প্যারাডাইস আব্দুল রাজক গুনরাহ PDF
| Book | Publisher | Author | F Size |
|---|---|---|---|
| প্যারাডাইস |
অন্বেষা প্রকাশন | আব্দুল রাজক গুরনাহ | ১২ মেগাবাইট |
| Bookshop | Price | Language | T Page |
| Durdin Magazine | Only 380 Taka | English | 176 |
প্যারাডাইস একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস, যেখানে আবদুলরাজাক গুনরাহ রচনা করেছেন তানজানিয়া শহরের এক যুবকের গল্প, যে ক্রীতদাস থেকে জোরপূর্বক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একজন সৈনিক হয়ে উঠে।
প্যারাডাইস Pdf
লেখক : আবদুলরাজাক গুনরাহ
অনুবাদক : মলয় পাঁড়ে
সূচিপত্র : প্যারাডাইস pdf
প্রাচীর ঘেরা উদ্যান
পাহাড়ি শহর
মধ্যাঞ্চল সফর
অগ্নিশিখার সিংহদ্বার
স্বপ্নের উদ্যান
জমাট রক্ত
প্রাচীর ঘেরা উদ্যানে প্যারাডাইস
ছেলেটিই প্রথম। নাম ইউসুফ। যখন বারাে বছর বয়স, হঠাৎই বাড়ি ছাড়ল। তার মনে আছে, সেটা খরার মৌসুম। দিনগুলাে বেজায় একঘেয়ে। অদ্ভুত ধরনের কিছু ফুল ফুটত, আবার ঝরে যেত। পাথরের নিচে উদ্ভট কিছু পােকা নড়াচড়া করত বটে কিন্তু প্রচণ্ড খরার তাপে কুঁকড়ে গিয়ে মরে যেত। প্রখর রােদে দূরের গাছপালাগুলাে হাওয়া লেগে কাঁপত। মনে হত যেন, বাড়িঘরগুলাে খরার তাপে শিউরে উঠছে। মাটিতে পা ফেললে ধুলাের মেঘ উড়ে উড়ে দিনের প্রহরগুলাের ওপর যেন নিবিড় নীরবতা লেপে দিত। কোনাে দিনকেই আলাদা করে চেনা যেত না, প্রতিটি দিনই যেন ছিল ঠিক আগের বছরের অবিকল নকল।
একদিন রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে দুই ইউরােপীয়কে দেখতে পেল ইউসুফ। এদের আগে কখনও দেখেনি। এই প্রথম দেখলেও ভয় লাগল না। রেল। স্টেশনে তার যাতায়াত ছিল, স্টেশনে যেত ট্রেন দেখতে। শােরগােল করতে করতে ট্রেনগুলাের স্টেশনে ঢােকা দেখতে খুব ভালাে লাগত। ট্রেনগুলাে ফের কখন বেরিয়ে যায়, তা দেখতে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করত স্টেশনে। রাগী রাগী চেহারার এক ইন্ডিয়ান সিগন্যালম্যান হাতের ফ্ল্যাগ উড়িয়ে আর হুইসল বাজিয়ে ট্রেনগুলাের ওপর খবরদারি করত। স্টেশনে ট্রেন আসা দেখতে অনেকসময় ঘণ্টার পর ঘণ্টাও দেরি করত ইউসুফ।
এ দুই ইউরােপিয়ান একটা শামিয়ানার নিচে জিনিসপত্র নিয়ে অপেক্ষা করছিল। কাছেই ঢিবি করে রাখা জিনিসপত্রগুলাে দেখে বােঝা যাচ্ছিল, সেগুলাে জরুরি। পুরুষ লােকটা বেশ লম্বা। মাথা নিচু করে রাখতে হচ্ছিল, যাতে শামিয়ানাতে ঠেকে না যায়। বাইরের প্রখর রােদ থেকে মাথা বাঁচাতে এই শামিয়ানার নিচে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া তাদের উপায়ও ছিল না।
প্যারাডাইস এখন পাহাড়ি শহরে
