লরি ড্রাইভার
| Book | Publisher | Author | F Size |
|---|---|---|---|
| লরি ড্রাইভার |
আনন প্রকাশন | আলবের্তো মোরাভিয়া | ৫ মেগাবাইট |
| Bookshop | Price | Language | T Page |
| Durdin Magazine | Only 170 Taka | Bangla | 78 |
রােমান টেলস' নামটা ইংরেজী ভাষার অনুবাদকের দেয়া। ভিতরে খুলে দেখি এটি মােরাভিয়ার একটি নির্বাচিত ছােটগল্পের সংকলন। ছেড়া পাতা কয়টা বাদ দিলেও ছাব্বিশটা গল্প পাওয়া যাবে। বইয়ের উপরের পাতায় দেখলাম ফাউন্টেনপেন দিয়ে দুজন বাঙালি ভদ্রলােকের নাম লেখা। একজন ডি সি ভট্টাচার্য আরেক জন সৈয়দ হেলাল হােসেন। তবে বইটা মনে হয় প্রথম কিনেছিলেন ডি সি ভট্টাচার্য কারণ দেখা যাচ্ছে সৈয়দ সাহেব পরে ডি সি-র নাম কেটে নিজের নাম লিখেছেন আবার তারিখ দিয়েছেন নয়, চার, উনিশ শ' একাত্তর। তার মানে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানুষের মতই এই বইয়ের কপালে দুঃখ নেমে আসে। তারপর কীভাবে হাত বদল অথবা এতিমের মতাে ভাসতে ভাসতে নীলক্ষেতের ফুটপাতে নেমে আসে তার ইতিহাস অজানাই রয়ে গেলাে।
লরি ড্রাইভার pdf
হয়তাে সৈয়দ সাহেব বা তার কোন বংশলতিকা আবর্জনা জ্ঞানে ফেরিওলাকে সের দরে বেচে দিয়েছিলেন কি না তাও অজানা। সে যাই হােক, আমি দোকানীকে বেশ অবহেলাভরে জিজ্ঞেস করলাম, দাম কত? ফুটপাতে বইকেনার অন্যতম কৌশল হলাে প্রয়ােজনীয় বইটার প্রতি অবহেলা দেখাতে হবে। হয়তাে আপনার মনে পছন্দের বইটার জন্য আত্মা আকুলিবিকুলি করছে। কিন্তু সেই আকুলভাব আপনাকে গােপন রাখতেই হবে। দোকানী টের পেলে পাইপয়সাও ছাড়বে না। অবশ্য ফুটপাতে কম দামেই বই বিক্রি হয়। দোকানী বােধ হয় দশ টাকা চেয়েছিলাে। আমি আট টাকা বলতেই দিয়ে দিলাে। আমি মনে মনে মহা খুশি। বেশ আয়েশ করে অনুবাদ করা যাবে। কিন্তু দু একটা অনুবাদ ছাপা হওয়ার পর আলস্যে পেয়ে বসলাে।
তারপর বই যে কোন তাকে ঢুকে গেলাে মনেও থাকলাে না। এরপর দু তিনবার বসত পাল্টাতে হয়েছে। কিন্তু এটা রয়েই গেছে। মাঝে মধ্যে যে চোখে পড়তাে না তা নয়। তবে মনযােগ কাড়েনি। এরপর ২০০৯ সালে একবার প্রশিক্ষণ নিতে খুবই স্বল্প সময়ের জন্য ইতালির এক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। ফিরে আসার পর আমার আবার ইতালি প্রেম জেগে ওঠে। আবার কয়েকটা গল্প অনুবাদ করে ফেলি। আবার বইটা পড়ে থাকে দীর্ঘ দশ বছর। এরপর আবার শুরু করি ২০১৯ সালে। এরমধ্যে ২০২০ সালে ২১শে বইমেলায় মােরাভিয়ার দশটা গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘রেইন ইন মে’ শিরােনামে গল্প সংকলন। এরপর বাকী গল্পগুলির অনুবাদ শেষ করি করােনার মহাদুর্যোগের সময়। গল্পগুলি অনুবাদ করতে গিয়ে মােরাভিয়াতে ডুবে গিয়েছিলাম। দেখেছি কি সাধারণ বর্ণনায় মানুষের রূঢ় দুর্দশার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন মােরাভিয়া। তাঁর গল্পের পাত্রপাত্রীরা কোথাও কোথাও একেবারে অসহনীয়ভাবে অসহায়। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বুদ্ধিভ্রংশতা তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে নত করে রেখেছে। এক্ষণে আমরা আলবের্তো মােরাভিয়ার লেখ্য বিষয় ও জীবন সম্বন্ধে পরিচিত হয়ে নিতে চাই। তাহলে তাঁকে পঠনের ক্ষেত্রে পাঠকের সঙ্গে নৈকট্য বাড়বে। তাই এই উপক্রমণিকা।
আলবের্তো মােরাভিয়ার পােষাকী নাম, আলবের্তো পিনশার্লে। লেখক নাম, আলবের্তো মােরাভিয়া। তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক এবং চলচ্চিত্র সমালােচক। ১৯২৯ সালে একুশ বছর বয়সে প্রথম উপন্যাস লিখেই সমস্ত ইউরােপে ইতিহাস গড়ে ফেলেন। সেই পুরাতনপন্থী সময়ে, বলা হয় ইউরােপের প্রথম অস্তিত্ত্ববাদী উপন্যাস। ক্যামুর ‘দি স্ট্রেঞ্জার', সাত্রের ‘দি এক্সিট’ এর পূর্বে ‘অস্তিত্ত্ববাদ’ শব্দটিই ছিলনা। মােরাভিয়া এ সম্বন্ধে লিখেছেন। বহু কারণের জন্য মােরাভিয়াকে ইউরােপের অস্তিত্ত্ববাদী সাহিত্যের জন্মদাতা বলা যায়। অস্তিত্ত্ববাদের গুনাগুন বিশ্লেষণ করতে গেলে মােরাভিয়ার বিশেষ করে চারটি উপন্যাসের উপর আলােকপাত করতে হবে। উপন্যাসগুলি হলাে, “দি ওম্যান অব রােম’, ‘দি কনফরমিস্ট’, ‘দি টাইম অব ইনডিফারেন্স এবং বােরডম'। এ বিষয়ে আলােচনা করতে গেলে সংক্ষেপে ‘অস্তিত্ত্ববাদ’ এর সংজ্ঞা এবং ব্যাখ্যা এবং এর প্রধানতম বিষয়গুলি যা পরবর্তীকালে ইতালির সাহিত্য জগতে প্রথম ‘অস্তিত্ত্ববাদ' এর প্রবর্তন হয় ও আলােচনার ঝড় ওঠে এবং মােরাভিয়াকে পরিচিত করে তােলে। মােরাভিয়ার প্রায় সমসাময়িক ইতালিয়ান দার্শনিক নিকোলা এবাগন্যানাে অস্তিত্ত্ববাদ’কে এক কথায় বলেছেন, ‘অস্ত্বিত্ত্বকে খোঁজার প্রক্রিয়া। এই বিভ্রম এবং অর্থহীনতার উপর দাঁড়িয়ে থাকা পৃথিবীতে সত্য, আন্তরিকতা এবং সত্যিকারের অস্তিত্ত্বকে নিরন্তর খোঁজার ধারণাই ‘অস্তিত্ত্ববাদ'। খ্রীস্টিয় অস্তিত্তবাদের সঙ্গে মােরাভিয়ার অস্তিত্তবাদের পার্থক্য আছে। খ্রীস্টিয় অস্তিত্ত্ববাদীদের বিশ্বাসে সত্যিকারভাবে একজন ঈশ্বর থাকেন এবং তারা বিশ্বাস করে ‘অস্তিত্ত্ববাদ', এটি একটি উচ্চ আধ্যাত্মিকতার ভিন্নরূপ। কিন্তু মােরাভিয়ার অস্তিত্ত্ববাদে কোন ঈশ্বরের উপস্থিতি নেই। কোন নিয়তি নাই, মানুষের কোন প্রকৃতিও নাই, কোন পরকাল নাই এবং বিশ্বব্রহ্মান্ডের কোন সহজাত নিয়মও নাই। অর্থহীন পৃথিবীতে মানুষের বসবাস। বাধ্য হয় সে তার নিজের দায়িত্ব নিতে। সাত্রে তার অস্তিত্ত্ববাদ এবং মানবতাবাদ’ প্রবন্ধে বলেছেন মানুষ মুক্ত, মানুষই স্বাধীনতা... কোন রকম যুক্তি ছাড়াই আমাদের একা ছেড়ে দেয়া হয়েছে।'
মানুষ এই স্বাধীনতাকে গ্রহণ করেছে নিয়তির দোহাই বা মানুষের পূর্ব নির্ধারিত ছকের মাধ্যমে।
