জুল ভার্ন Pdf by Jules Verne

0
    জুল ভার্ন : জুল ভার্ন সমগ্র

    জুল ভার্ন Pdf

    পৃথিবীর এমন কোনাে মানুষ নেই যে জুল ভার্ন পড়ে কল্পনার পাখায় ভর করে নি। স্বপ্ন দেখে নি। স্বপ্ন আর কল্পনা নিয়েই মানুষের জীবন। কিন্তু দুটোই অলীক। বাস্তবে যার ভিত্তি নেই। তবু মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালােবাসে। কল্পনা করতে মজা পায়। দুটো মানুষ যেমন কখনাে একরকম হয় না। তাদের স্বপ্ন-কল্পনাও কখনাে একরকম হয় না। বিচিত্র মানুষের থাকে আরাে বিচিত্র সব স্বপ্ন-কল্পনা। কিন্তু জুল ভার্ন এর মতাে আজগুবি অথচ বিজ্ঞান-নির্ভর স্বপ্ন আজ পর্যন্ত কেউ দেখে নি। কেউ কল্পনাও করে নি। তিনি বিজ্ঞানী নন। অথচ বিজ্ঞানীদের পথিকৃৎ তিনি। তার কল্পনায় যে জিনিস ছিল অদ্ভুত আর বিস্ময়কর আজ তার অনেকগুলােই বিজ্ঞানীরা সত্যি করে তুলেছেন। তার কল্পনাকে আবিষ্কার করেছেন। বাস্তব রূপ দিয়েছেন। সার্থক হয়েছে জুল ভার্ন এর বইসমূহ ও তার স্বপ্ন-কল্পনা।
    Book Publisher Author  Size
    জুল ভার্ন সমগ্র
    তিশা বুকস জুল ভার্ন ২০ মেগাবাইট
    Bookshop Price Language   Page
    Durdin Magazine Only 450 Taka Bangla 664

    জুল ভার্ন এর পরিচয় 

    আজ থেকে দুশ বছর আগে জুল ভার্ন জন্ম গ্রহণ করেন। দিনটা ছিল ১৮০০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। জন্মসূত্রে তিনি ফরাসি। কারণ ফ্রান্সের নানতেস দ্বীপে তাঁর জন্ম হয়েছিল। পরে তিনি আমেরিকায় চলে যান। এবং সেখানেই রচনা করেন তাঁর সেরা সৃষ্টিগুলাে। জুলভার্নের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় নানতেসের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর এখান থেকেই তিনি মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি নেন। ভর্তি হন ল-কলেজে। আইন পাশ করে আইনবিদ হন তিনি। অত্যন্ত তুখােড় ও মেধাবী ছাত্র ছিলেন জুল ভার্ন। আইন ব্যবসায় এসেও যােগ্যতা ও ব্যবহার গুণে খুব অল্পদিনেই বিশাল খ্যাতি অর্জন করেন। আর খ্যাতির সাথে সাথে অর্জন করেন বিত্ত ও প্রতিপত্তি।

    জুল ভার্ন বরাবরই ছিলেন নির্জনতা প্রিয়। সমাজের আর দশজন মানুষের মতাে তিনি নন। সংসারের ধরাবাধা জীবন, অর্থের পিছনে অনর্থক ছােটাছুটি তিনি পছন্দ করতেন না। পছন্দ করতেন না অর্থ উপার্জনের জন্যে মিথ্যের আশ্রয় নিতে । তাই আইন ব্যবসায় তাঁর প্রচুর খ্যাতি আর প্রতিপত্তি অর্জিত হলেও তিনি খুব একটা মনােযােগী ছিলেন না সে ব্যবসার প্রতি। তার মন ছিল বিজ্ঞানীসুলভ। নতুন নতুন চিন্তায় ডুবে থাকতেন তিনি। আর পড়তেন বিজ্ঞান বিষয়ক বই, সমুদ্র অভিযাত্রীদের অভিযানের দুঃসাহসিক কাহিনী, মহাকাশের অজানা তথ্য সম্পর্কিত নানান গবেষণামূলক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, বইপত্র। পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়ে জানার প্রতি তাঁর ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। একাকি এসব বই-পত্র পড়তেন, আর নিজের মধ্যে ডুবে থাকতেন কী এক অসম্ভব কল্পনায় । বই পড়ায় আর কল্পনায় ডুবে আত্মমগ্ন থাকতে থাকতেই জুল ভার্ন কাল্পনিক বিজ্ঞানের জগতের মানুষ হয়ে গেলেন। অসম্ভব সব কল্পনার পাখায় ভর করে তিনি উড়ে বেড়াতে লাগলেন অবাস্তব অথচ বিজ্ঞানের যুক্তিতে অটুট বাস্তব জগতে।

    জুল ভার্ন এর বইসমূহ Pdf

    ১. টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সি

    ২. মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড 

    ৩. ব্ল্যাক ডায়মন্ডস 

    ৪. এরাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইস এইটটি ডেজ 

    ৫. জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দ্য আর্থ 

    ৬. দ্য লাইট হাউজ এ্যাট দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড  

    ৭. মাইকেল ভস্ট্র গফ

    ৮. অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য ক্লাউডস

    ৯. সিক্রেট অব উইলহেম স্টোরিজ 

    ১০. ভিলেজ ইন দিট্রি টিপস 

    ১১. প্রপেলার আইল্যান্ড

    ১২. কার্পেথিয়ান ক্যাসল 

    ১৩. স্টিম হাউজ 

    ১৪. অ্যাড্রিফট ইন দ্য প্যাসিফিক 

    ১৫. এ ফ্লোটিং সিটি

    ১৬. বেগমস ফরচুন

    ১৭. ইন্টারন্যাল অ্যাডাম 

    ১৮. ফ্রম দি আর্থটু দি মুন 

    ১৯. রাউন্ড দি মুন

    ২০. ফাইভ উইকস ইন এ বেলুন 

    ২১. অফ অন এ কমেট

    ২২. দি পারচেজ অব দি নর্থ পােল 

    ২৩. মাস্টার অব দি ওয়ার্ল্ড 

    ২৪. দি গ্রিন ফ্লাশ 

    ২৫. এক্সপেরিমেন্ট অব ড. অক্স 

    ২৬. দি স্কুল ফর রবিনসন্স 

    ২৭. ইন টু দ্য সাহারা 

    ২৮. মাস্টার জ্যাকারিয়ুস

    ২৯. সিস্টিরিয়াস ডকুমেস্ট 

    ৩০. অন দি ট্রাক 

    ৩১. দি সিক্রেট অব দি আয়ল্যান্ড

     জুল ভার্ন pdf এর বাবার স্বপ্ন 

    জুলভার্নের বাবার স্বপ্ন ছিল— ‘ছেলে হবে নামকরা ধনাঢ্য আইন ব্যবসায়ী।' বাবার স্বপ্ন তিনি সম্পূর্ণ পূরণ করেন নি। কিছুটা করেছিলেন। কিন্তু বাবার স্বপ্নের চেয়েও বড় হয়েছিলেন জুল ভার্ন। আইনবিদ হয়েছিলেন বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে। আবার আইন ব্যবসা ছেড়েছিলেন নিজের মনের স্বপ্ন সাধকে বাস্তবায়িত করতে। আর তাই তাে আজ পর্যন্ত তিনি কল্প-বিজ্ঞানের একচ্ছত্র সম্রাট। তার আশেপাশে কেউ নেই। আরাে অনেকেই অনেক চমকপ্রদ কল্পবিজ্ঞানের বই লিখেছেন, কিন্তু রুদ্ধশ্বাসে পাঠককে আকৃষ্ট করে তার মতাে কেউ রাখতে পারেন নি।
    Jules Vern : জুল ভার্ন

    ১৮৬৭ সালে তাঁর বয়স যখন ৬৭ বছর তখন তিনি আমেরিকায় চলে যান ফ্রান্স ছেড়ে। আর আমেরিকায় এসেই তিনি পুরােপুরি মনােযােগী হয়ে উঠলেন লেখা নিয়ে। সৃষ্টি করলেন তার কালজয়ী সব কল্প-কাহিনী। তুমুল আলােড়ন সৃষ্টিকারী ‘মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’, ‘জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দ্য আর্থ’, ‘দ্য বেগমস্ ফরচুন', 'ফাইভ উইকস ইন এ বেলুন' ইত্যাদি সব উপন্যাস তিনি এসময়েই লেখেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এগুলাে নানান ভাষায় অনূদিত হয়ে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই কিশাের থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সব পাঠকের মনে তিনি জায়গা করে নিলেন চিরতরে।

    জুল ভার্ন বিজ্ঞানী ছিলেন না। কিন্তু তার জাদুমাখা কলমে যে কল্প-বিজ্ঞানের কাহিনী রচনা করেছেন তাতে তিনি সমস্ত বিজ্ঞানীদের পথিকৃৎ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন। তার লেখা কল্পনা হলেও সত্যের চেয়ে সত্যি। কল্পনানীত কল্পনার আশ্চর্য বাস্তব। তাঁর সঙ্গে কারাে তুলনা চলে না। জুল ভার্ন পৃথিবীতে শুধু একজনই। কল্প-বিজ্ঞান কাহিনী বা সায়েন্স ফিকশনের তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী লেখক।

    জুলভার্ন জাহাজে চড়ে সাত সাগর চষে বেড়িয়েছেন, বিমানে চড়ে পৃথিবীর আয়তন মেপেছেন, বন-উপবন, অরণ্য উপত্যকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন অজানা তথ্য উদঘাটনের জন্যে কিন্তু সবই কল্পনায়। তিনি যা করেছেন, যা লিখেছেন সব ছিল তাঁর নিজস্ব কল্পনা। বাস্তবে নয়। অথচ আশ্চর্য হতে হয় বাস্তবের সঙ্গে অদ্ভুত মিল দেখে। সত্যিই ‘মিস্টিরিয়াস’! প্রায় অর্ধশত কাহিনী লিখেছেন জুল ভার্ন। পৃথিবীর এমন কোনাে দেশ নেই, যেখানে তার কল্পকাহিনী পৌছে নি। কল্প-বিজ্ঞানের এই মহান লেখক ও সাধক ১৯০৫ সালের ২৪ মার্চ আমেরিকার অ্যাসিয়েন্স-এ দেহত্যাগ করেন। মৃত্যু তাকে পৃথিবী থেকে নিয়ে গেলেও তার অমর অসাধারণ সৃষ্টিকে নিয়ে যেতে পারে নি। পারবেও না কোনােদিন। আর তাই তাে জন্মের দুশ বছর পরেও তিনি পৃথিবীব্যাপী রাজত্ব করছেন বিপুল দাপটে। অমর হয়ে আছেন লক্ষ কোটি পাঠকের মণিকোঠায়।

    জুল ভার্নের অমর কল্পকাহিনীগুলােকে একত্রে সংকলন ও সম্পাদনা করার দায়িত্ব পেয়ে আমি সত্যি সত্যিই অভিভূত। আশাকরি বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর পাঠকের কাছে বইটি সমাদৃত হবে।

    — মিলন রায় 

    জুল ভার্ন এর টুয়েন্টি থাউজেন্ড লীগস আন্ডার দা সি 

    জুল ভার্ন এর টুয়েন্টি থাউজেন্ড লীগস আন্ডার দা সি বইটির আরেকটি অনুবাদ অতল সুমদ্রে, অনুবাদ করেছেন কামরুল হুদা।
    Twenty Thousandth Leauges under the Sea Pdf in Bengali

    অতল সমুদ্রে বইটি সম্পর্কে অনুবাদক কামরুল হুদা বলেন, সময়টা ১৮৬৬ সাল। সমুদ্র-দানবের কারণে ইউরােপ আমেরিকাসহ অনেক দেশের জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্থ হয় বাণিজ্য। জনমতের চাপে ১৮৬৭ সালে আমেরিকার যুদ্ধ জাহাজ ‘আব্রাহাম লিঙ্কন’কে পাঠানাে হয় দানবকে ধ্বংস করার জন্য। জাহাজে ওঠেন ফরাসি প্রকৃতিবিদ প্রফেসর পিয়ের আরােনাক্স । সাথে সেবক ও সহকারী কনসেইল এবং কানাডিয়ান হাৰ্পনার নেড ল্যান্ড। শুরু হয় অভিযান। দানবের সাথে সংঘর্ষে সমুদ্রে পড়ে যায় ওরা। এটা দানব ছিল না, ছিল লােহার তৈরি একটি ডুবােজাহাজ। এর কমান্ডার মানবতা থেকে বিচ্ছিন্ন এক ব্যক্তি, সমুদ্র যার আবাস। নিজের পরিচয় দেন ‘কেউ নয়, অথচ পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের সাহায্যে হাত বাড়াতে দ্বিধা করেন না। 

    জাপান সমুদ্র থেকে শুরু গভীর সমুদ্রে ভ্রমণ। প্রশান্ত মহাসাগর, ভারত মহাসাগর, লােহিত সাগর, ভূমধ্যসাগর, আটলান্টিক, তারপর দক্ষিণ মেরু জয় করে আমেরিকা হয়ে ইউরােপ। চলার পথে বিস্ময়কর সব দর্শনীয় স্থান দেখার পাশাপাশি নানান বিপদ। এভাবে ৪৩,২০০ মাইল বা ২০,০০০ লীগ পাড়ি দেবার পর এই বন্দীরা কি এই ডুবাে জাহাজ থেকে পালাতে পারবে? ১৮৭০ সালে প্রকাশিত জুল ভার্ন এর এই সায়েন্স ফিকশন তথা উপন্যাস কেবল অভিযানের গল্প নয়, আছে সমুদ্র জয়ের বিভিন্ন কথকথা।