মহিলাটি দাঁড়িয়েছিল একই শামিয়ানার নিচে,কিছুটা পেছনে সরে। তার চকচকে মুখটি ঢাকা পড়েছিল দুজনের দুই হ্যাটের আড়ালে। তার ধবধবে সাদা ব্লাউজটি কোমর থেকে একেবারে ঘাড় অবধি বােতাম আঁটা। লং স্কার্টটি নেমে এসেছে জুতাে পর্যন্ত। মহিলাটিও বিশালদেহী। তবে ভিন্ন আকৃতির, মাংসপিত্রে মত লাগে। মনে হয় এত নরম, যেন সে ইচ্ছে করলেই নিজের আকৃতি পাল্টাতে পারে। অন্যদিকে পুরুষটিকে মনে হচ্ছিল যেন, একখণ্ড কাঠ খােদাই করে বানানাে। দুজনে দুদিকে তাকিয়েছিল, যেন কেউ কাউকে চেনে না। মহিলাটি রুমাল দিয়ে তার ঠোঁট মুছল, অভ্যাসমত ময়লা ঝেড়ে নিল ।
পুরুষটির মুখ লাল, তাতে ছােপ ছােপ দাগ। লােকটি ধীরে ধীরে বেষ্টনীঘেরা স্টেশনের ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে গেল। তালা লাগানাে গুদাম ঘরের একটি কাঠের দরজা ও তার পাশে উজ্জ্বল কালাে রাগী রাগী চেহারার পাখি আঁকা একটা ঢাউস পতাকা তার নজরে পড়ল । ইউসুফ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল লােকটাকে। লােকটাও দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখল, ইউসুফ লক্ষ্য করছে তাকে। তবু তার ওপর থেকে চোখ সরাতে পারল না। ইউসুফ। লােকটাকে বিপজ্জনকভাবে মুঠি পাকাতে দেখে সে উধ্বশ্বাসে ছুট দিল । আচমকা কোনাে বিপদে যে দোয়া পড়তে হয়, সেটা জানা ছিল। সেটাই বিড়বিড় করে আওড়াতে আওড়াতে ছুটতে লাগল সে।
যে বছর সে ঘর ছেড়েছিল, সে বছর তাদের ঘরের পেছনের বারান্দার খুঁটিগুলােতে ঘুণ পােকা লেগে দফারফা করে দিয়েছিল। ইউসুফের আব্বা যখনই সেই খুঁটিগুলাের পাশ দিয়ে যেত, তখনই সজোরে খুঁটিতে থাপ্পড় মারত। এভাবে সে তাঁর বিরক্তি প্রকাশ করে পােকাগুলােকে বােঝাতে চাইত, খুঁটির ভেতর থেকে সেগুলাে কোনাে পাঁয়তারা করছে, তা তার ভালােই জানা আছে! শুকিয়ে যাওয়া খালে নানা জীবজন্তু যেরকম গর্ত খোঁড়ে, ঘুণ পােকাগুলােও ঠিক তেমনি গর্ত বানিয়েছিল কড়িকাঠগুলােতে। ইউসুফ নিজেও দেখেছে, খুঁটিতে ঘা মারলে কেমন ফাঁপা আওয়াজ করত, সঙ্গে ধুলার মত কাঠের গুঁড়া উড়ত।
‘মা, বড় খিদে পেয়েছে। বছরের পর বছর ইউসুফের এই একই কথা। একঘেয়ে হয়ে গেছে। মা অতিষ্ঠ হয়ে বলত, ‘যা, ওই ঘুণ পােকা খা গিয়ে। তাের সাথে আর পারি না বাপু!' যতটা খিদে তার চেয়ে ইউসুফের ঢংটা ছিল বেশি। তাই হাসি পেলেও মা বিরক্তির ভান করে বলত, ‘পােকা খেলে নিজের খাবার নিজেই জোগাড় করতে পারিস, আমাকে বিরক্ত করার দরকার হয় না! বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলত ইউসুফ। বােঝাতে চাইত, তার মায়ের মশকরাটি তার জন্য কত মর্মান্তিক! তার মা পাতলা একরকমের সুপ বানানাের পর সেদ্ধ করা হাড়গুলাে মাঝে মাঝে খেতে পেত তারা।
প্যারাডাইসের মধ্যাঞ্চল সফর
হাড়গুলাের বাইরের দিকটা তেল চকচকে, ভেতরে সরু কালাে নরম মজ্জা। কিন্তু যতই খিদে পাক, কিছুতেই পাতলা সস খেতে ভালাে লাগত না ইউসুফের।
