লাল কেশবতী
| Book | Publisher | Author | F Size |
|---|---|---|---|
| লাল কেশবতী |
পেন্ডুলাম | ওরহান পামুক | ৭ মেগাবাইট |
| Bookshop | Price | Language | T Page |
| Durdin Magazine | Only 400 Taka | English | 176 |
লাল কেশবতী pdf শুরুর আগে ওরহান পামুক
লাল কেশবতী বইটি পড়া শুরু করার আগে আপনাদের প্রথমে ওরহান পামুক সম্পর্কে কিছু কথা জেনে নিতে হবে। ছােটোবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিলাে লেখক হবাে। অথচ ঘটনাক্রমে ভূতত্ত্ব প্রকৌশলে পড়াশােনা শেষে জড়িয়ে পড়লাম কস্ট্রাকশন বিজনেসে। সেই গল্পই আজ আপনাদের শােনাবাে। অবশ্য, এমনটা ভাববেন না যে, এরইমধ্যে গল্পটার পরিসমাপ্তি ঘটেছে বা এইসব ঘটনাপ্রবাহ থেকে আমি মুক্তি পেয়েছি। বরং যতবারই আমি এসব নিয়ে ভাবতে যাই, নিজেকে আবিষ্কার করি আরাে গভীর কোন অতলান্তিক জটিলতায়। আপনারাও হয়তাে পিতা পুত্রের প্রহেলিকাময় এই উপাখ্যানে প্রলুব্ধ হবেন।
লাল কেশবতী ওরহান পামুক
১৯৮৪ সালে বেশিকতাশের ইহলামাের প্রাসাদের নিকটে এক ছােটো এপার্টমেন্টে আমরা থাকতাম। আমার বাবার হায়াত, অর্থাৎ ‘জীবন’ নামে ছােটো একটা ফার্মেসি ছিলাে। সপ্তাহে একদিন এটা সারারাত খােলা থাকতাে আর বাবা রাতের শিফট পর্যন্ত কাজ করতেন। লম্বা, একহারা আর সুদর্শন শরীরের বাবা যখন ক্যাশবক্সের পেছনে বসে তার রাতের খাবার খেতেন, আমি বুক। ভরে ওষুধের গন্ধ নিতাম। ওখানে সময় কাটাতে আমার ভালাে লাগতাে। প্রায় ত্রিশ বছর কেটে গেছে, কিন্তু এই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সেও পুরনাে কাঠের ড্রয়ার আর কাপবাের্ডের সাথে ওইসব ওষুধের মিশ্র গন্ধ আমি ভালােবাসি।
ফার্মেসিতে সাধারণত তেমন ভিড় থাকতাে না। তখনকার সময়ে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠা পাের্টেবল টেলিভিশন সেটগুলাের একটার সাথে প্রায়ই পুরাে রাত কাটিয়ে দিতেন বাবা। মাঝেমধ্যে তার বামপন্থী বন্ধুরা আসতাে আর আমি তাদের নিচু স্বরে কথাবার্তা বলতে শুনতাম। তারা আমাকে দেখলেই আলােচনার বিষয়বস্তু পাল্টে ফেলতাে। বলতে শুরু করতাে—আমার বাবার মতন আমি কতটা সুদর্শন আর চমৎকার দেখতে। আমার বয়স কত, স্কুলে যেতে পছন্দ করি কি না, বা বড় হয়ে কী হতে চাই এসব জিজ্ঞেস করতাে।
আমি তার রাজনৈতিক বন্ধুদের সাথে কথা বলতে গেলে বাবা দৃশ্যতই অস্বস্তি বােধ করতেন। তাই তাদের অবস্থানকালে আমি খুব বেশিক্ষণ থাকতাম না। প্রথম সুযােগেই আমি তার খাবারের শূন্য বক্সটি নিয়ে প্লেইন গাছ আর ফ্যাকাসে স্ট্রিটলাইটের নিচ দিয়ে বাড়ির পথ ধরতাম। বাবার বামপন্থী বন্ধুদের কথা যে মাকে বলা যাবে না, এটা আমি বুঝে নিয়েছিলাম। এদের কথা শুনলে তিনি রেগে যাওয়ার পাশাপাশি উদ্বিগ্নও হতেন যে বাবা আবার কোনাে ঝামেলায় জড়াবেন আর উধাও হয়ে যাবেন।