    ‘টুয়েন্টি থাউজেন্ড লীগস আন্ডার দ্য সি' উপন্যাসে প্রফেসর পিয়ের আরােনাক্স স্বীকার করেন যে, “সমুদ্রের গভীরতম অংশ সম্পর্কে আমাদের ধারণা সম্পূর্ণ অজানা। কোনও শব্দই আজ পর্যন্ত ওদের কাছে পৌঁছায়নি। এই দূরবর্তী গভীরতায় কী চলছে? পানির নিচে বারাে বা পনেরাে মাইল দূরের এই অঞ্চলে কোনও প্রাণী অবস্থান বা বসবাস করতে পারে? এই প্রাণীদের পরিচয় বা নিয়মতন্ত্র প্রায় অনুমানের বাইরে।” 

    জুল ভার্নের (১৮২৮-১৯০৫) এই উপন্যাস ১৮৬৮ সালের ২০ মার্চ থেকে জুন ২০, ১৮৭০ পর্যন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তখন এর নাম ছিল ‘সাবমেরিন ট্যুর অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। পরে হেটজেল নতুন নামে বই প্রকাশ করেন। প্রকাশের পর ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হলে রাউন্ড দা ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’ ও ‘জার্নি টু দা সেন্টার অব দা আর্থ' এর পাশাপাশি অন্যতম সেরা রচনা হিসাবে বিবেচিত হয়। প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে এটার প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যায়। এই উপন্যাসের দুটি ভিন্ন ভিন্ন পাণ্ডুলিপি রয়েছে। 

    ১৮৬৬ সালে ভার্ন প্রথমটার কাজ শেষ করেন বলে ধারণা করা হয় এবং দ্বিতীয়টা - যা মূল বই হিসাবে ১৮৬৯-৭০ সালে প্রকাশ পায়। প্রথম সংস্করণের প্রথম খণ্ড ২৮ অক্টোবর ১৮৬৯ এবং দ্বিতীয় খণ্ড ১৩ জুন ১৮৭০ সালে বিক্রয়ের জন্য রাখা হয়। পরে ১৬ নভেম্বর ১৮৭১ সালে রিও এবং ডি নিউভিলের ১১১টা চিত্রসহ ডিলাক্স এডিশন বের হয়। এটার প্রথম ইংরেজী অনুবাদ ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখ্য, এই উপন্যাসের নাম প্রায়শই পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন ‘জার্নি আন্ডার দা ওয়াটার্স’, ‘টুয়েন্টি থাউজেন্ড লীগস আন্ডার দা ওয়াটার্স’, ‘টুয়েন্টি ফাইভ থাউজেন্ড লীগস আন্ডার দা ওয়াটার্স' এবং ‘টুয়েন্টি থাউজেন্ড লীগস আন্ডার দা ওশেনস'।

    ফ্রান্স এর নত শহরের অন্তর্গত লােয়ের নদীর তীরে একটা ব্যস্ত সামুদ্রিক বন্দরে জুল ভার্নের জন্ম। সমুদ্রের জন্য আজীবন আবেগ ছিল তাঁর। প্রথমে প্যারিস স্টকব্রোকার, পরে একজন প্রখ্যাত লেখক এবং ইয়টসম্যান হিসাবে ঘন ঘন ব্রিটেন, আমেরিকা, ভূমধ্যসাগর ভ্রমণ করেন। তবে এই উপন্যাসের উদ্দীপনা ছিল সহযােদ্ধা ম্যাডাম জর্জ স্যান্ডের ১৮৬৫ সালের ২৫ জুলাই লেখা একটা চিঠি। তিনি ভার্নের প্রথম দুটি উপন্যাস ‘ফাইভ উইকস ইন আ বেলুন’ (১৮৬৩) এবং ‘জার্নি টু দা সেন্টার অব দা আর্থ’ (১৮৬৪) এর প্রশংসা করে বলেন, ‘আশা করি শীঘ্রই আপনি আমাদের সমুদ্রের গভীরে নিয়ে যাবেন, ডাইভিং সরঞ্জামে ভ্রমণকারী চরিত্রগুলি পরিপূর্ণ হবে আপনার বিজ্ঞান এবং কল্পনার দ্বারা। এইভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে ভার্ন সাহিত্যের দুর্দান্ত এক বিদ্রোহী সৃষ্টি করেন, একজন মুক্তিযােদ্ধা যিনি স্বাধীন থাকার জন্য ঢেউয়ের নিচে আশ্রয় গ্রহণ করেন। 

    যদিও কিছু সমালােচক সন্দেহ করেন যে স্যান্ডের পরামর্শ আসলেই সঠিক কিনা। উল্লেখ্য ভার্নের প্রথম দুটি বই ‘জার্নি টু স্কটল্যান্ড এবং ‘প্যারিস ইন দা টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি’ তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। প্রথমদিকে ভার্নের ক্যাপ্টেন নিমাে ছিলেন একজন পােলিশ অভিজাত শ্রেণীর মানুষ যার পুরাে পরিবারকে রাশিয়ান সেনারা হত্যা করে। নিমাে ডুবােজাহাজ ‘নটিলাস’ তৈরির পর অত্যাচারী রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে প্রতিশােধের জন্য সমুদ্রের নিচের অভিযান পরিচালনা করেন।

    তবে ১৮৬০ এর দশকে ফ্রান্স রাশিয়ার জারকে মিত্র হিসাবে বিবেচনা করলে ভার্নের প্রকাশক পিয়ের হেটজেল এই লেখা গ্রহণ করেননি। ভার্ন তাঁর বিষয়বস্তু পুনরায় তৈরি করেন। নিমাের জন্য তৈরি হয় নতুন জাতীয়তা। বইয়ে নিমাের পটভূমি একটা অন্ধকার রহস্য হিসাবে আছে। এখানে তাঁকে একজন উদ্ভাবক, সংগীতশিল্পী, রেনেসাঁর প্রতিভা হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে যিনি পুরানাে শত্রুর প্রতি ঘৃণা পােষণ করেন। পরবর্তীকালে ক্যাপ্টেন নিমের প্রকৃত তথ্য দি মিস্টেরিয়াস আইল্যান্ড’ (১৮৭৫) উপন্যাসে সম্পূর্ণ হয়।
     
    আইজ্যাক আজিমভ (১৯২০-১৯৯২) ভার্নের বইগুলিকে বিশ্বের প্রথম বিজ্ঞানকল্পকাহিনী’ বলে উল্লেখ করেছেন। এটা সত্য যে তাঁর ষাটটা বইয়ের অনেকগুলি ভবিষ্যতের ঘটনা এবং প্রযুক্তির পূর্বাভাস দেয়। অনেকের কাছে ‘টুয়েন্টি থাউজেন্ড লীগস আভার দা সি' অন্যতম প্রভাবশালী উপন্যাস হিসাবে বিবেচিত। এই বই ইঞ্জিনিয়ার সাইমন লেকের মতাে বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক, সমুদ্রবিদ উইলিয়াম বিবে এবং মেরু ভ্রমণকারী স্যার আর্নেস্ট শ্যাকলেটনের জন্য অনুপ্রেরণা ছিল। ডুবে যাওয়া টাইটানিকের সন্ধানকারী ড. রবার্ট ডি বালার্ড স্বীকার করেছেন যে কিশাের বয়সে এটা ছিল তাঁর প্রিয় বই। 

    জুল ভার্ন pdf সমগ্র

    সমুদ্র অন্বেষণকারীদের মধ্যে খ্যাত জাকোসটো এই বইকে তাঁর জাহাজের বাইবেল বলেছেন। উল্লেখ্য, ক্যাপ্টেন নিমাের কাহিনী গ্রিক মহাকাব্য হােমারের ‘ওডিসি’কে স্মরণ করিয়ে দেয়। ওডিসিতে ওডিসিউস তার বিচরণকালে রাক্ষস সাইক্লোপস পলিফেমাসের মুখােমুখি হয়। পলিফেমাস ওডিসিউসের নাম জানতে চাইলে উত্তরে ওডিসিউস বলে এটা ‘ইউটিস' যার অর্থ ‘ননা ম্যান’ বা ‘কেউ নয়। জুল ভার্নের এই উপন্যাসে ‘নিমাে’র ল্যাটিন অর্থ ‘নাে ম্যান’ বা ‘কেউ নয়। ক্যাপ্টেন নিমাে এবং ওডিসিউস উভয়ই বিশ্ব থেকে নির্বাসিত হয়ে সমুদ্র ভ্রমণ এবং একইভাবে ক্রুদের মর্মান্তিক মৃত্যুতে শােক প্রকাশ করে। এই বইয়ের ছবি মূল ফরাসী বই থেকে নেওয়া। অনুবাদ বিস্তৃত পরিসরে করা হয়েছে। পাঠকদের ভাল লাগলে খুশী হবাে।

    অধ্যায় ১ : অতল সমুদ্রে একটি চলন্ত ডুবো পাহাড়

    ১৮৬৬ সালে একটা রহস্যজনক, ব্যাখ্যাতীত এবং অবর্ণনীয় ঘটনা চিহ্নিত করা হয়। এটা গুজব ও অনুমানযােগ্য ঘটনা যা অবশ্যই কেউ ভুলে যায়নি। সমুদ্র বন্দরের বেসামরিক নাগরিকদের বিচলিত করার পাশাপাশি স্থলভাগে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। বিশেষ করে সমুদ্রে কাজ করা পেশাদার লােকজন শঙ্কিত হয়ে পড়ে। ইউরােপ এবং আমেরিকার বাণিজ্যিক জাহাজের মালিক, জাহাজের ক্যাপ্টেন, নৌ অফিসার এবং কর্মরত নাবিকসহ দুই মহাদেশের বিভিন্ন জাতীয় সরকার ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্থ হবার কারণে অত্যন্ত বিরক্ত ও চঞ্চল হয়ে পড়ে। সংক্ষেপে বলা যায় বেশ কিছু সময়ের মধ্যে বহু জাহাজ সমুদ্রে একটা বিশাল জিনিস এর মুখােমুখি হয়েছে যা দীর্ঘ স্পন্দন-আকৃতির বস্তু, কখনাে কখনাে ফসফরাসের আভা ছড়িয়ে দেয় যেটা তিমি থেকে অনেক বড় এবং দ্রুতগামী। 

    সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজের লগ বইতে এ সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক তথ্য যেমন বস্তু বা প্রাণীর কাঠামাে, চলাচলের অভূতপূর্ব গতিশক্তি এবং অনন্য প্রাণবন্ত জীবনশক্তির বিষয়ে সবাই একমত ছিল। তবে কারও কারও ধারণায় এটা স্তন্যপায়ী প্রজাতির তিমি জাতীয় মাছ যা বিজ্ঞানে শ্ৰেণীবদ্ধ করা থাকলেও তিমির চাইতে বেশি কিছু। এই রহস্যময় প্রাণী বা বস্তু জ্ঞানের স্বীকৃত সমস্ত মাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও প্রকৃতিবিদ, গবেষক বা বিশেষজ্ঞরা তাদের না দেখা এ ধরনের অদৃশ্য দৈত্যের অস্তিত্বকে বিশেষভাবে গ্রহণ করেন।

    বিভিন্ন সময় নেয়া পর্যবেক্ষণে জানা যায় যে, বস্তু বা প্রাণীর দৈর্ঘ্য ২০০ ফুট। এটা অতিরঞ্জিত অনুমান এবং মৎস্য বিজ্ঞানীদের জানা কোনও কিছুর তুলনায় মাত্রা খুব বেশি ছাড়িয়ে যায়, যদি তা আদৌ বাস্তবে থাকে। তবুও এটা বিদ্যমান এবং একটা অনস্বীকার্য সত্য। যেহেতু মানব মন বিস্ময়কর বস্তুর উপর আকর্ষিত হয় সে কারণে বিশ্বব্যাপী উত্তেজনা তৈরি করে।

    ২০ জুলাই, ১৮৬৬ সালে ক্যালকাটা এন্ড বার্মা স্টিম ন্যাভিগেশন কোম্পানির জাহাজ ‘গভর্নর হিগিনসন’ অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলের পাঁচ মাইল দূরে এই চলমান বস্তুর মুখােমুখি হয়। ক্যাপ্টেন বেকার প্রথম ভাবেন একটা অজানা চলন্ত ডুবাে পাহাড় দেখতে পেয়েছেন। যখন এর সঠিক অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাইলেন তখন দুটি জলস্রোত হিস হিস শব্দে এই বস্তু থেকে বেরিয়ে প্রায় ১৫০ ফুট উচ্চতায় বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি ধারণা করেন যদি এই ডুবাে পাহাড়ের কোনও উষ্ণ প্রস্রবণ ফেটে না যায়, তবে জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীর ভেতর থেকে এ ধরনের বাতাস এবং বাষ্পের মিশ্রিত পানি বের হবার বিষয় তার অজানা। ২৩ জুলাই অনুরূপ ঘটনা প্রশান্ত মহাসাগরে ঘটে। ওয়েস্ট ইন্ডিয়া এন্ড প্যাসিফিক স্টিম ন্যাভিগেশন কোম্পানির জাহাজ ‘ক্রিস্টোফার কলম্বাস' থেকে এটা দেখা যায় । বােঝা যায় এই অসাধারণ বস্তু চমকপ্রদ দ্রুততায় এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় নিজেকে স্থানান্তর করতে পারে। 

    মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে ক্রিস্টোফার কলম্বাস এর চার্ট অনুযায়ী গভর্নর হিগিনসন থেকে দেখা প্রথম অবস্থানের ১,৫১২ মাইলেরও বেশি দূরত্বে দেখতে পায়। পনেরাে দিন পর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরােপের মধ্যবর্তী আটলান্টিকের দুই হাজার মাইল দূরে ফরাসি কোম্পানির জাহাজ ‘হেলভেশিয়া’ ও রয়্যাল মেইল লাইন এর ‘শ্যানন এই দৈত্যকে চলতে দেখে। এর অবস্থান ছিল গ্রীনউইচ মেরিডিয়ানের অক্ষাংশ ৪২.১৫ ডিগ্রি উত্তর এবং দ্রাঘিমাংশ ৬০.৩৫ ডিগ্রি পশ্চিমে। এদের পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, এই প্রাণীর ন্যূনতম দৈর্ঘ্য ৩৫০ ফুট। হেলভেশিয়া ও শ্যানন জাহাজ ছােট আকারের, যদিও প্রতিটার দৈর্ঘ্য ৩২৮ ফুট। এদিকে অ্যালিউশিয়ান দ্বীপপুঞ্জের জলপথে ঘন ঘন দেখা বালেন তিমির সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ১৮২ ফুট। বিভিন্ন জাহাজ থেকে পাওয়া একের পর এক প্রতিবেদন জনমতকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে থাকে। এর মধ্যে ছিল ট্রান্সআটলান্টিক লাইনার ‘পেরেইরি’ এর নতুন পর্যবেক্ষণ, ইনমান লাইনার ‘ইট’ দৈত্যের দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া ও ফরাসি ফ্রিগেট ‘নৰ্মান্ডি’র অফিসারদের তৈরি সরকারী প্রতিবেদন। ছােট দেশের লােকজন এই ঘটনা নিয়ে রসিকতা করলেও ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং জার্মানির মতাে বড় দেশগুলি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ছিল।

    প্রতিটা বড় শহরের জনগণের মধ্যে এই বৃহৎ দৈত্যের প্রতি ক্রোধ ও আগ্রহ দেখা যায়। ওরা কফি হাউসে এটা নিয়ে গান গাইতে থাকে, সংবাদপত্রে উপহাসসহ প্রেক্ষাগৃহে নাটক মঞ্চস্থ করে। ট্যাবলয়েডগুলি মানুষের কৌতূহল বাড়িয়ে দেবার জন্য এ ঘটনাকে দুর্দান্ত সুযােগ বলে মনে করে একটা বিশাল কাল্পনিক প্রাণীর পুনরায় উপস্থিতির কথা বলে। এমনকি ওরা প্রাচীনকালের অ্যারিস্টটল ও প্লিনির মত অনুযায়ী এ ধরনের দানবদের অস্তিত্ব স্বীকার করতে থাকে। নরওয়েজিয়ান লেখক বিশপ পন্টোপ্পিডানের গল্প, পল এজেডের বিবরণ এবং শেষ পর্যন্ত ১৮৫৭ সালের ক্যাপ্টেন হ্যারিংটন এর প্রতিবেদন উল্লেখ করে যেখানে তিনি একটা বৃহৎ সাপ দেখার দাবি করেছেন। এরপর ধর্মীয় সমাজ, বৈজ্ঞানিক জার্নালে বিশ্বাসী এবং সন্দেহবাদীদের মধ্যে বিতর্ক চলতে থাকে। 

    দৈত্যের প্রশ্নে সবার মন উদ্দীপ্ত হয়। এই প্রচারাভিযানের সময় সাংবাদিকরা বিজ্ঞানী সেজে পত্রিকায় ক্রমাগত লিখতে থাকায় বিজ্ঞানীদের সাথে লড়াই বাধে। ওদের মধ্যে কেউ কেউ সামুদ্রিক সাপের পরিবর্তে ব্যক্তিগত আক্রমণ চালিয়ে যায়। এই যুদ্ধ ছয় মাস ধরে বজায় থাকে। ১৮৬৭ সালের প্রথম দিকে এই প্রশ্ন থেমে গেছে বলে মনে হয়। ধারণা করা হয় এই বিষয় পুনরায় উত্থাপিত হবে না, তখনই নতুন তথ্য জনগণের নজরে আসে। তখন এটা বৈজ্ঞানিক সমস্যা সমাধানের বিষয় ছিল না, তবে বােঝা যায় এটা এড়িয়ে চললে গুরুতর বিপদ হতে পারে। প্রশ্নটা সম্পূর্ণ নতুন মােড় নেয়। দানব আবার ছােট দ্বীপ, পাথর, একটা প্রাচীর বা ডুবাে পাহাড় হয়ে উঠে, কিন্তু পালিয়ে যাওয়া ডুবাে পাহাড় অধরাই থেকে যায়।

    ১৮৬৭ সালের ৫ মার্চ ভােরে মন্ট্রিল ওশেন কোম্পানির ‘মােরাভিয়ান’ জাহাজের স্টারবাের্ড কোয়ার্টারের সাথে একটা পাহাড়ের সংঘর্ষ হয় যা এই জলপথের কোনও চার্টে চিহ্নিত নেই। বাতাস এবং ৪০০ হর্সপাওয়ারের বাষ্পের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর গতি ছিল ১৩ নট। জাহাজের কাঠামাে শক্তিশালী থাকায় সংঘর্ষে কানাডা থেকে ফিরে আসা ২৩৭ জন যাত্রী অক্ষত থাকে। এই দুর্ঘটনা সকাল পাঁচটার সময় ঘটে। ডেকের অফিসাররা জাহাজের পেছনে ছুটে আসে। যত্নের সাথে সাগরের চারপাশ পরীক্ষা করে জোরালাে ঢেউ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়নি।

    মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড Pdf


    ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দ ২৩ মার্চ, বিকেল চারটা।
    প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তাল-উদ্দাম-সফেন জলরাশির ওপর, শূন্য থেকে কয়েকটা পুরুষ-কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে লাগল । গল্প বা হাসি-মশকরা নয় । জটিল সমস্যা সমাধানের সুচিন্তিত পরামর্শ। বরং বলা চলে টুকরাে টুকরাে প্রশ্নোত্তর।
    The Mistirious iland Pdf in Bengali

    কী ব্যাপার বল তাে? আমরা কি তবে ওপরে উঠে চলেছি?' না। ওপরে অবশ্যই নয়। ‘ওপরে উঠছি না? তবে? তবে কি নিচেই নামছি? য, নিচেই নামছি বটে। তবে পরিস্থিতি অবশ্যই স্বাভাবিক নয় স্যার, আমরা ভয়ঙ্কর বিপদের মুখােমুখি হয়েছি।
    ক্যাপ্টেন যন্ত্রচালিতের মতাে সােজা হয়ে বসেত গিয়ে বলে উঠলেন, 'ভয়ঙ্কর বিপদ? কী রকম পিবদ বলাে তাে? ব্যাপার কী?'
    স্যার, আমরা পড়ে যাচ্ছি। দ্রুত নিচে পড়ছি।' ‘এক কাজ করাে, যত তাড়াতাড়ি পার বেলুনের ওজন কমানাের চেষ্টা করাে।'
    সে চেষ্টারও ক্রটি রাখি নি স্যার। অনেক আগে থেকেই বেলুনের ওজন কমানাের জন্য সাধ্যমতাে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি।'
    অস্থিরচিত্ত ক্যাপ্টেন ধমকের স্বরে প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন, “ওজন কমানাের ব্যবস্থা যদি গ্রহণ করাই হয়ে থাকে তবে বেলুনটা ওপরে উঠছে না কেন?' ১ বিপরীত দিক থেকে কোনাে উত্তরই ভেসে এল না।
    কয়েক মুহূর্ত পরে আবার ক্যাপ্টেনের অস্থির কণ্ঠ ভেসে এল, কী ব্যাপার, মুখে কুলুপ এঁটে দিলে কেন?' উন্মত্ত বাতাসের তীব্র আর্তনাদ ভেদ করে ক্যাপ্টেনের কণ্ঠ ভেসে এল, কী বুঝছ, বেলুনটা কি এখন ধীরে ধীরে ওপরে উঠে যাচ্ছে।
    ‘না।' নিচের দিক থেকে অস্পষ্ট একটা আওয়াজ ভেসে আসছে, ক্রোধােন্মত্ত সমুদ্রের নিরবচ্ছিন্ন গর্জন।
    কথাটা শেষ হতে না হতেই আর্তস্বর শােনা গেল, সর্বনেশে কাণ্ড ঘটতে চলেছে! গেল! সব গেল! সমুদ্র যে মাত্র শশা পাঁচেক ফুটও নিচে নয়। ফেলে দাও, ফেলে দাও। বেলুনে ভারী যা কিছু আছে সমুদ্রের জলে ফেলে দাও। বেলুনটাকে ভারমুক্ত করাে। গোলাবারুদ, বন্দুক আর খাবারদাবার যা কিছু আছে ফেলে দিয়ে বেলুনটাকে হাল্কা করে ফেলাে।'
    প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে দেখা দিল এক প্রলয়ঙ্কর ঝড়ের তাণ্ডব। সর্বগ্রাসী ঝড়। এ ধ্বংসাত্মক ঝড় পরবর্তীকালে কিংবদন্তী হয়ে দীর্ঘদিন মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে জাগরুক ছিল। গল্পকথার মতাে দীর্ঘদিন সবার মুখে মুখে ঘুরে
    বেরিয়েছে।
    ১৮ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত ধ্বংসাশ্রয়ী এ ঝড়ের তাণ্ডবে ইওরােপ, এশিয়া ও আমেরিকার বিরাট একটা ভগ্নাংশ ধ্বংসস্তুপের রূপ নিয়েছিল। | বিশালায়তন একটা বেলুন উন্মত্ত এলােপাথাড়ি ঝড় আর জমাটবাধা কুয়াশার কবলে পড়ে অনবরত চক্কর মারতে মারতে নিচের দিকে নেমে আসতে লাগল। বেলুনের গা থেকে ঝুলন্ত একটা দোলনায় পাঁচজন লােক হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে, অদৃষ্ট সম্বল করে বিরুদ্ধ প্রকৃতির মােকাবেলা করে চলেছে। তারা পাশাপাশি কাছাকাছি অবস্থান করলেও ঘন কুয়াশায় কেউ কাউকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না।
    বাতাসের দাপটে দোল খেতে খেতে বেলুনটা ক্রমে নিচের দিকে নামছে তাে নামছেই।
    বিপদ আরাে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে দেখা দিল যখন বােঝা গেল বেলুনটার আয়তন ক্রমেই কমে আসতে লাগল। আসলে তার গায়ে সুক্ষ্ম একটা ছিদ্র তৈরি হয়ে তিরতির করে গ্যাস বেরিয়ে যাচ্ছে। চিপসে যাওয়া বেলুনটা পথহারা। উম্লান্ত পথিকের মতাে ধীর-মন্থর গতিতে গর্জনরত ক্রোধােন্মত্ত সমুদ্রের দিকে নেমে যাচ্ছে।
    একদিকে উম্মত্ত ঝড়ের তাণ্ডব আর পায়ের তলায় ক্রোধােন্মত্ত সমুদ্রের নিরবচ্ছিন্ন ফোস ফোসানি। উভয়ের মর্মভেদী গর্জনে বুকের ভেতরে ফুসফুস দুটোকে অস্থির করে তুলেছে। বেলুনের নির্ভীক যাত্রীরা আর কতক্ষণই বা নিজেদের মনকে শক্ত রাখতে পারে। ক্রমেই তাদের মধ্যে হতাশী আর হাহাকার দানা বাঁধতে লাগল।
    আরও—আরও নিচে নেমে গেল দিশাহারা বেলুনটা। বেলুনের যাত্রীরা প্রমাদ গুণল। সমুদ্রের বুকে বেলুনসমেত তারা আছাড় খেয়ে পড়বে। উঃ! ভাবলেও বুকের রক্ত হিম হয়ে যাবার জোগাড়। তকন কি মর্মান্তিক অবস্থা যে তাদের হবে তা স্বয়ং ঈশ্বরও বুঝি অনুমান করতে পারছেন না।
    বেলুনের যাত্রীদের শরীরের স্নায়ুগুলাে ক্রমে শিথিল হয়ে আসতে লাগল। এবার দমকা ঝড়ের কবলে পড়ে বেলুনটা তিরতির করে আবার ওপরের দিকে কিছুটা উঠে গেল।
    রাত্রির অন্ধকার কেটে গিয়ে পুব-আকাশে হাল্কা রক্তিম ছােপ ফুটে উঠল। সমুদ্রের বুকে শুরু হল আলাে-আঁধারীর খেলা। কুয়াশার দাপটও অনেকাংশে হাল্কা হয়ে আসতে লাগল।
    সকাল হল। চব্বিশে মার্চের সকাল। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস। বেলুনটা আবার দ্রুত নিচের দিকে নামতে লাগল। 