এসময় একদিন ইউসুফের এক চাচা, আজিজ এল তাদের দেখতে। সে আসত অনেকদিন বাদে বাদে, থাকত খুব কম সময়। আজিজ চাচার সঙ্গে সব সময় থাকত একদঙ্গল লােক। তাদের কেউ পথচারী, কেউ মুটে, কেউ গাইয়ে, কেউ বাজিয়ে। তার গন্তব্যেরও কোনাে ঠিকঠিকানা ছিল না। পাহাড় থেকে সাগর, হ্রদ থেকে বন, শুষ্ক সমতল থেকে প্রস্তরময় পাহাড় সবখানেই তার বিচরণ।
এসব অভিযানে প্রায়ই তার সঙ্গে থাকত ঢাক, শিঙ্গা, তাম্বুরি, শিউয়া (দুই মুখওয়ালা শিঙ্গা) ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। এই বিশাল বহর যখন কোনাে শহর দিয়ে যেত, শহরের যত পশু-পাখি পাগল হয়ে ছােটাছুটি করতে থাকত, ছােট ছেলে-মেয়েগুলােও বেসামাল হয়ে পড়ত। অদ্ভুত একটা সুগন্ধ বেরােত আজিজ চাচার শরীর থেকে। জানা-অজানা আতর, নানা সুগন্ধি, মসলাপাতি-সবকিছু মিলেমিশে একটা গন্ধ । তবে এর একটা অজানা গন্ধকে বিপদের আভাস বলে মনে হত ইউসুফের।
আজিজ চাচার স্বভাবসিদ্ধ পােশাক ছিল চমক্কার পাতলা কাপড়ে তৈরি কানজু (পূর্ব আফ্রিকার লােকদের ঐতিহ্যবাহী একরকমের কোট), মাথায় টুপি। কুরুশ দিয়ে বােনা টুপিটি থাকত মাথার পেছনদিকে । তার মার্জিত, নম্র ও ভদ্র ব্যবহার দেখে তাকে কখনওই কাঁটাওয়ালা ঝােপঝাড় বা বিষাক্ত সাপের গর্তের পাশ দিয়ে পথ বানিয়ে চলা ব্যবসায়ী মনে হত না। বরং মাগরিবের নামাজ আদায় করতে যাওয়া ধার্মিক মুসল্লির মত দেখাত তাকে। এমনকি সে কোথাও উপস্থিত হলে তাকে ঘিরে অন্যদের উত্তেজনা, সঙ্গী একদল লােকের হইচই, কুলি, মুটেদের হট্টগােল, বাজপাখির মত তীক্ষ্ণ নজর ও নখরওয়ালা ব্যবসায়ীদের মধ্যেও সে খুব শান্ত ও স্বাভাবিক থাকতে পারত ।
এবার আজিজ চাচা এল একেবারে একা।
সে এলে ইউসুফ খুব খুশি হত। ইউসুফের আব্লু বলেছিল, আজিজ ‘টাজিরি কুবওয়া'—মস্ত ব্যবসায়ী। সে যে তাদের বাড়িতে আসে, এটা নাকি তাদের জন্য সম্মানের। তবে সেজন্য নয়, বাড়িতে অতিথি আসাটা মর্যাদার। ইউসুফের খুশি হওয়ার আরও একটা কারণ ছিল। আজিজ চাচা এলে প্রতিবারই, চকচকে দশটি আনা তার হাতে দিত, কখনও ভুল হতাে না।
তার কাছে কোনাে দরকার না থাকলেও আজিজ চাচা এমন ভাব করত, যেন এক্কেবারে ঠিক সময়ে এসে পড়েছে। ইউসুফের দিকে মিষ্টি হেসে পয়সাগুলাে দিত তার হাতে। প্রত্যাশিত পয়সাগুলাে পেয়ে ইউসুফও একটা মিষ্টি হাসি দিত। পয়সা দেওয়া নেওয়া আর মিষ্টি হাসি বিনিময়ের এ ঘটনা যদিও প্রতিবার ঘটত কিন্তু ইউসুফের প্রতিবারই মনে হত, এবার হয়ত কোনাে কারণে ভুলে যাবে আজিজ চাচা।
প্যারাডাইস অগ্নিশিখার সিংহদ্বার
ভুলে যাবে আজিজ চাচা। আজিজ চাচার উজ্জ্বল গায়ের রঙ ও তার গায়ের বিচিত্র গন্ধটি মােহিত করে রাখত ইউসুফকে। এমনকি আজিজ চাচা চলে যাওয়ার পরও দিনকয়েক তার গন্ধটা যেন আচ্ছন্ন করে রাখত তাকে।