মোরাভিয়ার বেশ কয়েকটি উপন্যাসও নিষিদ্ধ হয়। বাধ্য হয়ে তিনি লেখার মধ্যে রূপকের আশ্রয় নেন এবং অবশেষে ছদ্মনামে লিখতে থাকেন। যুদ্ধের সময় ইতালির গ্রামাঞ্চলে চলে যান এবং চাষাভুষাদের সঙ্গে বাস করতে শুরু করেন। ঐ সময়ে তার সমস্ত লেখা মার্ক্সবাদের আদর্শকে রূপায়ন করতাে। এরপর যুদ্ধ শেষ হলে এবং ইতালি ফ্যাসিস্ট মুক্ত হলে তিনি নিজ দেশে ফিরে আসেন স্বগৌরবে। তখন থেকেই তার জনপ্রিয়তা উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাঁর উপন্যাসগুলি বিদেশী ভাষায় অনুদিত হতে থাকে এবং তাঁর উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরী হতে থাকে। উনিশ ১৯৮৪ সালে ইতালীয় কমিউনিস্ট পার্টি থেকে ইউরােপীয় পার্লামেন্টের মেম্বার নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি বহু বছর যাবত সাহিত্যে নােবেল পুরষ্কারের জন্য মনােনয়ন পেয়ে আসছিলেন। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে তার নাম তের বার মনােনয়ন পায়। কিন্তু শেষতক তিনি নােবেল পাননি। | ১৯৩৬ সালে তার সাথে এলসা মুরন্ত নামের ঔপন্যাসিকের সাথে দেখা হয়, তাকে মােরাভিয়া ১৯৪১ সালে বিয়ে করেন। এরপর ১৯৬২ সালে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তারপর মােরাভিয়া লেখিকা ড্যাসিয়া ম্যারাইনির সাথে বাস করতে শুরু করেন।
এরপর সর্বশেষ তিনি তার চাইতে পয়তাল্লিশ বছরের ছােট কারমেন লেলরা নামের এক মেয়েকে বিয়ে করেন। তিনি তাঁর গল্পগ্রন্থ “দি থিঙ্ক এন্ড আদার স্টোরিজ' লেলরাকে উৎসর্গ করেন। আলবের্তো মােরাভিয়া ১৯০৭ সালে ২৮ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বিরাশি বছর বয়সে ১৯৯০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রােমে মৃত্যুবরণ করেন। রােমের কেম্পাে ভেরানােতে তাকে সমাহিত করা হয়। | ব্রাত্য শ্রেণির মানুষ নিয়ে লেখা এ গল্পগুলিও মােরাভিয়ার অন্যান্য গল্পগুলির মতােই পাঠকদের মনে তিরিশ, চল্লিশ বা পঞ্চাশ দশকের ইতালীয় অন্ত্যজ মানুষদের জীবন এবং মানস বিষয়ে একটি চিত্রকল্প সৃষ্টি করবে।
- অনুবাদক অমল সাহা
লরি ড্রাইভার হিসেবে আমি খুব দুর্বল পাতলা মানুষ। আমার হাত খুব চিকন আর লম্বু ঠ্যাং নিয়ে সব সময় ভয় খাই। আমার পেট এতাে চিমসা যে আমার পায়জামা সুরুৎ করে নিচে নেমে যেতে চায়। সত্য কথা বলতে কি, একজন লরি ড্রাইভার হতে গেলে যে সিনাওলা মানুষ লাগে আমি তার এক্কেবারে উল্টা। আপনে কি কোন সময় কোন লরি ড্রাইভারের দিকে তাকিয়েছেন? তেনারা সবাই কিন্তু ইয়া দৈত্যমার্কা মানুষ হয়। তাদের সিনা থাকে হেব্বি চওড়া। হাত থাকে গােস্তওলা মােটা মােটা, শক্ত পেটপিঠ। একজন লরি ড্রাইভার কিন্তু বিশেষ করে তাদের হাতের উপরেই ভরসা কবতে হয়। স্টিয়ারিং