    জুল ভার্ন রচনা সমগ্র হাল্কা কুয়াশায় মােড়া গােপন অন্তরাল থেকে আবার পূর্বপরিচিত সেই নির্ভীক কণ্ঠস্বর ভেসে এল, এবার? এবার কর্তব্য কী?
    ‘বেলুনে অদরকারি জিনিসপত্র এখনাে যা কিছু আছে সব সমুদ্রে ফেলে দেয়াই একমাত্র কর্তব্য।' ক্যাপ্টেনের নির্দেশে বেলুন থেকে ঝপাঝপ কিছু জিনিসপত্র সমুদ্রের জলে ফেলে দেওয়া হল।
    হায় ঈশ্বর! এতকিছু সত্ত্বেও বেলুনের গতি ঊর্ধ্বমুখী না হয়ে ক্রমেই নিচের দিকে নেমে যেতেই লাগল। এখন উপায়!
    মুমূর্ষ রােগীর মতাে ধুকতে ধুকতে বেলুনটা তিরতির করে আরও কিছুটা পথ এগিয়ে গেল। কিন্তু জল আর জল । গাছপালা বা বাড়িঘরের চিহ্নমাত্রও কারাে নজরে পড়ছে না।
    আবার অদৃশ্য আর্তির শােনা গেল—“আবার—আবারও আমরা নিচের দিকে নামতে শুরু করেছি। আমরা নামছি—পড়ে যাচ্ছি!’ |
    হায় ঈশ্বর! কপালে কি এই লিখে রেখেছিলে-সমুদ্রের বুকেই বেঘােরে প্রাণটা খােয়াতে হবে! ক্রোধােন্মত্ত সমুদ্রে ডুবেই যাব! ডুবেই মরতে হবে আমাদের!' ।
    বাতাসবাহিত নির্ভীক কণ্ঠের অভয়বাণী শােনা গেল-ধু! এমন করে মুষড়ে পড়লে চলবে কেন? বেলুন থেকে প্রয়ােজনীয়-অপ্রয়ােজনীয় সবকিছু ফেলে দেওয়া হয়েছে কি? ভালাে করে দেখে নাও, কিছু পড়ে রয়েছে—'
    না। একমাত্র ডলারের থলেটা রয়ে গেছে। চার হাজার ডলারের থলেটার কথা বলছি। ‘ফেলে দাও। মিছে মায়া করে সর্বনাশ ডেকে আনার কোন মানে হয় না। ডলারের থলেটাও ফেলে দাও। কথাটা শেষ হতে না হতেই ছােট্ট একটা থলে নিচে নেমে গেল। ঝপ করে পড়ল গিয়ে জলে।
    কই, তেমন কাজ হল না তাে। আচমকা ভারমুক্ত হওয়ায় বেলুনটা মুহূর্তের জন্য ওপরে উঠে গেল বটে, কিন্তু সে আর কতটা বা কতক্ষণের জন্য? পরমুহূর্তেই আবার সেটা বাতাসের কাঁধে ভর দিয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করল।
    আবার সে অদৃশ্য কণ্ঠের স্বর ভেসে এল-কাজ হল কই? এখন উপায়? বেলুন থেকে সবই তাে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আর তাে কিছুই ফেলার মতাে নেই।'
    ‘আছে। দোলনা-উইলাে কাঠের দোলনাটা এখনও রয়ে গেছে।'
    ব্যস, বেলুনের যাত্রীরা শক্ত দড়ি দিয়ে বেলুনের আঙটার সঙ্গে নিজেদের বেঁধে ফেলল। আর ছুরি দিয়ে দোলনার বাঁধন কেটে ফেলে দিল সমুদ্রের জলে।
    দোলনাটার ভারমুক্ত হওয়ার ফলে প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বেলুনটা দ্রুতগতিতে অনেকখানি ওপরে উঠে গেল । কিন্তু কপাল নেহাৎই মন্দ। কিছুতেই কিছু হবার নয়। বেলুনের গ্যাস কমতে কমতে একেবারেই চিপসে পড়ছে। এদিকে বাতাসের বেগও অনেকাংশে কমে এসেছে। ফলে বেলুনটা আবার ধুকতে ধুকতে নিচের দিকে নামতে লাগল। | সকাল পেরিয়ে দুপুর হল। ক্রমে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলেছে। ঘড়িতে প্রায় চারটা বাজে। বেলুন আর সমুদ্রের মাঝখানে আর মাত্র পাঁচশাে ফুট ব্যবধান। ব্যস, তারপরেই যাত্রীদের নিয়ে বেলুনটা ক্রোধােন্মত্ত সমুদ্রের বুকে আছাড় খেয়ে পড়বে।
    পর মুহর্তেই একটা কুকুর তারস্বরে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। আরােহীদের একজন বলল-'মনে হচ্ছে টপ কিছু দেখতে পেয়েছে—কিছু বলতে চাচ্ছে। ' হা-হা, ডাঙা-ঐ তাে ডাঙা! ডাঙা দেখা যাচ্ছে! ঐ যে ডাঙা!'
    ডাঙা। সত্যি ডাঙা দেখা যাচ্ছে বটে। তবে তার দূরত্ব ত্রিশ মাইল তাে হবেই। বাতাস এখনি প্রতিকূল থাকলে। পথটুকু পাড়ি দিতে ঘন্টাখানেক লেগে যাবে। আর এরই মধ্যে বেলুনের গ্যাস বেরিয়ে একেবারে চিপসে যাবে। ব্যস, সমুদ্রের বুকে ধপাস করে পড়তে হবে। এতগুলাে প্রাণীর সলিলসমাধি হয়ে যাবে।
    বেলুনের অভিযাত্রীরা হতাশায় ভেঙে পড়ার জোগাড় হল। তবু তারা মনকে শক্ত করল, যে করেই হােক তাদের আজ্ঞাতপরিচয় দ্বীপটাকে পৌঁছাতে হবেই।
    হায় ঈশ্বর! শেষ রক্ষা বুঝি আর করা গেল না। বেলুনটা ক্রমে আরও চিপসে গিয়ে সমুদ্রের একেবারে কাছাকাছি নেমে গেল। জলের ছিটা লেগে তার নিচের দিকটা ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। মুহূর্তের মধ্যেই পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়াল যে, জলের ঝাপটায় অভিযাত্রীরাও ভিজে গেল । জল ছিটকে এসে নাকে মুখে লাগছে।
    ক্যাপ্টেন আর্তনাদ করে উঠলেন, 'সবাই শরীর থেকে দড়ির বাঁধন খুলে ফেলাে। এবার সবাই দড়ি ধরে বাদুরের মতাে ঝুলতে লাগল। ঢেউয়ের সঙ্গে বারবার 'আছাড় খেয়ে খেয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে এগােতে লাগল।
    ঢেউয়ের ধাক্কা খেতে খেতে অভিযাত্রীরা একসময় অজ্ঞাতপরিচয় দ্বীপটার নরম বালির ওপর আছাড় খেয়ে পড়ল।
    ব্যস, আর এক মুহূর্তও দেরি নয়, অভিযাত্রীরা এক এক করে দড়ি ছেড়ে বালির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগল । পাঁচ-পাঁচজন লােকের বােঝা হাল্কা হওয়ায় বলুনটা ভারমুক্ত হয়ে দ্রুতগতিতে ওপরের দিকে উঠে গেল। চোখের পলবে সটা বাতাসে ভাসতে ভাসতে সবার নজরের বাইরে চলে গেল।
    আনন্দ-উচ্ছাসে অভিভূত হয়ে বেলুনের অভিযাত্রীরা বালির ওপর দিয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল । কিন্তু সে আর কতক্ষণ? অকস্মাৎ সবার মুখে নেমে এল বিষাদের কালাে ছায়া। ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং আর তাঁর প্রিয় কুকুরটা কোথায়? কোথায় তাঁরা? তবে? তবে কি বেলুনেই রয়ে গেলেন?
    আমেরিকার মানুষ যখন গৃহযুদ্ধের তাণ্ডবলীলায় মত্ত, তখনকার এক রােমহর্ষক কাহিনী নিয়ে এ গল্পের অবতারণা। আঠার শাে পঁয়ষট্টি সালের কথা।
    বল্লাহীন অত্যাচার আর সর্বনাশা এ মারণযজ্ঞকে বন্ধ করার অভিপ্রায়ে জেনারেল গ্রান্ট রিচমন্ড নগর অবরােধ করলেন। তিনি দাসপ্রথা উচ্ছেদকারীদের একজন বড় সমর্থক। অভিশপ্ত দাসপ্রথা উচ্ছেদ করার জন্য তিনি সাধ্যাতীত।
    মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড সগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু হায় । এত কিছু সত্ত্বেও তার প্রয়াস ব্যর্থ হল। রিচম নগর আয়ত্তে আনতে পারলেন না। কাজ যেটুকু হল, জেনারেল গ্রন্টের কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসার রিচমন্ড নগরে বন্দি হয়েই রইলেন। আর তাদের ওপর চলতে লাগল বরাহীন অত্যাচারের তাণ্ডব। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন, প্রবীণ ইঞ্জিনিয়ার ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং। আর তাঁর সঙ্গে গারদে ঢুকতে হয়েছে নিউইয়র্ক হারাল্ডের প্রধান সাংবাদিক গিডিয়ান স্পিলেট । চল্লিশের কাছাকাছি তার বয়স। তিনি পিস্তল ও কলম-উভয় ব্যাপারেই সমান পারদর্শী। বন্দি হবার পূর্বমুহুর্তে তিনি দিনলিপির পাতায় লিখেছেন, 'এক পুলিস আমার দিকে রাইফেল উঁচিয়ে নজর রেখে চলেছে। কিন্তু'।
    কর্তব্যকর্মে অবিচল না হলে এমন নজির কেউ সৃষ্টি করতে পারেন? মৃত্যু শিয়রে জেনেও কেউ কি কর্তব্যকর্মে এমন অবিচল থাকতে পারেন? সাংবাদিক গিডিয়ান স্পিলেট এবং প্রবীণ ইঞ্জিনিয়ার ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং পূর্বপরিচিত। নন। তারা কেউই কাউকে চিনতেন না। তবে হ্যা, উভয়েই উভয়ের নাম ও গুণাবলির কথা অনেকবার শুনেছেন।
    সাংবাদিক গিডিয়ান স্পিলেট এবং ইঞ্জিনিয়ার ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং উভয়েই রিচমন্ড নগরের সীমানার মধ্যে বন্দি ছিলেন, কড়া পাহারায়। নগরের সীমানা চেড়ে বাইরে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। একদিন ঘটনাচক্রে তারা পরস্পরের সান্নিধ্যে এলেন। পরিচয় হল। মনের ভাব বিনিময় হল ! মতলব আঁটতে লাগলেন, প্রহরীদের চোখে ধুলাে দিয়ে কীভাবে রিচমন্ড নগর থেকে পালিয়ে যাওয়া যায় ।
    সাইরাস হার্ডিং আর গিডিয়ান স্পিলেট যখন প্রহরীদের চোখে ধুলাে দিয়ে পালিয়ে যাবার মতলব আঁটছেন ঠিক তখনই প্রবল বিক্রমে নেবুচ্যানেজার শহরের মধ্যে ঢুকে গেলেন। তিনি ক্যাপ্টেন হার্ডিং-এর দীর্ঘদিনের ভূত। অনন্য তার প্রভুভক্তি। হার্ডিং বহুদিন আগেই তাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু তার প্রভু শক্রকবলিত। জানতে পেরে কৃতজ্ঞতাবশত দুর্বার গতিতে ঢুকে পড়েছেন নগরের অভ্যন্তরে। তাঁর একমাত্র সঙ্গী ক্যাপ্টেন হার্ডিং-এর প্রিয় কুকুর। | রিচমন্ড নগর অবরােধ করেও জেনারেল গ্রান্ট তেমন সুবিধা করতে পারলেন না। কেবলমাত্র নগরের মানুষগুলাে আটকা পড়ায় কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যস, এর বেশি কিছু নয়। | ব্যাপার দেখে জেনালের লি মহা ফাপরে পড়লেন। তিনি রিচমন্ডের সর্বেসর্বা-শাসনকর্তা। সেনাপতিদের আদেশ পাঠানাে তাে দূরের ব্যাপার, তার পক্ষে যুদ্ধের পরিস্থিতি পর্যন্ত জানা সম্ভব হচ্ছে না। কিছুতেই যখন সুবিধা করতে পারছেন না তখন বুদ্ধি করে একটা বেলুন সংগ্রহ করলেন। ভাবলেন, বেলুনটায় চেপে কয়েকজনকে নগরের বাইরে পাঠিয়ে সেনাধ্যক্ষকে খবর দেবেন।
    জেনারেল লি তার মতলবটাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারলেন না। দমকা বাতাস প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল। কারণ, বাতাসের বেগে বেলুন পথভ্রষ্ট হয়ে অন্য পথে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মনস্ত করলেন, বাতাসের বেগ একটু কমে গেলে তিনি পরিকল্পনাটাকে বাস্তবায়িত করবেন।
    জেনারেল লি তার গােপন অভিসন্ধিটার কথা ক্যাপ্টেন ফরেস্টারের কাছে ব্যক্ত করলেন। ' জেনারেল লি এবং ক্যাপ্টেন ফরেস্টারের গােপন শলাপরামর্শের কথা প্যানক্রফট নামের এক নাবিক গােপন অন্তরাল থেকে শুনে ফেলল। সেও রিচমন্ড নগর থেকে গা-ঢাকা দেয়ার চেষ্টায় বেশ কয়েকদিন ধরে ছোঁক ছোঁক করছে। সে এবার ক্যাপ্টেন হার্ডিং-এর সঙ্গে গােপনে যােগাযােগ করল। বেলুনটা চুবি করে রিচমন্ড গা-ঢাকা দেয়ার সুবর্ণ সুযােগের কথা তাঁর কাছে ব্যক্ত করল। | এমন একটা অপূর্ব সুযােগের কথা শুনে ক্যাপ্টেন হার্ডিং যেন আচমকা আকাশের চাঁদ হাতের মুঠোয় পেয়ে গেলেন । তিনি এবার ব্যস্তপায়ে সাংবাদিক গিডিয়ান স্পিলেটকে অপূর্ব সুযােগ ও গােপন পরিকল্পনাটার কথা জানালেন।
    সাংবাদিক গিডিয়ান স্পিলেট অভাবনীয় পরিকল্পনাটাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তারা পরামর্শের মাধ্যমে স্থির করে ফেললেন, রাত্রি দশটায় বেলুন অভিযান শুরু করবেন।
    বেলুনে চাপার পূর্ব মুহুর্তে ক্যাপ্টেন হার্ডিং ঈশ্বরের কাছে করজোড়ে একটাই প্রার্থনা করলেন, হে ঈশ্বর! ঝড়ের বেগ যেন বন্ধ করে দিও না।'
    স্পিলেট, প্যানক্রফট, নেবুচ্যানেজার আর তার প্রিয় কুকুর টপকে নিয়ে ক্যাপ্টেন হার্ডিং ঈশ্বরের নাম নিয়ে বেলুনে চাপলেন।
    ১৮৬৫ খ্রীস্টাব্দের ২০ মার্চ রাত ঠিক দশটায় অভিযাত্রীদের নিয়ে গ্যাসবর্তি বিশালায়তন বেলুনটা শূন্যে উড়ল। তিরতির করে পথ পাড়ি দিতে শুরু করল।
    | নির্জন-নিরালা দ্বীপের বালির স্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে গিডিয়ান স্পিলেট ফ্যাকাসে বিবর্ণমুখে ভাবতে লাগলেন, ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং কোথায় উধাও হয়ে গেলেন? জলজ্যান্ত একটা লােক একেবারে বেপাত্তা হয়ে গেলেন।
    গিডিয়ান স্পিলেট সঙ্গীসাথীদের নিয়ে চারদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিলেন। বলা তাে যায় না। কোন অসতর্ক মুহর্তে উত্তাল উদ্দাম সমুদ্রের বুকে পড়ে যাওয়াও কিছুমাত্র বিচিত্র নয়।
    একসময় বিস্তীর্ণ দ্বীপ ও অন্তহীন সমুদ্রের বুকে নেমে এল সন্ধ্যার অন্ধকার। অভিযাত্রীরা তবু ক্যাপ্টেন হার্ডিংকে খুঁজে বেড়াতে লাগল। | প্যানক্রফট চমৎকার একটা মতলব বের করলেন, ক্যাপ্টেন হার্ডিং-এর খোঁজ করে অগ্রসর হওয়ার সময় আগুন জ্বেলে পদচিহ্ন রেখে যাওয়া যাক। সকাল হলে ক্যাপ্টেন যদি তাদের খোঁজ করেন তবে অনায়াসেই তাঁদের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন।
    কাঠকুটো তত জোগাড় করা যাবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল আগুন জ্বালা নিয়ে। আগুন জ্বালার কোনাে উপকরণই তাদের কারাে সঙ্গে নেই।