আজিজ চাচা আসার পর তিন দিন পেরিয়ে গেছে, তার মানে তার যাওয়ারও আর বেশি বাকি নেই। রান্নাঘরে ব্যস্ততাও বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক। নানা রকম সুস্বাদু খাবারের সুগন্ধ ভেসে আসত। মসলা ভাজার মিষ্টি গন্ধ, নারকেলের দুধ জ্বালানাে, মাংস রান্না, রুটি, বিস্কুট বানানাের সুগন্ধ সুড়সুড়ি দিত ইউসুফের নাকে। এসময় সে কখনও রান্নাঘর থেকে দূরে যেত না, যদি হঠাৎ মায়ের কোনাে দরকার পড়ে যায়! খাবারের থালা সাজাতে বলতে পারে, কোনাে ব্যাপারে তার পরামর্শ চাইতে পারে।
ইউসুফ জানে, এরকম সময় তার পরামর্শ আম্মুর জন্য কতটা জরুরি। কিংবা ধর, চুলাের ওপর খাবারটা নাড়তে ভুলে গেল বা গরম তেলে তরকারি দিতে মনে থাকল না! রান্নাঘরের এসব কাজ কি কম ঝামেলার! তাই সে এরকম সময় সারাক্ষণ রান্নাঘরের দিকে নজর রাখত। সে চাইত না, মা দেখুক যে সে তদারকিতে কোনাে আলসেমি করছে। তাহলে আম্মু নিশ্চয়ই আর কোনাে গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার দেবে না। এটা তার নিজের জন্যও যথেষ্ট খারাপ। তাতে আজিজ চাচাকে বিদায় জানানাের সুযােগটাও তার হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।
আজিজ চাচার বিদায়ের সময়টা ইউসুফের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সেই দশটি আনার হাত বদল হতাে ঠিক এসময় । বিদায়কালে আজিজ চাচা তার হাতটা ইউসুফের দিকে বাড়িয়ে দিত চুমু দেওয়ার জন্য। হাতে চুমু দিতে মাথাটা নিচু করতেই আজিজ চাচা তার মাথার পেছনে মৃদু চাপড় দিতে দিতে ম্যাজিশিয়ানের মত দশটি আনা ইউসুফের হাতে চালান করে দিত।
কাজ থেকে ফিরতে ফিরতে ইউসুফের আব্দুর বিকেল হয়ে যেত। ইউসুফের ধারণা ছিল, আজিজ চাচাকে নিয়ে আসবে আব্দু। তাই তখনও যথেষ্ট সময় হাতে ছিল তার। ইউসুফের আব্দুর হােটেল ব্যবসা। টাকা-পয়সা ও নাম-যশ কামানাের চেষ্টায় এটা তার সর্বশেষ উদ্যোগ। আগে সে যখন খােশমেজাজে থাকত তখন কীভাবে টাকাকড়ি আয় করা যায়, তা নিয়ে তার নানা পরিকল্পনার কথা বলত।
যেগুলাে খুব হাস্যকর ও উদ্ভট শােনাত। অথবা কীভাবে জীবনের সবকিছু বরবাদ হয়ে গেল, কী কী ভুল হল—তা নিয়ে তার নানা অভিযােগ কানে আসত ইউসুফের। হােটেলটি ছিল ছােট্ট শহর কাওয়াতে। এখানে খাওয়াদাওয়া করা যেত এছাড়া ওপর তলার একটা ঘরে গােটা চারেক বিছানা ছিল। এই শহরেই বছর চারেক ধরে ইউসুফদের পরিবারের বসবাস। এর আগে তারা থাকত দক্ষিণের আরেকটা ছােট শহরে।
প্যারাডাইস ইজ এ স্বপ্নের উদ্যান