তবে বাবা-মার মধ্যে কলহ যে কেবল রাজনীতি নিয়েই হতাে, তা নয়, প্রায়ই অনেক দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যেতাে, তারা একে অপরের সাথে একটা কথাও বলতেন না। সম্ভবত তারা একে অপরকে ভালােবাসতেন না। আমার সন্দেহ হতাে বাবা অন্য নারীদের প্রতি আসক্ত, তেমনি অনেক নারীও তার প্রতি মােহগ্রস্ত। মাঝেমধ্যে মা এত খােলাখুলিভাবে একজন রক্ষিতার কথা বলতেন। যে আমিও বুঝতে পারতাম। বাবা মার মধ্যে অশান্তিগুলাের স্মৃতি আমাকে এত বিপর্যস্ত করে দিতাে যে আমি চেষ্টা করতাম তাদের কথা ভুলে থাকতে।
শরতের এক সন্ধ্যায় আমি অন্য আর দশটা দিনের মতাে শেষবার বাবার ফার্মেসিতে খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম।
তখন আমি মাত্র হাইস্কুলে উঠেছি। আমি যখন ফার্মেসিতে যাই, বাবা তখন টেলিভিশন দেখছিলেন। বাবা কাউন্টারের পেছনে বসে খাচ্ছিলেন। আমি একজন ক্রেতাকে এসপিরিন দিলাম। অন্য একজন কিনলাে ভিটামিন সি ট্যাবলেট আর এন্টিবায়ােটিক। টাকাটা আমি পুরনাে ফ্যাশনের একটা ক্যাশবাক্সে রাখলাম, যার ড্রয়ারটা মিষ্টি টুংটাং শব্দে বন্ধ হতাে। উনার খাওয়া শেষ হলে, বাড়ি ফেরার সময় আমি শেষবারের মতাে বাবার দিকে ফিরে তাকালাম। তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে হেসে হাত নাড়লেন আমার দিকে।
তার পরদিন সকালে তিনি আর বাড়ি ফেরেননি। বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পর আমি মায়ের কাছে বাবার নিরুদ্দেশ হওয়ার সংবাদ জানতে পারি। তার চোখ তখনও কান্নাকাটির জন্য ফুলে আছে। আমার বাবাকে কি পলিটিক্যাল এফেয়ার্স ব্যুরাের লােকেরা তুলে নিয়ে গেছে? সেখানে সম্ভবত তার পায়ের তলায় বেত মারা হচ্ছে, কিংবা ইলেক্ট্রিক শক। এটাই তাে প্রথমবার নয়।
বেশ কয়েক বছর আগে, সেনা বিদ্রোহের পর রাতের বেলায় সৈন্যরা প্রথম তার খোঁজে এসেছিলাে। মা তখন উন্মাদিনীর মতাে হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলতেন যে আমার বাবা একজন হিরাে, আমার তাকে নিয়ে গর্ব করা উচিত।
আর ছাড়া পাওয়ার আগ পর্যন্ত কর্মচারী মাচিতের সাথে তিনিই রাতের শিফটে কাজ করতেন। মাঝেমধ্যেই আমি মাচিতের সাদা কোটটা পরতাম—যেহেতু ওই সময় বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী আমিও বড় হয়ে একজন বিজ্ঞানী হতে চাইতাম, কোনাে ফার্মাসিস্টের এসিস্ট্যান্ট না। | সাত আট বছর পর আবার যখন বাবা নিরুদ্দেশ হলেন, তখন কিন্তু ঘটনা ভিন্ন হলাে। প্রায় দু’বছর পর বাবা ফিরে এলে দেখা গেলাে যেন তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া, জিজ্ঞাসাবাদ বা টর্চারে মায়ের কিছুই যায় আসেনি। তিনি বলতেন—ওর সাথে এর চেয়ে ভালাে আর কী হবে?