    জুল ভার্ন রচনাসমগ্র : প্যানক্রফট এর পকেটে ম্যাচ একটা ছিল বটে। সমুদ্রের জল সবকিছু ভিজিয়ে জবজবে করে দিলেও সেটার তেমন ক্ষতি করতে পারে নি। | কাঠ জোগাড় করতে গিয়ে হতাশ হতে হল। দীর্ঘ সময় হাঁটাহাটি করেও তারা এক টুকরাে কাঠ জোগাড় করতে পারল না। পারবে কী করে? দ্বীপের এদিকটায় গাছগাছালি মােটে নেই। রুক্ষ-রুষ্ট । কেবল বালি আর বালি।
    একসময় অভিযাত্রীরা হতাশ হয়ে বালির তূপের ওপর বসে পড়লেন। প্যানক্রফট চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ক্যাপ্টেনকে আমরা হয়ত কোনােদিনই খুঁজে বের করতে পারব না। উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্রের মানুষখেকো প্রাণীরা তাকে হয়ত খেয়েই ফেলেছে।'
    মনের জমাটবাধা হতাশা আর হাহাকার গােপন রেখে স্পিলেট দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যক্ত করলেন, 'সকাল হতে ভালাে করে খুঁজলে তাকে অবশ্যই পাওয়া যাবে। যে করেই হােক খুঁজে বের করতেই হবে। এমনও তাে হতে পারে, দ্বীপের কোথাও আছাড় খেয়ে পড়ে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছেন। যার ফলে আমরা তার হদিস পাচ্ছি না। তার নিপ্রাণ। শরীরটাকে নিজের হাতে স্পর্শ না করা পর্যন্ত আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারব না, তিনি আমাদের মধ্যে নেই।'
    ভােরের আলাে ফুটতে না ফুটতেই আবছা অন্ধকার থেকে ছপছপ আওয়াজ ভেসে এল। নেবুচ্যাডনেজার জলে লাফিয়ে পড়ে সাঁতরাতে শুরু করলেন। প্রভুঅন্তঃপ্রাণ নিগ্রোটা নিজের প্রাণের মায়া বিসর্জন দিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে সাঁতরাতে সাঁতরাতে প্রভুর নাম ধরে অনবরত ডাকাডাকি করতে লাগলেন।
    একসময় ছােট্ট একটা নদী পেরিয়ে তিনি বিপরীত পাড়ে হাজির হলেন। অভিযাত্রীরা সারাদিন দ্বীপে হাঁটাহাটি করলেন। ক্ষুধা-তেষ্টায় সবাই কাহিল হয়ে পড়েছেন। ইতিমধ্যে হতাশ হয়ে নেবুচ্যানেজার সঙ্গীদের কাছে ফিরে এসেছেন।
    খাবারের খোঁজে বেরিয়ে অভিযাত্রীরা কিছু ঝিনুক সংগ্রহ করলেন। কাঠকুটো জোগাড় করে আগুন জ্বালালেন। তাদের ইচ্ছা, ঝিনুকগুলাে ভেঙে তাদের মাংস অাগুনে ঝলসে নিয়ে পেটের জ্বালা নেভাবেন। চেষ্টা চরিত্র করে তারা। করলেনও তাই।
    নেবুচ্যানেজার কিন্তু তার প্রভু ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং-এর কথা কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছেন না। তিনি অন্য সবার থেকে দূরে বিষন্নমুখে বসে নিবিষ্টচিত্তে অনবরত প্রভুর কথাই ভেবে চলেছেন। তার একমাত্র চিন্তা, কী। করে প্রভুকে খুঁজে বের করবেন ।
    বেলুনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পূর্ব মুহূর্তে বেলুন থেকে শাবল, গাইতি, কাটারি প্রভৃতি ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছিল। এবার অভিযাত্রীরা এক-এক করে সেগুলাে খুঁজে বের করলেন। জড়াে করলেন এক জায়গায়।
    অভিযাত্রীরা এবার খোজাখুঁজি করে একটা গুহা বের করলেন। আশ্রয় নেবার মতাে উপযুক্ত জায়গাই বটে। • প্যানক্রফট তার গাদা বন্দুকটাও খুঁজে পেলেন।
    সূর্য পশ্চিম আকাশের গায়ে হেলে পড়েছে। অভিযাত্রীরা দ্বীপের বুকে হাঁটাহাঁটি করতে করতে এক বিচিত্র ধরনের পাখি দেখতে পেল ! ইয়া দশাসই তাদের এক একটার চেহারা। প্যানক্রফট গাদা বন্দুক দিয়ে তাদের একটাকে ঘায়েল করতে চেষ্টা করলেন। পারলেন না। এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র তিনি নন। মাথা খাটিয়ে অদ্ভুত একটা ফন্দি বের করলেন। শক্ত অথচ সরু লতার এক প্রান্তে বাবলা কাটার মতাে কাঁটা বেঁধে তাতে কেঁচোর টোপ গেঁথে দিলেন। সেগুলাে পাখির বাসায় রেখে তারা দূরে ঘাপটি মেরে রইলেন। পাখিরা বাসায় ফিরে টোপগুলােকে গপগপ করে গিলতে চেষ্টা করল। ব্যস, কাঁটাগুলাে গলায় বিঁধে শিকারির কজায় পড়ে গেল বহুসংখ্যক পাখি । দারুন কায়দা-কাটার বড়শী দিয়ে পাখি শিকার।
    পাখির মাংস আর ঝিনুকের মাংস পুড়িয়ে ভােজের আয়ােজন করা হল। সে সঙ্গে পাখির ডিমের ওমলেট তাে রইলই।
    নেবুচ্যানেজার-এর মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। প্রভু ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং-এর অনুপস্থিতিই তাঁর বিষন্নতার একমাত্র কারণ। | পাখির ডাকে সকাল হল। অভিযাত্রীরা দেখলেন, নেবুচ্যানেজার গুহায় অনুপস্থিত। তারা ব্যস্ত হয়ে তার খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। সবাই ধরেই নিলেন, তিনি হন্যে হয়ে প্রভুকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
    সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ল। বিকেল হতে না হতেই প্রবল ঝড় উঠল। ঝড়ের প্রকোপ ক্রমে বেড়েই চলল। অভিযাত্রীরা গুহা ছেড়ে বেরােতেই পারলেন না। তখন রাত্রি প্রায় আটটা। অভিযাত্রীরা গুহার ভেতরে গুটিসুটি মেরে বসে। এমন সময় গুহার অদূরে টপ বিকট স্বরে আর্তনাদ জুড়ে দিল।
    অভিযাত্রীরা টপ-এর আর্তস্বর শুনে হুড়মুড় করে গুহার বাইরে বেরিয়ে এলেন। | হার্বাট একসময় চেঁচিয়ে উঠলেন—“তিনি আসছেন। অবশ্যই আসছেন তিনি। প্রভুকে ছাড়া টপ একা ফিরে আসার পাত্র নয়।' | কথা বলতে বলতে হার্বাট একটি জ্বলন্ত কাঠ অন্ধকারে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন-- ‘টপ, আমরা এখানে। এদিকে—এদিকে আমরা।'
    কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই তীব্রস্বরে ঘেউ ঘেউ করতে করতে টপ গুহার মুখে হাজির হল। তাকে একা দেখে সবাই অবাক হলেন। আরও অবাক হলেন, যখন দেখলেন, ঝড়-বাদলের মধ্যে সে ছুটে এসেছে অথচ তার গায়ে এক ফোটাও জল নেই । অসম্ভব—একেবারেই রহস্যজনক এক ব্যাপার। কী করে যে সম্ভব হল তা কারাে পক্ষে অনুমান করাও সম্ভব হল না। রহস্যময় দ্বীপের প্রথম ধাপ।
    স্পিলেট বললেন, 'আমার মনে হয় টপকে যখন পাওয়া গেছে তখন তার প্রভুকেও অবশ্যই পাওয়া যাবে।

    মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড । অস্থিরচিত্ত টপ ঘেউ ঘেউ করতে করতে পিছন ফিরে আবার হাঁটতে লাগল। অভিযাত্রীরা ব্যস্তপায়ে তাকে অনুসরণ করতে লাগলেন।
    টপ আর্তনাদ করতে করতে একটা গর্তের মুখে পৌঁছে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর্তস্বরের মাধ্যমে অভিযাত্রীদের সঙ্কেত দিয়ে টপ অকস্মাৎ গর্তটার মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। | অভিযাত্রী তিনজন কোনােরকম দ্বিধা না করে নিজেদের জীবনের মায়া বিসর্জন দিয়ে টপের পিছন পিছন রহস্যজনক গর্তটার মধ্যে ঢুকে গেলেন। | গর্তটার মধ্যে ঢুকেই অভিযাত্রীরা চমকে উঠলেন। তারা দেখলেন, ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং সংজ্ঞাহীন অবস্থায় এলিয়ে পড়ে রয়েছেন। আর তার শিয়রে বিষমুখে বসে তাঁরই প্রিয় নেবুচ্যাডনেজার।
    স্পিলেট ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে গেলেন। ক্যাপ্টেনের ডানহাতটা তুলে তার নাড়ীর অবস্থা বােঝাবার চেষ্টা করলেন। পরমুহূর্তেই সােল্লাসে বলে উঠলেন—‘আছে। আছে—প্রাণ আছে, ক্যাপ্টেন বেঁচে আছেন।' | নেবুচাড়নেজার যেন অকস্মাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলেন। কণ্ঠস্বরে ব্যস্ততা প্রকাশ করে বলে উঠলেন, 'বেঁচে আছেন? আমার প্রভু বেঁচে আছেন? কীভাবে, কী করলে এখন সংজ্ঞা ফিরে পাবেন বলুন?'
    নেবুচ্যাডনেজার যেন অকস্মাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলেন। কণ্ঠস্বরে ব্যস্ততা প্রকাশ করে বলে উঠলেন, ‘বেঁচে আছেন? আমার প্রভু বেঁচে আছেন? কীভাবে, কী করলে এখন সংজ্ঞা ফিরে পাবেন বলুন? | সংক্ষেপে নেবুচ্যানেজারকে প্রবােধ দিয়ে পিলেট এক মুঠো শুকনাে ঘাস পাতা তুলে নিয়ে ক্যাপ্টেনের হাত ও পায়ের পাতাগুলােতে জোরে জোরে ঘষতে লাগলেন।
    নেবুচ্যানেজার এবার বললেন যে তার প্রভুকে খুঁজে বের করার জন্য গভীর রাতে তিনি সবার অলক্ষে গুহা ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। প্রভুর নাম ধরে গলা ছেড়ে চিৎকার করে দ্বীপে ছুটোছুটি দাপাদাপি করতে লাগল। প্রভুভক্ত কুকুর টপও তার সঙ্গে ছিল। একসময় টপ তার টাউজার ধরে টানতে টানতে গর্তটার ভেতরে নিয়ে গেল। নেবুচ্যানেজার দেখলেন, তার প্রভু ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং সংজ্ঞাহীন অবস্থায় এলিয়ে পড়ে। | স্পিলেটের কাছে এবার রহস্যটা পরিষ্কার হল-ঝড় বৃষ্টির মধ্যেও টপের গায়ে কেন এক ফোটাও জাল লাগে নি ।
    শুকনাে ঘাস-পাতা দিয়ে অনবরত ঘষার ফলে ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং-এর ফ্যাকাশে বিবর্ণমুখে দেখা দিল রক্তের ছােপ । ফিরে এল প্রাণের স্পন্দন । ঠোট দুটো বারবার নাড়তে লাগলেন। স্পিলেট বুঝলেন, তিনি কিছু বলতে চাইছেন। তার মুখের ওপর ঝুকে তাঁকে কথা বলাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন শত চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারলেন না।
    ম্পিলেটের অনুরােধে হার্বাট ও প্যানক্রফট ডালপালা দিয়ে একটা স্ট্রেচারের মতাে তৈরি করে নিয়ে এল। স্পিলেটের সাহায্যে ক্যাপ্টেন কোনােরকমে উঠে বসলেন। ক্যাপ্টেনকে স্ট্রেচারে তুলে অভিযাত্রীরা তাদের আশ্রয়স্থল গুহাটায় নিয়ে এলেন।
    ঝলসানাে পাখির মাংস আর কয়েক ঢােক জল পান করে ক্যাপ্টেন এবার কিছুটা সুস্থ বােধ করতে লাগলেন। তিনি এবার সহযাত্রীদের কাছে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার কাহিনী বলতে লাগলেন, 'সমুদ্রের সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে আমরা যখন এগােচ্ছিলাম তখন আচমকা ডেউয়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে হাতের দড়িটা ফসকে সমুদ্রের বুকে আছাড় খেয়ে পড়ে যাই। ক্রোধােন্মত্ত ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে এগােতে লাগলাম। হঠাৎ দেখি আমার ঠিক আগে আগে প্রিয়। কুকুর টপও সাঁতরে চলেছে। বুঝলাম, আমার পিবদ দেখে সেও জলে ঝাপিয়ে পড়েছিল। পাহাড়সমান ঢেউগুলাের সঙ্গে। লড়াই করে করে আমি কাহিল হয়ে এলিয়ে পড়তে লাগলাম। আমার বিপদ দেখে টপ আমার ট্রাউজারের কোণা কামড়ে ধরে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। টেনে হিচড়ে পাড়ে তুলে নিল। তারপর যে কী হল, কিছুই বলতে পারব না।'
    ম্যাচে দুটো মাত্রই কাঠি ছিল। অনেক আগেই সে দুটো ফুরিয়ে গেছে। আগুন জ্বেলে রাখা হয়েছিল। চেষ্টা করে টিকিয়ে রাখা হয়েছিল দীর্ঘসময়। কিন্তু ক্যাপ্টেনের খোজ করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত সে আগুন নিভে গেছে। | ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং একজন কৃতী বৈজ্ঞানিক। অদ্ভুত তার উদ্ভাবনী ক্ষমতা। পৃথিবীর তাবড় তাবড় বৈজ্ঞানিকরা। আজ পর্যন্ত যেটুকু জানতে পেরেছেন তিনি একাই যেন তা জেনে ফেলেছেন। তার ছােট্ট মাথাটার ওপর তার সহযাত্রীদের অগাধ বিশ্বাস। | প্যানক্রফট কোথায় যেন শুনেছিল, অসভ্য জঙ্গলীরা শুকনাে কাঠে কাঠ ঠুকে আগুন জ্বেলে থাকে। তিনি দু টুকরাে কাঠ সংগ্রহ করে ঠোকাঠুকি করতে লাগলেন। তার কাণ্ডকারখানা দেখে ক্যাপ্টেন বললেন, 'আরে করছ কী হে আগুন জ্বালার জন্য এত ভাবনা কিসের। 

    জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দ্য আর্থ Pdf


    সেটা ছিল ১৮৬৩ সালের ২৪ মে। এ কী ব্যাপার! এরই মধ্যে কাকা বাড়ি ফিরছেন! বেলা দুটোও যে বাজে নি। মহা মুশকিলেই পড়ল মার্থা । কাকা এরকম কাণ্ড করে বসবেন, স্বপ্নেও ভাবে নি সে।
    সংসারের সর্বময়ী কত্রী মার্থা । সব ব্যাপার তাকেই সামলাতে হয়। খুঁটিনাটি ব্যাপার স্যাপার কোথায় কী হয়েছে, কী করতে হবে, তাকেই খেয়াল রাখতে হয় ।
    কাকা বাড়ি ফিরছেন, অথচ কিছুই তৈরি নেই। এমনকি জলটুকু পর্যন্ত গরম হয় নি এখনাে। এমনিতেই যা তিড়িব্ধি মেজাজের মানুষ, পান থেকে চুনটি খসলেই রেগে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন।
    Journey to the centre of the world pdf in Bengali

    ওই তাে কাকা লম্বা লম্বা পায়ে কোনিগট্ৰীস ধরে হাঁটছেন। কিন্তু আর মাত্র আধঘণ্টা পরে এলেই, মার্থার কিছু ভাবনার ছিল না। মার্থা ভীতসন্ত্রস্ত পায়ে জানালার দিকে আরাে দুপা এগিয়ে গেল । পিছনদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় কোনােরকমে উচ্চারণ করল, “দাদা এসে পড়লেন যে!' এবার আমার কাছে এসে বলল, তুমি কাকাকে একটু সামলে নাও। আমার হয়ে একটু বুঝিয়ে বলবে কিন্তু, কথা কটা কোনােরকমে আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে একদৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল।
    কাকে বুঝিয়ে বলব? কাকাকে? তবেই হয়েছে! মার্থা এতদিন পরেও তাকে চিনতে পারল না! নইলে বুঝিয়ে বলার কথা সে মুখে উচ্চারণ করতে পারত না।
    আমার প্রাতঃস্মরণীয় কাকা এই অটো লিড়েন্ত্রক লােকটি রীতিমতাে খিটমিটে মেজাজেয়। বদ মেজাজি বলেও পরিচিত মহলে তার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। এক কথায় লােকটি একটি বারুদের স্তুপ। নিয়মে একটু ব্যতিক্রম হলেই দপ করে জ্বলে ওঠেন। আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় হাতপা ছোড়াছুঁড়ি ও তর্জন গর্জন। মার্থা তাে কচি খুকি, আমি তার বিষয় সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ভয়ে সর্বদা কেঁচো হয়ে থাকি।
    বাড়ি ঢুকেই কাকা খাওয়ার টেবিলের দিকে ছােটেন, আর সেটি যদি খালি দেখেন? এমন হম্বিতম্বি জুড়ে দেবেন যে, ছাদটাই হয়ত ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। আমিও মার্থার পথ বেছে নেব কি না, ভাবতে লাগলাম। ইচ্ছা থাকলেও তা আর হয়ে উঠল না।
    কাটামারা বুটে ঘন ও গম্ভীর আওয়াজ তুলে কাকা বাড়ি ঢুকলেন। ব্যস, আর কথা নয় সােজা হলঘরের দিকে হাঁটতে লাগলেন।
    হল ঘরে ঢুকে টুপিটা ছুঁড়ে দিলেন হুকের দিকে, হাতের ছড়িটি ছুঁড়ে দিলেন কোনের দিকে। এবার তেমনি লম্বা লম্বা পায়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।
    ঘরে ঢুকে কাকা গা থেকে কোটটা খুলে চৌকির দিকে ছুড়ে দিতে গিয়ে গলাফাটানাে চীৎকার জুড়লেন—এ্যাক্সেল শিগগির শুনে যা! | এবার ব্যাপার পরিষ্কার হল, কাকা খেতে আসেন নি। মার্থা তবে এ যাত্রা বেঁচেই গেল। খেতে এলে সােজা মার্থার রান্নাঘরে হাজির হতেন, যাকে শুদ্ধভাষায় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি উদর পূর্তি ল্যাবরেটরি' নাম দিয়েছেন।
    | মার্থা স্বস্তি পেল বটে, আমি কিন্তু মহাসমস্যায় পড়ে গেলাম। এই ভর দুপুরবেলা যদি খনিবিজ্ঞান বা ভূবিদ্যা নিয়ে মজে যান তবে আমার এক্কেবারে সাড়ে সর্বনাশ! আর তাঁর মজে যাওয়া যা তা ব্যাপার নয়, একটানা ছয় সাত ঘণ্টা বকবক করবেন। আর আমার অবস্থা? আহার নিদ্রার প্রয়ােজন সম্পর্কে পুরােপুরি সচেতন থাকা সত্ত্বেও জোর করে ভুলে থাকতে। হয়। তার বক্তব্যের প্রতি আগ্রহের ভান করে বার বার ঘাড় কাত করতে হয়। ব্যাপারটা খােলসা করে বলছি, আমি কেবল অপুত্রক কাকার বংশধর এবং উত্তরাধিকারীই নই, তার গবেষণার সহকারীও বটে। তিনি একজন পৃথিবীর খ্যাতনামা অধ্যাপক। হামবুর্গ শহরের বিখ্যাত সেন্টপলস কলেজে অধ্যাপনা করেন। ভূতত্ব সম্পৰ্কীয় তার সুচিন্তিত মতামত পৃথিবীর সব দেশের পণ্ডিতজনের কাছে সমাদৃত। আর আমি? তার এই সুমহান কর্মযজ্ঞে আমার বিদ্যাবুদ্ধি অনুযায়ী তাকে সাহায্য করে থাকি।
    | আমাকে ভুল বুঝবেন না। আত্মপ্রচার করছি না। এক্সেল নামধারী এই অধমটার বয়স মাত্র চব্বিশ বছর। তবে এটুকু বলতে পারি, সুপণ্ডিত কাকাটি বিজ্ঞানের যে-সব শাখায় প্রভূত জ্ঞান ধারণ করেন, সে-সব বিষয়ে আমিও কম পড়াশুনা করি নি। এ-কথা বলার অর্থ এই নয় যে, আমি তার একজন সুযােগ্য ভাইপাে। তবে এটা তাে মিথ্যে নয়, আমি তারই হাতে গড়া ছাত্র। তার চিন্তাধারা ও প্রদত্ত যুক্তিগুলাের অর্থ বােঝার মতাে ক্ষমতা অন্তত আমার হয়েছে। আর এই জন্য আমাকে কম দুর্ভোগ ভুগতে হয় না। আজকের দুর্ভোগের কথাই ধরুন না, স্নানাহার শিকেয় তুলে তার পাশে বসে, ঘাড় নেড়ে যেতে হবে।
    ভীতসন্ত্রস্ত মনে গুটিগুটি কাকার ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে পা দিলাম। ঘর বললে হয়ত ঠিক বলা হবে না—আস্তাকুঁড়ে ।
    বইয়ের তাকগুলাে দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সত্য। কিন্তু স্থূপীকৃতি বই, অগণিত যন্ত্রপাতি ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তাদের কোনটা বন্ধ, কোনটা আবার খােলা অবস্থায়ই দেখা যাচ্ছে। এরকমই প্রচলিত ব্যবস্থা। জ্ঞানগম্যি হওয়ার আগে এগুলােকে গােছগাছ করে রাখার চেষ্টা করতাম। ব্যস, আর যাবে কোথায়, সঙ্গে সঙ্গে দাঁত খিচুনি। পরিষ্কার বুঝিয়ে দিতেন, ওগুলাে ছোঁয়ার অধিকার আমাকে মােটেই দেয়া হয় নি।

    ব্ল্যাক ডায়মন্ডস Pdf

    ১৮০০ সালের সেরা ডিসেম্বর। ইঞ্জিনিয়ার জেমস স্টার সকালে এক জরুরি কাজের তাগিদে বাড়ি থেকে বেরােবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
    জেমস স্টার যখন কোর্টের শেষ বােতামটা লাগাতে ব্যস্ত ঠিক তখনই সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল। ব্যস্ত হয়ে দরজার শিটকিনি খুলতেই ডাক পিওন সুপ্রভাত জানিয়ে বাদামি রঙের একটা খাম তার হাতে ধরিয়ে দিল।
    জেমস স্টার হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়ে সিলমােহরের দিকে একবার নজর ফিরিয়ে নিলেন। হঁ্যা, সকালের ডাকেই চিঠিটা এসেছে। খামটার গায়ে স্পষ্টাক্ষরে লেখা-“মি. জে, স্টা-ইঞ্জিনিয়ার (ত্রিশ, ক্যানন গেট, এডিনবরা) সমীপেষু.
    খামটার সামান্য অংশ ছিড়তেই জেমস স্টার দেখলেন, হালকা আকাশী রঙের এক চিলতে কাগজ ভেতর থেকে উকি দিচ্ছে।
    বুড়ো ওভারম্যান সাইমন ফোর্ড চিঠিটা লিখেছেন। চিঠির বক্তব্য-“মি, জেমস স্টার, আগামীকাল আবারফয়েল কয়লাখনিতে এলে (ডােচার্ট পিট, ইয়ারাে শ্যাফট) এমন একটা ব্যাপার সম্বন্ধে অভিহিত হতে পারবেন, যা আপনার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত এবং আকর্ষণীয় বিবেচিত হবে।"