যেটা মূলত খামার এলাকা। সেখানে ইউসুফের আব্বার একটা দোকান ছিল। একটা সবুজ পাহাড় আর তার দীর্ঘ ছায়ার কথা আজও মনে পড়ে ইউসুফের। দোকানের সামনে একটা জলচৌকিতে বসে এক বৃদ্ধ রেশমি সুতাে দিয়ে টুপিতে সূচিকাজ করত। জার্মানরা একটি রেলওয়ে গুদাম বানানাের পর থেকে ছােট্ট শহর কাওয়ার গুরুত্ব বেড়ে যায়। দেশের পাহাড়ি এলাকাগুলােতে রেললাইন বসানাের কাজ করছিল তারা। তবে শহরের এই গুরুত্বের খুব তাড়াতাড়ি অবসান ঘটে। এখন এখানে ট্রেন থামে শুধু পানি আর কাঠ নেওয়ার জন্য। গতবার আজিজ চাচা এই রেললাইন দিয়েই এসেছিল। রেললাইন ধরে গেলে পশ্চিমে যেতে পথ অনেকটা কম হয়। আজিজ চাচা বলেছিল, যেখানে রেললাইনটা উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব দিকে ভাগ হয়ে গেছে, তার আগে যতদূর পারে, সে যাবে। সে বলেছিল, এর কোনাে এক জায়গায় নাকি তখনও ব্যবসাপাতি ভালাে চলছিল। তবে ইউসুফ তার আন্ধুকে বলতে শুনেছে, গােটা শহরের ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে।
উপকূলের দিকে যে ট্রেনটা যায়, সেটা ছাড়ে বিকেলের দিকে। ইউসুফ ভেবেছিল, আজিজ চাচা এই ট্রেনে যাবে। সে আন্দাজ করেছিল, আজিজ চাচা বাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু কে কোথায় যাবে, সেটা অন্য কারও পক্ষে আগে থেকে বলা সম্ভব? এমনও হতে পারে, দুপুরের পর কোনাে ট্রেনে করে সে পাহাড়ের দিকে যাবে। তবে যাই ঘটুক, ইউসুফ সবকিছুর জন্য তৈরি ছিল। তার আব্দুর আশা ছিল, প্রতিদিন মাগরিবের নামাজের পর ইউসুফ হােটেলে গিয়ে ব্যবসাটা শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। কিন্তু বাস্তবতা হল, হােটেল পরিষ্কার করা বা খদ্দেরদের খাবার পরিবেশনে দুই যুবক কাজ করত, তাই ইউসুফের আব্দু খানিকটা হাঁফ ছাড়ার সময় পেত। হােটেলের বাবুর্চিটা পাঁড় মাতাল। একমাত্র ইউসুফ ছাড়া আর যাকে সামনে পেত, সমানে গাল পাড়ত, বদদোয়া দিত। কাউকে গাল পাড়ার মাঝখানেও ইউসুফকে দেখতে পেলে সে ঝগড়া থামিয়ে গালভরা একটা হাসি দিত। তবু তার সামনে গেলে ভয়ে কাঁপত ইউসুফ।
সেদিন ইউসুফ হােটেলে যায়নি বা জোহরের নামাজ পড়তেও যায়নি। ভাবল, অসহ্য এই গরমে কেইবা তাকে খুঁজতে বেরােবে! তাই কাজ ফাঁকি দিতে সে পেছনের উঠোনে মুরগির ঘরের আড়ালে ছায়াঢাকা কোণটিতে বসে রইল। বিকেলের দমবন্ধ করা ধুলাে ওড়ার আগে পর্যন্ত সে সেখানে কাটাল। বিকেল নামতেই ধুলাে উড়তে থাকে। বাড়ির পাশে জ্বালানির লাকড়ি স্তুপ করে রাখার একটা উঠোন ছিল। অন্ধকার অন্ধকার জায়গা, তালপাতার একটা ছাউনিও ছিল সেখানে। ইউসুফ সেখানে বসে অতিসাবধানে ছুটন্ত টিকটিকিগুলাের ডাকাডাকি শুনতে শুনতে সেই দশ আনার জন্য সতর্ক দৃষ্টি রাখতে লাগল।
জমাট রক্তে আঁকা প্যারাডাইস