Red Haired Women by Orhan Pamuk
বাবার চূড়ান্ত নিরুদ্দেশের সময়ও তাই ঘটলাে। মনে হলাে মা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। মাচিতের কথা জিজ্ঞেস করলেন না, কিংবা ফার্মেসির কী হবে সেটা নিয়েও কিছু ভাবতেন না। এতেই আমার মনে হলাে, বাবা সবসময় একই কারণে নিরুদ্দেশ হতেন না। | ওইসময় আমি এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, ভাবনা আমাদের কাছে আসে শব্দ হয়ে, মাঝেমধ্যে দৃশ্য রূপে।
এমন কিছু ভাবনা আছে, যেমন তুমুল বৃষ্টির মধ্য দিয়ে দৌড়ে যাওয়া—যেটাকে আমি কোনাে শব্দ দিয়েই প্রকাশ করতে পারবাে না... কিন্তু ওই দৃশ্যটা আমি স্পষ্ট কল্পনা করতে পারছি। আবার এমন কিছু ব্যাপার আছে যাকে আমরা শব্দে প্রকাশ করতে পারি, তবে কল্পনা করা একেবারেই অসম্ভব—অন্ধকারাচ্ছন্ন আলাে, আমার মায়ের মৃত্যু, অসীমত্ব । | সম্ভবত আমি তখনাে শিশুই ছিলাম। তাই চাইলেই অযাচিত চিন্তাভাবনা দূরে সরিয়ে রাখতে পারতাম। কিন্তু মাঝেমধ্যে ব্যাপারটা হতাে অন্যরকম। আমি নিজেকে কোনাে একটা শব্দ বা দৃশ্যে আবিষ্কার করতাম, যা মাথা থেকে তাড়াতেই পারতাম না।
বাবা আমাদের সাথে দীর্ঘদিন যােগাযােগ রাখেননি। মাঝে মাঝে এমন হতাে, আমি মনেই করতে পারতাম না তিনি দেখতে কেমন ছিলেন। মনে হতাে যেন সব আলাে মুছে গেছে আর আমার আশেপাশের সব কিছু হারিয়ে গেছে। একরাতে ইহলামাের প্রাসাদের পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। হায়াত ফার্মেসিটায় বিশাল কালাে একটা তালা ঝুলানাে। যেন চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। প্রাসাদের বাগান থেকে ঘন কুয়াশা দলা পাকিয়ে উঠছিলাে।
কিছুকাল পর মা বললেন, বাবার রেখে যাওয়া টাকা বা ফার্মেসি, কোনােটাই আমাদের জীবিকার জন্য যথেষ্ট নয়।
মুভি টিকিট, কাবাব, স্যান্ডউইচ ও কমিকবুক ছাড়া আমার আর বাড়তি
কোনাে খরচ ছিলাে না। কাবাতাস হাইস্কুলে আমি হেঁটেই আসা যাওয়া করতাম। আমার অনেক বন্ধু ছিলাে যারা কমিক বই বিক্রি বা ধার দেওয়ার ব্যবসা করতাে। কিন্তু ছুটির দিনগুলাে আমি তাদের মতাে বেশিকতাশ সিনেমাহলের পেছনের দরজায় বা রাস্তায় ধৈর্য্য ধরে কাস্টমারের জন্য বসে থেকে নষ্ট করতে চাইতাম না।
বেশিকতাশ বাজারের মূল সড়কের পাশে দেনিজ বুকস্টোরে কাজ করে আমি ১৯৮৫ সালের গ্রীষ্মটা কাটালাম। মূলত আমার কাজ ছিলাে সম্ভাব্য বই চোরদের উপর নজর রাখা, যাদের বেশিরভাগই ছাত্র। প্রায়ই মি.দেনিজ আমাকে ক্যাটালগ অনুযায়ী স্টকের বইগুলােকে নতুনভাবে সাজাতে লাগিয়ে দিতেন। মালিক আমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছিলেন। তিনি খেয়াল করেছিলেন আমি কীভাবে সব লেখক আর প্রকাশকের নাম মনে রাখতে পারি। সুতরাং আমাকে অনুমতি দিয়েছিলেন পড়ার জন্য বাড়িতে বই নিয়ে যাওয়ার। ওই গ্রীষ্মে আমি প্রচুর পড়েছি; বাচ্চাদের বই, জুল ভার্নের জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দ্য আর্থ, এডগার এলান পাে’র গল্প, কবিতার বই, অটোমান যােদ্ধাদের নিয়ে ঐতিহাসিক উপন্যাস, আর স্বপ্ন সম্পর্কিত একটা বই। শেষের বইটার একটা অনুচ্ছেদ আমার জীবনকে চিরতরে পাল্টে দিয়েছিলাে।