    সাইমন ফোর্ড চিঠিতে এও জানালেন, প্রাক্তন ওভারম্যান সাইমন ফোর্ডের ছেলে হ্যারি ফোর্ড মি. জেমস স্টারের অপেক্ষায় ক্যালানডার স্টেশনে উপস্থিত থাকবে। আর বিশেষ একটা সনির্বন্ধ অনুরােধও করেছেন, তিনি যেন এ গােপন অনুরােধের ব্যাপারটা কারাে কাছেই ফাস না করেন। | জেমসন্টার চিঠিটা গােড়া থেকে শেষপর্যন্ত বারবার অত্যুত্র আগ্রহের সঙ্গে পড়লেন। তার মধ্যে কেমন যেন একটা অবর্ণনীয় মানসিক উত্তেজনা ভর করল। বারবার পড়েও চিঠিটার বক্তব্যে সামান্যতমও প্রবঞ্চনার আভাস লক্ষিত হল না। অর্থাৎ চিঠিটার বক্তব্যের মধ্যে তার মনে বিরূপ কোনাে চিন্তারই উদয় হল না। ওভারম্যান সাইমন ফোর্ড দীর্ঘদিনের সহকর্ম হিসাবে তারা কাছাকাছি পাশাপাশি অবস্থান করেছেন। | ইঞ্জিনিয়ার-জীবনের পঞ্চান্নটা বসন্ত পেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু তাকে একনজরে দেখলে চল্লিশ বছরের বেশি বয়স মনেই হয় না। ব্রিটেনে যারা পদের অবদানে উন্নতির চরম শিখরে আরােহণ করেছেন, ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোেক তাদের অন্যতম বিবেচিত হন।
    ব্রিটিশ যুক্তরাত্রের অন্ধকার পাতালপুরী থেকে কয়লার স্তর ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে তুলে আনার ওপরে নির্ভর করে আজকের যে অপ্রত্যাশিত সাফল্য, তার মূলে রয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার জেমস স্টার। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, অ্যাবার ফয়েল কয়লাখনির ব্যাপারে তার নাম আগে উল্লেখ করতে হয় ।
    দিনের পর দিন কয়লাখনির সংখ্যা বৃদ্ধি আর সবদিক থেকে উত্তোলনের উন্নতির সঙ্গে তাল রেখে কয়লার চাহিদাও বেড়েই চলেছে। আর সে চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে বহু খনি নিঃস্ব—একেবারে অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছে। অনবরত। কালাে হীরা জোগান দিয়ে আবারফয়েল আজ সম্পূর্ণরূপে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। আর আজ সেটা একবারেই অবহেলিত।
    আজ থেকে দশ বছর আগের ঘটনা। শেষদিন একটন কালাে হীরা উপহার দিয়ে অ্যাবারফয়েল রিক্ততা ঘােষণা করে। বাধ্য হয়েই খনির মালিক পাতালপুরী থেকে সাধ্যমতো যন্ত্রাংশ তুলে নিয়ে এলেন। কয়লা বহন করার ঠেলাগাড়ি, লিফটের খাচা আর বাতাস সরবরাহের নল প্রভৃতি পাতালপুরীর গহ্বর থেকে তুলে এনে পর্বতপ্রমাণ উঁচু করে পাজা করে। ফেলে রেখেছেন।
    আজ অতিকায় বীভৎস চেহারাধারী বহুপদ জানােয়ারের কঙ্কালের মতাে পড়ে রয়েছে নিঃস্ব-রিক্ত যক্ষপুরী কয়লাখনিটা। আচমকা একনজর দেখলেই আঁতকে উঠতে হয়। খনিগর্ভ থেকে যাবতীয় যন্ত্রপাতি তুলে আনলেও একটামাত্র নড়বড়ে সিড়ি আজও মায়া কাটিয়ে খনি ছেড়ে আসতে পারে নি। অব্যবহৃত-অবহেলিত অবস্থায় সেটা আজও একই জায়গায় পড়ে ধুকছে। | শেষের সেদিনটার স্মৃতি জেমস স্টার-এর অন্তরের গভীরে আজও জ্বলজ্বল করছে। প্রবেশপথের একধারে তিনি দাড়িয়ে রয়েছেন। ডােচার্ট পিটের ওভারম্যান সাইমন বাের্ড (তখন পঞ্চান্ন বছর বয়স্ক) আর কয়েকজন বিভাগীয় ম্যানেজার তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সবার মুখেই বিষন্নতার ছাপ সুস্পষ্ট। আর অন্তরের অন্তস্থলে অন্তহীন হতাশা আর হাহাকার। সবাই মাথা থেকে টুপি নামিয়ে হাতে ধরে রেখেছেন। চোখের তারার নীরব ভাষা—খনি নিঃস্ব রিক্ত। এক টুকরাে কয়লাও অবশিষ্ট নেই। সে বছর খনির কয়লা কুড়িয়ে কুড়িয়ে যে লাভ হয়েছিল তা কর্মীদের মধ্যে সমহারে বিলি করে দেয়া হয়। যাতে নতুন চাকরি জোগাড় না হওয়া পর্যন্ত অন্তত রুটির জোগাড় তাদের হতে পার। ইঞ্জিনিয়ার জেমস। স্টার সবাইকে চিরদিনের মত বিদায় সম্ভাষণ জ্ঞাপন করলেন। বিদায় মুহূর্তে তার মুখ থেকে কিছু শােনার জন্য সবাই। অধীর প্রতীক্ষায় দাড়িয়ে।
    ইঞ্জিনিয়ার জেমস স্টার বিষন্নমুখে শ্লেম্মাজড়িত ভাঙা ভাঙা গলায় কোনােরকমে উচ্চারণ করলেন, 'বন্ধুগণ, আমাদের বিচ্ছদের মুহূর্ত আসন্ন। যে কয়লাখানি একদিন আমাদের সবাইকে সহৃদয়তা ও আন্তরিকতার ডােরে বেঁধে কাজে নিযুক্ত করেছিল আজ সে নিস্ব রিক্ত। দীর্ঘদিন খোজাখুজি করেও আমাদের নিদারুণভাবে ব্যর্থ হতে হয়েছে-কিন্তু কোনাে স্তরেরই হদিস পাওয়া যায় নি। এইমাত্র ডােচাৰ্ট পিট থেকে শেষ চাইটাকেও তুলে আনা হয়েছে, আপনারা তাে দেখলেনই।'

    বেগমস ফরচুন Pdf

    ব্রাইটন হােটেলের বৈঠকখানায় ডক্টর সারাসিন আরাম কেদারায় শরীর এলিয়ে দিয়ে একটা খবরের কাগজের ওপর চোখ বুলাচ্ছেন। রক্তকণিকার গণকযন্ত্র' নামে তার লেখা একটা প্রবন্ধ খবরের কাগজটার পাতায় ছাপা হয়েছে। সেটার ওপরেই তিনি আগ্রহ ভরে চোখের মণি দুটো বুলাচ্ছেন। তার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। এক নজরে দেখলেই মনে হয় তিনি মানুষ হিসাবে একদম সাচ্চা।
    রক্তকণিকার গণকযন্ত্র ড. সারাসিন-এরই সদ্য আবিষ্কৃত একটা যন্ত্র।
    ড. সারাসিন যখন খবরের কাগজের পাতায় মন-প্রাণ সঁপে দিয়ে তন্ময় হয়ে আছেন ঠিক তখনই হােটেলের এক বয় এসে তার হাতে একটা ভিজিটিং কার্ড দিল। কার্ডটার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। তাতে ছাপা রয়েছে, ‘ডব্লিউ, এইচ, শার্প জুনিয়র, সলিসিটর, চুরানব্বই সাদামটন রাে, লন্ডন।'
    ড. সারাসিন-এর অনুমতি পেয়ে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই এক তরুণ ঘরে ঢুকে নমস্কার জানাল। শীর্ণ চেহারা। এক কথায় বলা চলে চলন্ত একটা কঙ্কাল ঘরে ঢুকল। আগন্তুক তরুণ নমস্কার জানিয়ে মাথার টুপি আর হাতের ব্যাগটা মেঝেতে রাখল । ড. সারাসিন বসতে বলার আগেই সে চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল। কোনােরকম ভূমিকার অবতারণা না করেই তার বক্তব্য শুরু করল, আমার নাম উইলিয়ম হেনরি শার্প জুনিয়র। বিলােজ গ্রিন শার্প অ্যান্ড কোম্পানির পক্ষ থেকে আপনার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা বলতে এসেছি। ভালাে কথা, আমি ডা, ফ্রাঁসােয়া সারাসিন-এর সঙ্গেই কথা বলছি তাে? আর আপনি তাে দোয়াই-এর অধিবাসী, ঠিক কিনা ?
    ড. সারাসিন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখেল দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, হ্যা, দু-ই সত্য। আমিই ডা, সারাসিন।
    “আর আপনার বাবা ইসিদোর সারাসিন, ঠিক কিনা ? ‘হ্যা, এ-ও ঠিক।'
    আগন্তুক উইলিয়ম হেনরি কোটের ভেতরের পকেট থেকে এক চিলতে কাগজ বের করে গলা ছেড়ে পড়তে লাগল-আঠারাে শ' সাতান্ন খ্রিস্টাব্দে ইসিদোর সারাসিন 'ইকোডেস' নামে প্যারিসের এক হােটেলে মারা গিয়েছিলেন। সে হােটেলটা এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেনাবিভাগে ছিলেন অ্যারােনডিসেমেন্ট, রুটাবানি, নম্বর চুয়ান্ন।” | ড. সারাসিন হকচকিয়ে বলে উঠলেন, “হ্যা, একদম ঠিক বটে। অনুগ্রহ করে বলুন তাে'
    আগন্তুক তরুণ উইলিয়ম হেনরি তাঁর কথায় কর্ণপাত না করে পড়ে চলল, "জা জ্যাকুইস ল্যাভেল ছিল আপনার পিতামহীর ভ্রাতার নাম। ড্রাম মেজর ছিলেন সেনাবিভাগের ছত্রিশ নম্বর লাইট'
    তাঁকে ছত্রটা শেষ করতে না দিয়েই ড. সারাসিন বলে উঠলেন, 'মশাই আমার বাপ-ঠাকুরদার নাম আপনি যা কিছু জানেন আমার তা-ও জানা নেই। কেবলমাত্র একটুকুই জানি যে, আমার ঠাকুরমার বংশের পদবী ল্যাঙ্গেল’ ছিল।'
    উইলিয়ম হেনরি পড়ে চললেন, 'আপনার মাতামহী আঠারাে শ' সাত খ্রিস্টাব্দে আপনার পিতামহকে নিয়ে বালিক নগরে ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। সতের শ’ নিরানব্বই-এ জ সারাসিন-এর সঙ্গে আপনার পিতামহীর বিয়ে হয়। মেলুন নগরে আপনার পিতামহ টিনের মিস্ত্রীর কাজ আরম্ভ করেন। সে নগরেই আঠারাে শ' এগারােতে আপানার পিতা ইসিদোর সারাসিনকে রেখে আপনার পিতামহী পরলােক গমন করেন। তার পর থেকেই আপনার পিতার মৃত্যু পর্যন্ত কোনাে খবরই পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।'
    তার কথা শেষ হতে না হতেই ড, সারাসিন বললেন, আমার কাছ থেকে খবরটা শুনুন। বংশপঞ্জীর নির্ভুল বক্তব্য শুনে চমকে ওঠা সত্ত্বেও বলতে লাগলেন, 'আমার পিতামহ আমার পিতাকে চিকিৎসাবিদ্যা পড়াবার সুবাদে প্যারিসে বসবাস করতে লাগলেন। তিনি আঠারাে শ’ বত্রিশে পরলােক গমন করেন। আমার বাবার ডাক্তারি ব্যবসা রমরমা হয়ে উঠল । তার মৃত্যুস্থান, প্যালেসু নগরে। আঠারাে শ’ বাইশে আমি সেখানেই জন্মগ্রহণ করি।
    উইলিয়ম হেনরি বললেন, আমি আপনার সন্ধানই করছি। আপনার কোনাে ভাই-বোেন— তার মুখের কথা শেষ হবার আগেই ড, সারাসিন বলে উঠলেন, 'না, কেউ-ই নেই। মা বাবার একমাত্র সন্তান আমি। আমি দু-বছরের তখনই মা স্বর্গে চলে যান।' মুহূর্তকাল নীরবে কাটিয়ে উইলিয়ম হেনরি বললেন 'আপনাকে খুঁজে পাওয়ায় আমি খুবই খুশি হয়েছি। আপনাকে অভিনন্দন জানাতেই হচ্ছে।' | ড, সারাসিন ভাবলেন, আগন্তুক নির্ঘাৎ ছিটগ্রস্ত। এরকম চোয়ালভাঙা কাঠখােট্টা মানুষগুলাে একটু-আধটু ছিটেলেই হয়ে থাকে। | সলিসিটর উইলিয়ম হেনরি যেন ডাক্তারের মুখ দেখেই তার মনের কথা বুঝে নিলেন। হাসিমাখা মুখেই বললেন, ‘মশাই আমি আদৌ পাগল বা ছিটেল-টিটেল নই। রাজা ব্রায়া জবাহির মথুরানাথ-রাজা উপাধির একমাত্র উত্তরাধিকারী। আপনিই । আঠারাে শ' উনিশে আপনার পিতামহীর ভ্রাতা জঁ জ্যাকুইল ল্যাভেল বৃটিশ নাগরিকত্ব লাভের পর এ-উপাধি লাভ করেছিলেন। আঠারাে শ’ চৌদ্দতে তাঁর স্ত্রী বেগম গােকুল পরলােক গমন করেন। তাঁদের একমাত্র সন্তান অল্পবুদ্ধি পুত্র পরােপারে চলে যান আঠারাে শ' উনসত্তরে। তাই বাংলার গভর্ণর জেনারেল আপনার পিতামহীর ভ্রাতা রাজা র্জা জ্যাকুইস ল্যাভেলকে বেগম গােকুল-এর যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করেন। গত ত্রিশ বছরে সেসম্পত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে পেয়ে পঞ্চাশ পাউন্ড স্টার্লিং-এ পরিণত হয়েছে। আর তা বিশেষ হেফাজতে রাখা হয় এবং জুল ভার্ন। 