ইউসুফ একা একা খেলা করতে অভ্যস্ত ছিল, তাই সেই নিস্তব্ধ উঠোনটির বিষন্ন পরিবেশেও তার মন খারাপ হল না। তার বাবা চাইত না, সে খেলা করতে দূরে কোথাও যাক । আবু বলত, “চারিদিকে হিংস্র লােকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। যারা আল্লা-খােদা মানে না— এমন সব ‘ওয়াশেনজি’ গিজগিজ করছে চারদিকে।
গাছের ওপর, পাথারের ওপর বাস করে যেসব ভূত-পেত্নি। তাদের উপাসনা করে তারা। এরা ছােট ছেলে-মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের দিয়ে যা খুশি তাই করায়। তারা সব বাউন্ডুলের বাচ্চা বাউন্ডুলে! হয়তাে তুমি তাদের একজনের সঙ্গে চলে গেলে, কেউ টের পেল না। তারা তােমাকে নিয়ে গিয়ে হয়তাে বন্য কুকুর দিয়ে খাওয়াবে! সেজন্য কাছাকাছি থাকলে কেউ
কেউ তােমার ওপর নজর রাখতে পারে। দূরে না যাওয়াই ভালাে। আব্দুর ইচ্ছে, ইউসুফ প্রতিবেশী ইন্ডিয়ান স্টোরকিপারের বাচ্চাকাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করুক।
তবে যেসব ইন্ডিয়ান বাচ্চাকাচ্চা ধুলােবালি ছােড়াছুড়ি করে, ইউসুফকে দেখে ‘গােলাে, গােলাে' বলে চাচাতে থাকে তাদের সঙ্গে সে খেলা করুক, আব্দুর তা ইচ্ছে নয়। ইউসুফ মাঝে মাঝে বয়সে বড় ছেলেদের দলের সঙ্গে বসে থাকত। যারা কিনা গাছ বা ঘরের ছায়ায় বসে আলসেমি করে সময় কাটাত। এই ছেলেদের সঙ্গ তার বেশ পছন্দ। কারণ এরা সারাক্ষণ মজার মজার গল্প বা কৌতুক বলত, খিলখিলিয়ে হাসত! এদের মা-বাবারা সাধারণত দিনমজুর। জার্মানদের রেললাইন বসানাের কাজে এরা দিনমজুরি করত।
Read More: এ ক্ল্যাশ অব কিংস PDF
অনেকে যাত্রীদের মালপত্র বয়ে দেওয়ার কাজও করত। কাজ শেষ হলে তবে পয়সা। কাজ না পেলে বেকার বসে থাকত তারা। এসব ছেলেদের কাছে ইউসুফ শুনেছে, ঠিকমত কাজ না করলে জার্মানরা নাকি তাকে ফাঁসিতে লটকায়। কিন্তু বয়স খুব কম হলে, তার মানে, ফাঁসিতে ঝুলানাের মত যথেষ্ট বড় না হলে তাকে কেটে ফেলা হয়। জার্মানদের নাকি ভয়-ডর বলতে কিছু নেই। তারা নাকি যা ইচ্ছে তাই করতে পারে, কেউ তাদের থামাতে পারে না। দলের একটা ছেলের কাছে ইউসুফ শুনেছে যে, তার আব্বা এক জার্মানকে আগুনের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিতে দেখেছে। কিন্তু সে জার্মানের হাত বিন্দুমাত্র পুড়ে যায়নি, ঠিক ফ্যান্টমের মত ব্যাপার আর কি! | এই ছেলেগুলাের দিনমজুর মা-বাবা এসেছিল নানা জায়গা থেকে। কেউ এসেছিল কাওয়ার উত্তর দিকের উসামবারা পার্বত্য এলাকা থেকে, কেউ এই পার্বত্য এলাকার পশ্চিম দিকের বিশাল হ্রদের কাছ থেকে, সংঘৰ্ষকবলিত সাভানা (আফ্রিকার বৃক্ষহীন সমতল তৃণভূমি) থেকে দক্ষিণের এলাকা থেকে আবার উপকূলীয় এলাকা থেকেও এসেছিল অনেকে। এই ছেলেগুলাে তাদের।
প্যারাডাইস pdf বইটির সকল পৃষ্টা পড়তে পাঠককে প্যারাডাইস : আবদুল রাজক গুনরাহ কিনতে উৎসাহিত করা হলো।
Paradise by Abdul Razak Gunrah
File Format : Pdf
Language: English