মি.দেনিজের বন্ধুরা যখন দোকানে আসতেন, তিনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন এক উদীয়মান লেখক হিসেবে। ততদিনে আমি আসলে এই স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছি আর বােকার মতাে শুরুতেই তা উনাকে জানিয়ে দিয়েছি। তার প্রভাবে দ্রুতই আমি এই স্বপ্নটাকে গুরুত্ব দিয়ে ফেলি।
একদিন স্কুল থেকে ফিরে বাবা-মার ঘরে ঢুকে আবিষ্কার করলাম বাবার শার্ট আর প্রয়ােজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্র উধাও হয়ে গেছে। বাতাসে তখনাে তার ব্যবহৃত তামাক আর কোলনের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিলাে। মা আর আমি এরপর কখনাে বাবার বিষয়ে কথা বলিনি। আমার মন থেকে তার ছবি ততদিনে মুছে গিয়েছে।
মা আর আমি খুব দ্রুত বন্ধু হয়ে যাচ্ছিলাম। যদিও আমার লেখক হতে চাওয়ার স্বপ্নটা নিয়ে তার মজা করাতে আমি কখনাে বাধা দিইনি। ভালাে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারটা আমাকে নিশ্চিত করতে হতাে। এন্ট্রান্স পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়ােজন ছিলাে, কিন্তু বই বিক্রেতা আমাকে যে বেতন দিতেন তাতে মা সন্তুষ্ট ছিলাে না।
ঐ গ্রীষ্মের শেষে, হাইস্কুলে দ্বিতীয় বর্ষ সমাপ্ত করে আমরা ইস্তানবুল থেকে গিবজে চলে আসি। গিবজে আমরা আমার খালা আর খালুর বাগানের বর্ধিত অংশে নির্মিত অতিথিশালায় থাকতাম। খালু আমাকে একটা কাজ দিতে চাইছিলেন। আমি হিসেব করে দেখলাম যে, যদি গ্রীষ্মের প্রথম অর্ধেকটা সময় আমি এটা করে কাটাই, জুলাইয়ের শেষ দিকেই বেসিকতাসে ফিরে গিয়ে স্কুলে উপস্থিতির পাশাপাশি দেনিজ বুকস্টোরে আবার কাজ শুরু করতে পারবাে।
মি.দেনিজ জানতেন, বেসিকতাস ছেড়ে আসতে আমার কী ভীষণ কষ্ট হয়েছিলাে। তিনি বলেছিলেন, চাইলে আমি যে কোনাে সময় বইয়ের দোকানটায় রাত কাটাতে পারব। | খালু আমাকে গিবজের বাইরে তার পিচ আর চেরির বাগান পাহারা দেওয়ার কাজে পাঠালেন। আমার কাজ করার জায়গা ছিলাে একটা চাতালের নিচে পাথুরে টেবিলে। প্রথম দেখে ভেবেছিলাম ওখানে বসে পড়াশােনা করার প্রচুর সুযােগ পাবাে।
তবে ধারণাটা ভুল ছিলাে। চেরির সময় দুঃসাহসী কাকের দল ঝাঁক বেঁধে জোরালাে কা-কা রবে গাছের উপর উড়ে বেড়াত। আর আশেপাশের নির্মাণ শ্রমিক আর দূরন্ত বাচ্চারা প্রতিনিয়ত দল বেঁধে চুরির চেষ্টা করতাে। | বাগানের পাশেই একটা কুয়াে খোঁড়া হচ্ছিলাে। আমি মাঝেমধ্যে কুয়াে-খননকারী কীভাবে তার কোদাল আর গাঁইতি দিয়ে কাজ করে তা দেখতে যেতাম। দুইজন হেল্পার তাদের ওস্তাদের খনন করা মাটি উপরে সরিয়ে নিতাে।