ঘােরানাের জন্য দরকার শক্ত হাত কারণ স্টিয়ারিংয়ের বেড়টা থাকে হাতের সমান, এবং কতক সময় পাহাড়ের বাঁকা পথে লরি ঘােরানাের জন্য পুরা হাত দুইটাই স্টিয়ারিংটাকে সম্পূর্ণ বেড়টাকে হাতের উপর ঘরিয়ে আনতে হয়। আর এক্কেবারে একভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকার পেরেশানিটা যায় পিঠের উপর দিয়ে। শিরদাড়ার কিন্তু কোনরকম ব্যথাবেদনা আর শক্ত হয়ে যাওয়া চলবে না এবং সবশেষে বাকী থাকলাে, পেট। পেটটাই একজন ড্রাইভারকে তার সীটে খাপেরখাপ বসিয়ে রাখে, যেমনটা মাটির মধ্যে পাথর বসে থাকে। একজন লরি ড্রাইভারের জন্য শরীরটা অনেক কিছু। আমিতাে যদি বিচার করি, তাহলেতাে মনের দিক থেকে ড্রাইভার হিসাবে আমি আরও আকামা। একজন ড্রাইভারের মন বলে কোন কিছু থাকতে নাই।
কোন আবদার থাকতে নাই, বাড়ির জন্য মন পুড়তে নাই বা অন্য কোন কারণে মন খারাপ হতে পারবে না। ড্রাইভারি করাটা এমন হয়রানি আর পেরেশানির গান্দা কাম, এটা দিঘেপাশে বড় একটা ষাঁড়কেও মেরে ফেলতে পারে। আর মেয়ে মানুষের কাছে তারাতাে সাগরের নাবিকের মতাে। লরি ড্রাইভাররা তাদের জন্য কমই চিন্তা ভাবনা করা উচিৎ। নইলে এই খালি যাওয়া আসার মধ্যে থাকলে তার এক্কেবারে পাগল হওয়ার যােগার হবে। কিন্তু আমি নিজে এ ব্যাপারে বিস্তর চিন্তাভাবনা করেছি আর আগের থেকেই প্রস্তুত হয়ে আছি। আমি স্বভাবগতভাবেই একা; এবং আমি মেয়েমানুষ পছন্দ করি। | যাইহােক, যদিও এটা আমার জন্য ঠিক কাজ না তারপরেও আমি একজন লরি ড্রাইভার হতে চেয়েছিলাম এবং আমি ট্রান্সপাের্ট কোম্পানিতে একটি চাকুরী বাগিয়ে ফেলেছিলাম। কোম্পানি আমাকে লরিতে আমার সঙ্গী হিসাবে এমন একজনকে দিয়েছিলাে যে একবারে সত্যিই ভােম্বল টাইপের লােক। তার নাম ছিলাে, পালম্বি। সে আসলেই ছিল একদম ঠিক একজন লরি ড্রাইভার। এমন না যে লরি ড্রাইভাররা প্রায়ই বুদ্ধিমান হয় না। কিন্তু বলদ হওয়ার ভাগ্য ছিল বলেই সে কোন একটা লরির সাথে জুতে যেতে পারতাে। যেমনটা কোম্পানি আমার সাথে ওকে জুতে দিয়েছিল। সে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী একটা মানুষ হওয়া সত্বেও কিন্তু তার মধ্যে একটা, হয়না যেমন, বয়সের তুলনায় গায়ে গতরে বড়, বালকের মতাে কিছু একটা ব্যাপার ছিল। তার ছিল একটি বিরাট মুখমন্ডল এবং গােল গােল গাল। পালম্বির নিচু কপালের নিচে ছােট কুতকুতে দুটি চোখ তাকিয়ে থাকতাে। মুখটা টাকার বাক্সের মতাে। ও কথা বলতাে খুব কম, খুবই কম, শুধু ঘোৎ ঘোৎ করতাে। তার বুদ্ধি খুলতাে তখন, যখন শুধু খাওয়ার ব্যাপারটা সামনে আসতাে। আমি একটা ঘটনার কথা স্মরণ করতে পারি, নেপলস্ েযাওয়ার পথে ক্লান্তিতে ক্ষুধায় অবসন্ন হয়ে আমরা ইত্রিতে একটা হােটেলে ঢুকেছিলাম। সেখানে মটরশুটি দিয়ে শুকরের রান্না করা নােনা গােশত ছাড়া খাওয়ার