে। ঝাবিক্ষুদ্ধ হৃদয় যেখানে যেমনই থাকুক না কেন, জানে যে জীবনের বিশাল সমুদ্রে আশীর্বাদের দ্বীপপুঞ্জ হাসছে আর আদর্শের সূর্যালােক তার অপেক্ষায় আছে। ভাবনার স্টিয়ারিংয়ে শক্তভাবে নিজের হাত রাখুন। হৃদয়ের ভােলপাড়ে কুশলী কারিগর অনেক সময় ঘুমিয়ে পড়ে, তাকে জাগান। আত্মনিয়ন্ত্রণ হল শক্তি, প্রকৃত চিন্তা হল কারিগরি, শান্তি হল ক্ষমতা, হদয়কে বলুন, “শান্তি স্থির হও।”
(১) মানুষকে জানতে হবে যে সে কোন বস্তুকে পরিচালনা করতে পারে না, তবে সে নিজেকে পরিচালনা করতে পারে, সে অন্যের ইচ্ছাকে বাধ্য করতে পারেনা, তবে নিজস্ব ইচ্ছাকে আকৃতি দিতে পারে ও পরিবর্তন করতে পারে। সে সত্যের সাথে থাকে, ঘটনা তার অনুকূলে ঘটে। যে নিজের ক্ষেত্রে বিজ্ঞ অন্যরা তার দিকনির্দেশনা চায় ।
(২) আক্ষরিক অর্থে মানুষ যা ভাৰে সে তাই।
(৩) একজন মানুষ সুখী, স্বাস্থ্যবান ও সমৃদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত যথার্থ পরিস্থিতিতে থাকে না আর সুখ, স্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধি হল মানুষের আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অবস্থার সম্মেলনের ফলাফল।
(৪) মানুষ কম সময়ে বা দেরিতে আবিষ্কার করে যে সে তার আবার একজন সুনিপুণ মালী, তার জীবনের পরিচালক।
(৫) সর্বোপরি একটি উদ্দেশ্যকে নির্দিষ্ট করুন; একটি বৈধ ও প্রয়ােজনীয় লক্ষ্য স্থির করুন, নিজেকে তার প্রতি নিবেদিত করুন।
(৬) জীবনে যা করতে পারলেন ও পারলেন না, তার সবটুকুই আপনার ভাবনার প্রত্যক্ষ ফলাফল।