দুই হেল্পার পুরােটা ভর্তি করে মাটি তােলার কারণে মৃদু কাচকোচ শব্দ করতে থাকা কাঠের চরকিতে লাগানাে হাতল দুটো বাকিয়ে ধরতাে। তারপর খোড়াতে খোঁড়াতে খুঁড়ে তােলা মাটিগুলাে। একটা ঠেলাগাড়িতে তুলে দিতাে। ঠেলাগাড়িটি খালি করে দেয়ার দায়িত্বে থাকা ছােটো ছেলেটা ছিলাে আমার বয়েসি। আর বড়, লম্বা শাগরেদটি ঝুড়িটি কুয়াের নিচে ওস্তাদের কাছে নামিয়ে দিতে দিতে চিৎকার করে বলতাে—আসছে।
দিনের বেলায় কুয়াে-খননকারী খুব কমই উপরে আসতাে। আমি যখন প্রথম তাকে দেখতে পেলাম, তখন সে মধ্যাহ্ন ভােজের বিরতিতে সিগারেট ধরিয়েছে। লােকটা ছিলাে আমার বাবার মতাে লম্বা, মেদহীন আর সুদর্শন। তবে বাবার মতাে শান্ত আর হাসিখুশি স্বভাবের বদলে সে ছিলাে বদমেজাজি। প্রায়ই তিনি নিজের সহকারীদের গালমন্দ করতেন। আমার সামনে তারা অপমানিত বােধ করতে পারে ভেবে সাধারণত ওস্তাদ উপরে থাকা অবস্থায় আমি কুয়াে থেকে দূরে থাকতাম।
জুনের মাঝামাঝি সময়ের একদিন তাদের দিক থেকে উল্লাসিত চিৎকার আর বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ শুনে আমি দেখতে গেলাম। কুয়াে থেকে পানি উঠছিলাে আর এই সুসংবাদ পেয়ে জমির মালিক খুশিতে আকাশের দিকে বন্দুক তুলে ফাঁকা আওয়াজ করছিলেন। বাতাসে বারুদের মিষ্টি গন্ধ। প্রথা অনুযায়ী, জমির মালিক কুয়ােখননকারী আর তার হেল্পারদের উপহার আর বখশিশ দিলেন। এই কুয়াের ফলে এখন তিনি নিজ জমির জন্য পূর্ব পরিকল্পিত অনেক ধরনের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে পারবেন। গিবজের পানির লাইন তখনাে শহরের বাইরে এসে পৌছায়নি।
এরপরে আমি আর কখনাে ওস্তাদজিকে তার হেল্পারদের গালমন্দ করতে শুনিনি। একদিন বিকেলে ঘােড়ায় টানা গাড়িতে করে সিমেন্টের বস্তা আর কিছু লােহার রড এসে পৌছালাে। কুয়ােখননকারী লােহার রড আর কংক্রিটের মাধ্যমে পানির লাইন টানতে লেগে গেলেন। শ্রমিকরা তখন বেশ হাসিখুশি থাকতাে, আমি তাদের সাথে অনেক বেশি সময় কাটাতে শুরু করলাম।
লাল কেশবতীর একদিন
একদিন আশেপাশে কেউ নেই ভেবে আমি কুয়াের বেশ কাছে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। পাম্পে বৈদ্যুতিক সংযােগ দেওয়ার জন্য একটি মােটর হাতে নিয়ে ওস্তাদ মাহমুদ চেরি আর জলপাই গাছগুলাের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন। | ‘এই কাজের ব্যাপারে তােমাকে খুব আগ্রহী মনে হচ্ছে, ছেলে!
লােকটিকে আমার মনে হচ্ছিলাে জুল ভার্নের উপন্যাসের চরিত্রের মতাে—যারা পৃথিবীর একদিক দিয়ে ফুড়ে অন্য দিক দিয়ে বেড়িয়ে এসেছিলাে।
‘কুজুকচেকমাজে শহরের বাইরে আমি আরেকটা কুয়াে খোড়ার কাজে যাচ্ছি। এই ছেলে দুটো কাজ ছেড়ে দিচ্ছে। এদের পরিবর্তে তােমাকে সাথে নেবাে নাকি?