মত আর কিছুই ছিলনা। আমি খুব কমই খাবারটা খেলাম, আমার একদম ভালাে লাগেনি। পালম্বি প্রথমে পুরাে দুই বাটি গিললাে। সে আমার দিকে এক মুহূর্ত গম্ভীরভাবে তাকিয়ে রইলাে যেন আমাকে কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে। শেষে সে তার পেটের উপর দিয়ে হাত বােলালাে এরপর ঘােষণা দিলাে, আমার আরও পুরাে চার প্লেট খেতে হবে। এটা ছিল ওর বিরাট চিন্তা তাই সেটা অনেক লম্বা সময় নিয়ে খােলসা করলাে।
আপনাকে বলাই বাহুল্য, এই রকমের আকাট সঙ্গী নিয়ে যখন প্রথমবারের মতাে আমি ইতালিয়াকে নিয়ে ফিরে আসি তখন আমি কীরকম খুশিই না হয়েছিলাম! ঐ সময় আমরা রােম-নেপলস্ যাওয়া আসা করতাম। নানা রকমের মালামাল আমরা বহন করতাম-ইট, ভাঙা লােহালক্কর, খবরের কাগজের রােল, কাঠ, ফল এমনকি কোন সময় আমরা ছােটখাটো ভেড়ার পালও এক জায়গার মাঠ থেকে আরেক জায়গার মাঠে নিয়ে যেতাম। ইতালিয়া আমাদের তেরাসিনাতে থামিয়েছিলাে এবং রােমে যাওয়ার জন্য লিফট চেয়েছিলাে। আমাদের উপর হুকুম ছিল, লরিতে আমরা যেন কাউকে লিফট না দেই। কিন্তু আমরা ওর প্রতি একবার তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, একবারের জন্য নিয়ম ভাঙা যেতে পারে। তাকে ইশারা করলাম উঠে আসতে। সে এক পায়ে লাফিয়ে উঠে আসলাে, উঠতে উঠতে বললাে, “থ্রি চিয়ার্স ফর লরি ড্রাইভার, লরি ড্রাইভাররা খুব দয়ালু হয়।
ইতালিয়া ছিল এমন একটা মেয়ে যাকে দেখলেই মনটা উসখুস করে ওঠে। এটা ছাড়া ওর সম্বন্ধে আর কিছু বলা যাচ্ছেনা। তার ছিল অসম্ভব লম্বা কিন্তু সরু কোমর, এর উপরে ছিল তার চাপা সােয়েটারের নিচে পীনােন্নত স্তন যা উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাে, এক্কেবারে কি আর বলবাে, নাগিনীর ফণা। সােয়েটারটা নেমে আসতাে তার পাছা অব্দি। তার ঘাড়টাও ছিল লম্বা এবং একটি ছােট বাদামী মাথা আর দুটো বড় সবুজ চোখ। ওর বেশ লম্বা শরীরের বিপরীতে তার পাগুলি ছিল খাটো বলতে গেলে বাঁকা। তাই সে যখন হাঁটতাে তখন মনে হতাে সে যেন হাঁটু ভেঙে হাঁটছে। সে সুন্দরী ছিল না কিন্তু সত্যি বলতে এমন কিছু ছিল যা সুন্দরের চাইতে কিছু বেশী। আমার কাছে এর প্রমাণ আছে প্রথম ট্রিপের সময়ে, আমরা যখন চেস্তারনা থেকে অনেক দূরে ছিলাম তখন পালম্বি লরি চালাচ্ছিলাে। ইতালিয়া আমার উপর তার হাত রেখে বসেছিলাে এবং হাত দিয়ে আমাকে অনবরত চাপ দিয়ে যাচ্ছিলাে। ভেলেত্রি গিয়ে যতক্ষণ না আমি পালম্বির কাছ থেকে লরির দায়িত্বটা না নিলাম চাপাচাপিটা সেই ভেলেত্রি যাওয়া পর্যন্ত একবারের জন্যও থামালাে।
লরি ড্রাইভার by আলবের্তো মোরাভিয়া