আমাকে ইতস্তত করতে দেখে তিনি ব্যাখ্যা করলেন, যদি তিনি তার কাজটি ঠিকভাবে করতে পারেন, তাহলে কুয়াে-খননকারীর সহকারী এই চেরি বাগানের পাহারাদারের চার গুণ আয় করতে পারবে। দশ দিনের মধ্যে আমাদের কাজ শেষ হয়ে যাবে আর চাইলেই আমি বাড়ি যেতে পারবাে।
‘কক্ষনাে না, সেদিন বিকালে বাড়ি ফিরলে মা বললেন। “তুমি কুয়াে-খননকারী হবে না। তােমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে।'
কিন্তু ততক্ষণে দ্রুত উপার্জনের চিন্তা আমার মাথায় শেকড় গেড়ে বসেছে। মার কাছে ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকলাম যে দুইমাস খালুর বাগান পাহাড়া দিয়ে যা আয় করতে পারবাে, মাত্র দু’সপ্তাহেই তারচেয়ে বেশি আয় করা সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য এতে আমি অনেক বেশি সময় পাবাে, স্কুলে যেতে পারবাে আর যত বই পড়তে চাই, সব পড়তে পারবাে। এমনকি বেচারি মাকে হুমকিও দিয়েছিলাম—তুমি যদি যেতে না দাও, তাহলে আমি পালিয়ে যাবাে। | ‘ছেলে যদি গতর খাটিয়ে বেশি কামাই করতে চায়, তাকে বাধা দিও না, খালু বললেন। দেখি আমি খোঁজ নিয়ে, এই কুয়ােখননকারীটা কে।
আমার খালু পেশায় ছিলেন একজন আইনজীবী। তিনি তার অফিসে কুয়াে-খননকারীর সাথে মায়ের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলেন। আমার অনুপস্থিতিতে তারা ঠিক করলেন, দ্বিতীয় একজন সহকারী নেওয়া হবে যে কুয়াের ভেতরে নামবে, যাতে আমাকে নামতে না হয়। দৈনিক কত মজুরি পাবাে সেটা খালু আমাকে জানিয়ে দিলেন। আমি কিছু কাপড়চোপড় আর আমার শরীরচর্চার ক্লাসে পরা রাবার সােলের জুতাে জোড়া বাবার পুরনাে স্যুটকেসে ঢুকিয়ে নিলাম।
চলে যাবার দিন অঝােরে বৃষ্টি হচ্ছিলাে। যে পিকআপ ট্রাকটার আমাকে কাজের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কথা, মনে হচ্ছিলাে সেটা আর কখনাে এসে পৌছাবে না। এক রুমের ফুটোওয়ালা ছাদের ঘরটায় বসে যখন আমরা অপেক্ষা করছিলাম, মা বেশ কয়েকবার কেঁদে ফেললেন। আমি কি সিদ্ধান্ত পাল্টাবাে না? আমার জন্য তার খুব খারাপ লাগবে। আমরা গরিব সত্যি, কিন্তু তার জন্য এমন সিদ্ধান্তেরও দরকার ছিলাে না।
বিচারের সময় বাবা যেরকম পাথরের মতাে মুখ করে রাখতেন, স্যুটকেসটা তুলে নিয়ে ঠিক সেরকম মুখ করে, “চিন্তা করাে না। আমি কুয়াের ভেতরে নামবাে না,' বলে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম।
পিকআপটা ভগ্নপ্রায় পুরনাে মসজিদের পেছনে দাঁড়িয়ে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট আর মুখে হাসি নিয়ে একজন স্কুল শিক্ষকের মতাে ওস্তাদ মাহমুদ আমার হাঁটার ধরন, গায়ের কাপড়চোপড়, ব্যাগ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করছিলেন।
‘উঠে পড়, সময় হয়ে গেছে, তিনি বললেন। কুয়াের কাজটি যে ব্যবসায়ী দিয়েছিলেন, সেই হেইরি বে’র পাঠানাে ড্রাইভার আর ওস্তাদের মাঝখানে আমি বসে পড়লাম।
Read More: Paradise PDF
বসফরাস সেতু পার হবার পর আমি ইস্তানবুলের বামে অবস্থিত কাবাতাস হাইস্কুলের দিকে সােজাসুজি তাকালাম; যদি বেসিকতাসের কোনাে বিল্ডিং চিনতে পারি, এই আশায়।
‘চিন্তা করাে না, বেশি সময় লাগবে না, ওস্তাদ মাহমুদ বললেন, ‘স্কুল শুরু হওয়ার আগেই তুমি ফিরে আসতে পারবে।
ভালাে লাগলাে যে মা আর খালু ইতােমধ্যে আমার উদ্বেগের কথ টিা তাকে জানিয়ে দিয়েছেন; মনে হচ্ছিলাে আমি তার উপর ভরসা করতে পারি। সেতু পার হবার পর আমরা ইস্তানবুলের এত ভয়াবহ এক জ্যামে আটকে গেলাম যে তার থেকে মুক্তি পেয়ে যখন কেবল শহর ছেড়ে বের হলাম, ততক্ষণে কড়া রােদে আমাদের অন্ধ করে দিতে দিতে সূর্য পটে বসেছে।
অনুবাদক : মেহেদী হাসান
লেখক : ওরহান পামুক
লাল কেশবতী pdf