সেটা ছিল গ্রীষ্মকাল এবং বিকাল তখন চারটা বাজে, এ সময়টা সবচেয়ে গরমের সময়। এসময় ঘামে আমাদের লরি ড্রাইভারদের হাত ঘামে ভিজে থাকে। আর এর মধ্যেই ইতালিয়া মাঝে মাঝে ওর সবুজ জিপসি চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আর বারবার আমার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠছে। আমার কাছে মনে হচ্ছিলাে এইতাে জীবন। অনেকদিনতাে জীবনটা একখন্ড পাথরের ফিতা ছাড়া আর কিছু ছিলনা। আমি দেখছিলাম। যে, আমি যা চাইছি সেটা একজন মেয়েও চাইছে। চেস্তারনা এবং ভেলেত্রির মাঝখানে পালম্বি লরি থামালাে এবং চাকাগুলি দেখতে বাইরে নেমে বাইরে গেল। আমি ইতালিয়াকে চুমু দেয়ার এই সুযােগটা নিলাম। ভেলেত্রিতে এসে আমি ইচ্ছা করেই পালম্বির সাথে সিট পাল্টে ড্রাইভিংয়ে গিয়ে বসলাম। হাতের জড়াজড়ি আর একটা চুমু ঐ একদিনের জন্য আমার কাছে যথেষ্ট।
এরপর থেকে নিয়মিতভাবে সপ্তাহে একদিন বা দু'দিন ইতালিয়া আমাদের সাথে রােম থেকে তেরাসিনাতে যেত এবং ফিরিয়ে আনতে হতাে। ইতালিয়া সকালে দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতাে। সব সময়ই তার হাতে থাকতাে কোন না কোন পার্সেল বা স্যুটকেস। এরপর যদি পালম্বি গাড়ি চালাতাে তখন ইতালিয়া তেরাসিনা পর্যন্ত সারা রাস্তা আমার হাত ধরে থাকতাে। আমাদের নেপলস্ থেকে ফিরে আসার সময় সে তেরাসিনাতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতাে। সে উঠেই আবার আমার হাত জড়িয়ে ধরতাে এবং ওর ইচ্ছা না থাকলেও যখনই দেখতাম পালম্বি আমাদের দেখছে।
তখনই আমি ঘােপেঘাপে চুমু মেরে বসতাম। অল্পদিনের মধ্যেই আমি ওর দিওয়ানা হয়ে গেলাম। কারণ মাঝখানে এমন একটা লম্বা সময় গিয়েছে, আমার যে একটা মেয়ের প্রতি ভালােবাসা থাকতে পারে সেটা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। ঠিক এখন ইতালিয়ার যা করার দরকার ছিলাে সেটা হলাে আমার দিকে মুখ তুলে তাকানাে, আমার মনটা মােচড় খেতাে, অনেকটা শিশুর মতাে এমনকি কান্না পেতাে। এই কান্না ভালােবাসার কান্না। কিন্তু আমার কাছে এসব একজন পুরুষের জন্য অর্থহীন দূর্বলতা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলাে। এসব আবেগকে আমি লুকানাের প্রাণপণ ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলাম। আমি যখন ড্রাইভিং করতাম পালম্বি তখন ঘুমাতাে সেই সুযােগে আমরা দুজনে নিচু স্বরে কথা বলতাম। কী বলতাম সেসব আজ আর কিছু মনে নেই। হয়তাে কোন কিছু নিয়ে মজা করা বা কৌতুক বলা বা পিরিতির কথা। আমি ওকে মনে করতে পারি। যাইহােক সময় কিন্তু খুব দ্রুত কেটে যাচ্ছিলাে। এমনকি সেই যে এসফল্ট পাথরের ফিতার কথা বলেছিলাম না সেই চেস্তারনা থেকে তেরাসিনা যেতে মনে হতাে এতােদূর! মনে হতাে এই পথ আর ফুরাবে
সেই পথ মুহূর্তে চলে যেতাে, যেন যাদু! আমি ইচ্ছা করেই গাড়ি ঘন্টায় পনের বিশ কিলােমিটার আস্তে করে চালাতাম। সব গাড়িকে আমার পাশ দিয়ে চলে যেতে দিতাম।
টাবু : লরি ড্রাইভার
আলেসান্দ্রো আমাকে সেই রেস্তোরায় অপমানের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলাে, এর দু সপ্তাহ পর সে যখন তার মােটর সাইকেল চালিয়ে ভিয়া দি ক্যাসিয়া দিয়ে যাচ্ছিলাে তখন একটা লরির সাথে ধাক্কা খায় এবং তাৎক্ষণিকভাবে অকুস্থলে মৃত্যুবরণ করে। গিউলিও সিনেমা থেকে বের হওয়ার পর থেকেই আমাকে খোঁচা মারছিলাে এবং খুব বেশী দিন না এর তিন দিন পরেই, তিবারের স্নানের জায়গাটা থেকে ও একটা ভয়ঙ্কর রােগে আক্রান্ত হলাে যা নর্দমা থেকেই এসেছিলাে এবং চলেও গিয়েছিলাে কয়েক ঘন্টা পর। রেমাে আমাকে ভায়া রিপেত্তার রাস্তায় আমাকে বলেছিলাে, তুই একটা আস্ত ছাগল, একটা বলদ, একটা আহাম্মক', এবং এর অল্প কিছু পরেই রেমাে ভায়া ডেল’ওকায় কমলার খােসায় পিছল খেয়ে চিৎপটং হয়ে পড়ে উরুর হাড় ভেঙে ফেললাে। একটা ফুটবল ম্যাচে মারিও আমার দিকে এক চোয়াড়ে ভঙি করলাে এর ঠিক ঐ সময়েই মারিওর পকেট-বইটা চুরি হয়ে গেল। | এই চারটি ঘটনা, আরও আছে যা আমি একঘেয়েমি হয়ে যাবে এই ভয়ে উল্লেখ করতে চাইনা। এটা আমি ভাবতে বাধ্য ঐ বছরটা আমাকে একটা অদৃশ্য রহস্যময় শক্তি রক্ষা করে রেখেছিলাে। যে আমার বিরুদ্ধে লেগেছে তাকেই মৃত্যু, কোন না কোন মাত্রায় শাস্তি পেতে হয়েছে। জেনে রাখুন, এটা কোন শয়তানের চোখের খেলা নয়। যে লােকের শয়তানের চোখ আছে সে কোন প্রকার উদ্দেশ্য ছাড়াই যে কারাে ক্ষতি করতে পারে। চারদিকে জল যেমন করে স্প্রে করা যায় তেমন করে সে দূর্যোগের ঘনঘটা ছড়িয়ে দিতে পারে। এর কোন ছন্দ নাই কোন কারণ নাই। না, আমি অনুভব করতাম, যদিও আমি কোন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ না, এলেবেলে মানুষ, না সুদর্শন না বলশালী, না ধনী (আমি ছিলাম এক কাপড়ের দোকানের কর্মচারী), না, সত্যিকার অর্থে কোনভাবেই আমি উল্লেখযােগ্য হওয়ার মতাে মানুষ ছিলাম না।
আমি অতিপ্রাকৃত শক্তি দ্বারা সুরক্ষিত ছিলাম, আমার ক্ষতি করে কেউ পার পেয়ে যেতে পারতাে না। আপনি হয়তাে বলতে পারেন, এটা আমার অনুমান। ঠিক আছে যদি এটাই হয়, তাহলে আপনি আমাকে বলুন যেই আমার উপর হাত তুলতে চেয়েছে তারই মৃত্যু বা শাস্তির ঘটনা ঘটছিলাে, এসব কাকতালীয় ঘটনাগুলির ব্যাখ্যা কী? ব্যাখ্যা করুন, যখনই আমি কোন বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে নিজেকে দেখেছি তখনই সেই অতিপ্রাকৃত শক্তিকে ডেকেছি এবং একটি ছােট কুকুরের ন্যায় তখনই সেই শক্তি এসে হাজির হয়েছে আমাকে সাহায্য করার জন্য এবং যে উদ্ধত মানুষ আমার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস দেখিয়েছে তাকেই শায়েস্তা করেছে। এবার সর্বশেষ আমাকে ব্যাখ্যা করুন,...কিছু মনে করবেন না। আপনাদের জানা উচিৎ আমি এসব ধারণা আমার মাথা থেকে পেয়েছি। জীবনটা চমৎকার লাগছিলাে যেন একটা যাদু শক্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম।
Lory Driver Pdf by Alverto Moravia
এক গ্রীষ্মের দিনে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, গ্রাজিয়া এবং আমি রবিবারে ওসতিয়ায় যাবাে এবং রােববারটা সেখানে কাটাবাে। আমাদের কাপড়ের দোকানটায় তিনজন কর্মচারী ছিল। গ্রাজিয়া, আমি এবং নতুন আসা উগাে। শেষ জন, সত্যি বলতে গেলে, সে এমন ছিল যাকে আমি মােটেও পছন্দ করতাম না। সে ছিল লম্বা, খেলােয়ারদের মত, আত্মবিশ্বাসী, চেহারাটা ছিল মুষ্টিযােদ্ধাদের মতাে, ভাঙা নাক এবং চোয়াল দুটো বেশ উঁচু। উগাের কাউন্টারের উপর কাপড়গুলি ছুঁড়ে দেয়ার, সেটাকে ভাঁজ খােলার এবং চাহিদা অনুযায়ী মাপ দেয়ার পর দুই আঙুলের ফাক দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার একটা বিশেষ ভঙি ছিল। যখন সে এসব কাজ করতাে তখন সে খদ্দেরদের দিকে তাকাতাে না, সে তাকিয়ে থাকতাে কাঁচের দরজার বাইরে যেখানে রাস্তা দিয়ে অনবরত লােকজন চলাচল করতাে। এটা সত্যিই আমাকে নার্ভাস করতাে এবং যখন কোন খদ্দের কাপড় সম্বন্ধে কোন সন্দেহ প্রকাশ করতাে, তখন উগাে সেই খদ্দেরকে পটানাের চাইতে তাকে উল্টো এক ধরনের জোর প্রয়ােগের জায়গায় নিজেকে নিয়ে যেতাে।
যেমন, সে কথা বলা একদম বন্ধ করে দিত, এক ধরনের অবজ্ঞা প্রদর্শন করতাে। বা কোন সময় সরাসরি শুকনাে গলায় বলতাে, আপনি এর চাইতে আর কি সাধারণ সস্তা কম দামের কাপড় চান? এটা বলে সে কাপড়টাকে আবার তাকে ফিরিয়ে নিয়ে রাখতাে। আসলে তার উদ্দেশ্য থাকতাে ক্রেতাদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়ার যে কাপড়টা তারা কিনতে পারছে না। প্রায় সব ক্রেতাই তাকে শেষ পর্যন্ত ডাক দিতাে কাপড় নিয়ে আসার জন্য আরেকটু দেখে যাচাই করে দেখার জন্য এবং শেষতক কিনতাে। কিন্তু যখনই আমি উগাের মত ব্যবহারটা নকল করতে যেতাম কিন্তু আমার না ছিল উগাের মত শারীরিক প্রাধান্য না ছিল উদ্ধত ভাব। বরং ক্রেতারা বলতাে আমার ব্যবহার ভালনা, ম্যানেজার আমাকে ব্যাগ টানার উপদেশ দিতাে বা ঐ জাতীয় কামকাইজ করতে দিতাে। সুতরাং এ ধরনের কিছু ব্যর্থ চেষ্টার পর আমি আবার আমার সহজাত ব্যবহারের কাছে ফিরে গেলাম যা ছিলাে তেলতেলে, তােষামুদে এবং নরম কথা ও সিগ্ধতায় পরিপূর্ণ।
Read More: The White Castle
গ্রাজিয়া উগােকে পছন্দ করতাে না; সুতরাং সে বিভিন্ন সময় আমাকে নিশ্চিত করেছে: ‘ঐ মানুষটা!..মাশাল্লাহ্ বিরাট দেহ! সে একটা মূর্তিমান আতঙ্ক...তাকে একটা নিগ্রোর মত দেখায়। যাইহােক, রবিবারে আমরা ওসতিয়া যাবার পরিকল্পনা করে ফেলার পর উগাে আমাদের কাছে আসলাে, এবং তার স্বভাবজাত উদ্ধত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলাে, ঠিক আছে। রােববার কাটানাের জন্য তােমরা কি দারুন প্ল্যান করেছাে বলােতাে দেখি?