    এ ফ্লোটিং সিটি Pdf

    ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মার্চ। লিভারপুলে গিয়ে গ্রেট ইস্টার্ন জাহাজের একটা বার্থ বুক করে ফেললাম। আমার বহুদিনের আকাক্সক্ষা কয়েকদিনের মধ্যেই পূর্ণ হতে চলেছে। জাহাজে করে আটলান্টিক মহাসাগর অতিক্রম করে পৌছে যাব নিউইয়র্ক সিটিতে ।
    সত্যি বলতে কি, গ্রেট ইন্টার্ন যে নিছকই একটা জাহাজমাত্র, তা তাে নয়। বরং একে ছােটখাটো একটা পৃথিবী বলা চলে। দূর থেকে দেখলে একে রীতিমতাে সমুদ্রের বুকে ভাসমান একটা দ্বীপ বলে মনে হয়। | জাহাজ ছাড়ার পূর্বমুহর্তের চাঞ্চল্যটুকু চাক্ষুষ করার জন্য কাপ্তেনকে অনুরােধ করে জাহাজ ছাড়ার একদিন আগে অর্থাৎ উনিশে মার্চ, জাহাজে চাপার ব্যবস্থা করলাম। পরদিন, অর্থাৎ বিশে মার্চে জাহাজ ছাড়বে।
    মালপত্র নিয়ে জেটিতে পা দিতেই এক যুবকের মুখোমুখি হলাম। ভদ্রলােকের মুখটা খুবই পরিচিত মনে হল। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে আমার এক দোস্ত আছে। সেও ঠিক এরকমই দেখতে। এখন সে বোম্বাইয়ে। আর সে তাে খুবই আমুদে প্রকৃতির। কিন্তু এ ভদ্রলােকটিকে খুবই মনমরা দেখাচ্ছে। মনে হয়ে শােক জ্বালায় জর্জরিত।
    শেষপর্যন্ত ভাসমান শহর গ্রেট ইন্টার্নে পৌছতে পারলাম জেটি থেকে তিন মাইল পথ নৌকায় পাড়ি দিয়ে।
    মালপত্র লটবহরসহ জাহাজে উঠে গেলাম। জাহাজে ওঠার পর চুপটি করে বসে থাকা সম্ভব হল না। জাহাজে উঠে গিয়ে প্যাডল-বাক্সটাকে দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। বার ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট কেবলমাত্র প্যাডল-বাক্সটারই ওজন নব্বই টন, ভাবা যায়!
    জাহাজের ভেতরের অবিশ্বাস্য ব্যাপারস্যাপর দেখে তাে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবার জোগাড় হল। মায় ইঞ্জিন ঘরের লাগােয়া একটা হােটেল পর্যন্ত রয়েছে দেখতে পেলাম।
    জানতে পারলাম, বিশে মার্চ গ্রেট ইন্টার্ন-এর নােঙর তােলার কথা থাকলেও ছাড়তে কিছু দেরি হবে। জোর কদমে। সারাইয়ের কাজকর্ম চলছে।
    গ্রেট ইস্টার্ন মােট বিশবার আটলান্টিক অতিক্রম করেছে। কিন্তু শেষের দিকে ভয়ঙ্কর একটা দুর্ঘটনার ফলে জাহাজটা বাতিল হয়ে যায়। এটা যাত্রীবাহী জাহাজ হলেও এতে আর পা দিতে কেউ উৎসাহী হত না। শেষ অবধি পরিস্থিতি এমন হল যে, এমন বিশালায়তন একটা জাহাজ নষ্ট হয়ে যাবার জোগার হল।
    | সে সময়ে আটলান্টিকের তলদেশ দিয়ে টেলিগ্রাফের তার টানার ব্যাপার নিয়ে মহা মুশকিল দেখা দিল। ছােট জাহাজে তার পাততেই ইঞ্জিনিয়াররা রীতিমতাে ফাপড়ে পড়ে যায়। কিন্তু গ্রেট ইস্টার্নকে অন্য সব কাজ থেকে বাতিল করে দেওয়ার পর দেখা গেল একাজে এটাই অতুলনীয়। একুশ শ' মাইল দীর্ঘ এবং পঁয়তাল্লিশ শ' টন ওজন বিশিষ্ট ধাতব তার গ্রেট ইস্টার্ন ছাড়া আর কোনাে জাহাজই বা বইতে সক্ষম?
    এমন বিপুল পরিমাণ ওজন বইতে হলে বিশেষ বন্দোবস্ত করতেই হবে। সে জন্যই তাে বিশালায়তন তিনটে ফানেলের মধ্য থেকে একটাকে, অতিকায় ছ'টা বয়লারের মধ্য থেকে দুটোকে তুলে নেওয়া হল। সেখানে একটা জলের ট্যাঙ্ককে স্থান দেওয়া হল। জলীয় বাষ্প যাতে তারগুলােকে বরবাদ করে না দেয় সে জন্য সেগুলােকে ট্যাঙ্কের জলে ডুবিয়ে রাখা হল।
    তার পাতার কাজ মিটে গেলে বিশালায়তন জাহাজটা বন্দরে পড়ে রইল। ফ্রান্সের একটা প্রতিষ্ঠান এবার এতে উৎসাহী হল । তারা কাড়িকাড়ি অর্থ ব্যয় করে গ্রেট ইস্টার্নকে যাত্রী বহনযােগ্য করে তােলার মতলব আঁটল। লিভারপুলের একটা প্রতিষ্ঠানকে কনট্রাক্ট দিল, কাজ সম্পন্ন করার জন্য অন্য একটা প্রতিষ্ঠানের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হল। তাই তাে পূর্ব নির্ধারিত সময়ে জাহাজ নােঙর তুলতে পারছে না।
    দিনরাত পুরােদমে কাজ করে ঠিক হল গ্রেট ইস্টার্ন ছাব্বিশে মার্চ ফের নােঙর তুলবে। খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলাম, জাহাজে বার শ' থেকে তেরাে শ’ যাত্রী যাত্রা করবে। ভাসমান-শহরটার অত্যাশ্চর্য ব্যাপার-স্যাপার, মেরামতি কাজকর্ম অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে দেখে বেড়াতে লাগলাম।
    তাকে দেখে এবার ঠিকই চিনতে পারলাম। জেটিতে সেদিন একেই দেখেছিলাম বটে। তার নাম ফেবিয়ান। আমেরিকা চলেছে এক মাসের ছুটির দিনগুলাে উপভােগ করতে । ভারত থেকেই এসেছে। গােদাবরি জাহাজে চেপে এ পর্যন্ত পৌঁছেছে।
    আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বিষন্ন মুখে ফেবিয়ান কথাটা ছুঁড়ে দিল, ‘মনটাকে অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখার জন্য দেশ পর্যটনে বেরােতেই হল।
    নােঙর তুলেতে গিয়েই প্রথম দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল। এ কাজের জন্য জাহাজের গলুইতে ছেষটি অশ্বশক্তি সম্পন্ন ইঞ্জিন বসানাে ছিল। সিলিন্ডারের মাধ্যমে বয়লার থেকে বাষ্প চালান দিলে তার চাপে তীব্র গতিতে সেটা ঘুরতে আরম্ভ করে।

    অ্যাড্রিফট ইন দ্য প্যাসিফিক
    Pdf

    উত্তাল উদ্দাম সমুদ্রের বুকে মােচার খােলার মতাে একটা কেনাে ঢেউয়ের তালে তালে ভেসে চলেছে। কেননার যাত্রীদের মধ্যে বয়স্ক একজনও নেই, সবার বয়সই কম। কেননাটা আচমকা একটা দ্বীপের গায়ে আছাড় খেয়ে পড়ল। সর্বনাশ! এখন উপায়?
    মাত্র জনাকয়েক অল্প বয়স্ক ছেলে দুটো মাধুলযুক্ত কেনােটাকে চালাচ্ছে। ক্রোধােনান্মত্ত সমুদ্রের ঢেউয়ের চাপে কেনােটা বারবার ডুবে যেতে গিয়েও বারবার ভেসে উঠেছে। জাহাজের চালকরা অল্পবয়স্ক মাওয়ালী ছেলে। মাওয়ালীদের ডাঙার চেয়ে উত্তাল সমুদ্রের সঙ্গেই বেশি মিতালি। যে পিছনে শক্তভাবে মুঠো করে হাল ধরে বসে সেও বছর তেরাের এক মাওয়ালী ছেলে। নাম তার মােকো। নিউজিল্যান্ডে বাড়ি!
    কেননার সামনের দিকে যে তিনটে ছেলে চোখের তারায় হতাশার ছাপ এঁকে বিবর্ণ মুখে বসে রয়েছে তাদের মধ্যে বেশি বয়স্ক তার বয়স মাত্র চৌদ্দ বছর, নাম ব্রান্ট। আর বাকি দুজনের একজন ডােনাগান অন্য জনের নাম গর্ডন।
    মাথা সমান এক একটা ঢেউ এসে আছাড় খেয়ে কেনােটার গায়ে পড়ছে, তাই চোখের পলকে চারজনই ডেকের। ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগল। মােকো কিন্তু কিছুতেই হাল থেকে হাত সরাচ্ছে না, হাতের মুঠো শিথিল পর্যন্তও করছে না। দাঁতে দাঁত চেপে হাল ধরে রেখে মরিয়া হয়ে কেনােটাকে রক্ষা করে চলেছে। একমাত্র তার আন্তরিক প্রয়াসের জন্যই কেনােটা এমন অক্ষত রয়েছে আর চার-চারটে ছেলেও প্রাণে বেঁচে রয়েছে। কেনােটা ডুবু ডুবু হয়েও বারবারই রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে।
    আকাশছোঁয়া প্রকাণ্ড একটা ঢেউয়ের ধাক্কায় ডেকের কামরার একটা দরজা দুম করে খুলে গেল। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে একটা কুকুর গর্জে উঠল। আতঙ্কে সবার কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার জোগাড় হল। ধমকে-ধামকে ব্রান্ট আবার তাকে কামরার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। * এবার আচমকা আর একটা দরজা খুলে একটা ছেলে বেরিয়ে এসে ব্রান্টের কাছে বলল, আমি কি তােমার কোন সাহায্যে লাগতে পারি ?
    'না, তােমাকে এদিকে কিছুই করতে হবে না। তুমি বাচ্চাকাচ্চাগুলােকে দেখাশােনা কর। আশ্চর্য ব্যাপার তাে-ওয়েব, সার্ভিস আর ক্লম করছে কি! অরা থাকতে বাচ্চাগুলাে কেঁদে সারা হচ্ছে, ব্যাপার কী? | ব্রান্ট সবাইকে ধমকে ও ঠেলে ধাক্কিয়ে কামরার ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। আগের চারজনই কেবল বাইরে, ডেকে থেকে গেল।
    | এবার আর একটা প্রকাণ্ড-ঢেউ এসে কেনােটাকে একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দিল। একটা মাস্তুলও হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সমুদ্রের জলে। তার পালটা ছিড়ে একেবারে ফঁাসার্ফাসা হয়ে গেল। মুহুর্তের মধ্যেই ছােট মাস্তুলটার পালও ছিড়ে গেল। চরম সঙ্কট । কেননাটা আরাে অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে গেল।
    আবার একটা ঢেউ তীব্র-গর্জন করতে করতে কেনােটার গায়ে আছাড় খেয়ে পড়ল। এমন সময়, তীব্র আর্তনাদ শুনে ব্রান্ট হন্দদন্ত হয়ে এগিয়ে এল। দেখল, মােকো জাহাজের সামনের গলুইয়ের ফাঁকে, অতিকায় একটা পিপের তলায় পড়ে কাড়াচ্ছে। বেরিয়ে আসার সাধ্য তার নেই। | মােকোকে টানাটানি করে বের করে আনা হল। সারা রাত্রি ক্রোধােন্মত্ত সমুদ্রের সঙ্গে চারটে ছেলে মরিয়া হয়ে লড়াই করে কোনােরকমে কেনােটাকে রক্ষা করতে পারল।
    পূর্ব-আকাশে ফুটে উঠল ভােরের আলাে । সে আলােকরশ্মি চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই দূরে, বহুদূরে অস্পষ্ট একটা কালাে রেখা দেখা গেল। ছেলে চারটের বুঝতে ভুল হল না, ডাঙা দেখা যাচ্ছে।
    হায়! এ কী হল। এত চেষ্টা-চরিত্র সবই বিফলে যাবে নাকি! ডাঙার সিকি মাইল দুরে বালির চরায় কেনােটা আটকে গেল।
    ছেলেদের দলের পাণ্ডা ব্রান্ট। সেই বয়সে সবার চেয়ে বড়। ব্রান্ট আর তার ভাই জ্যাক ফরাসি। আর অন্য সবাই ইংরেজ। তারা সংখ্যায় পনেরাে জন। তবে গর্ডন ছাড়া, সে আমেরিকান।
    ডােনাগানের নেতৃত্বে একদল ছেলে কেননার একমাত্র ডিঙিটা নিয়ে জলে নামার উদ্যোগ নিতে লাগল। ব্রান্টের খবরদারির ধার তারা ধারে না। আসলে ইংরেজ বলেই ফরাসি কিশাের ব্রান্টের কর্তৃত্ব বরদাস্ত করতে নারাজ। শেষপর্যন্ত ব্রান্ট ধমক-ধামক দিয়ে সবাইকে নিরস্ত করল।
    | ব্রান্ট উপায়ন্তর না দেখে জলে ঝাপিয়ে পড়ল। কোমরে রশি বেঁধে তীরের দিকে সাঁতরে ডাঙায় ওঠার চেষ্টা করল। তার পরিকল্পনা, ডাঙায় উঠে রশি টেনে কেনােটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। উদ্দেশ্য ব্যর্থ হল। ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে নাজেহাল হয়ে সে কোনােরকমে কেনােতে উঠে আসতে বাধ্য হল। | বরাত ভালাে যে, কেনােটার তলা ফেঁসে যায় নি। বালির ওপর চোরাপাথরের ফঁাকে আটকা পড়ে গেছে, বেশি কিছু নয়।
    কেনাের সবাই দ্বীপটার দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এত কাছে এসেও ডাঙা স্পর্শ করতে পারছে না, কম আপশােষের কথা ?
    আচমকা আকাশচুম্বী একটা ঢেউ এসে অবিশ্বাস্য একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল। চোখের পলকে মােচার ভােলার মতাে কেনােটাকে শূন্যে তুলে নিয়ে দ্বীপের ওপর আছাড় মেলে ফেলে দিল।

    স্টিম হাউস Pdf

    দেয়ালে সাঁটা পােস্টারটাকে এক হেঁচকা টানে ছিড়ে ফেলে দিয়ে বিচিত্র চরিত্রের এক ফেরারি-ফকির ভিড়ের মধ্যে মিশে মুহূর্তে একেবারে বেপাত্তা হয়ে গেল। | গাট্টাগােট্টা তার দৈহিক গঠন। গায়ে হাতির শক্তি ধরে । বয়স বছর চল্লিশেক। তাকে হঠাৎ করে চেনার একটাই উপায়, বাঁ-হাতের একটা আঙুল অনুপস্থিত। কাটা গেছে। এরকম বেশ কিছু সংখ্যক পােস্টার ঔরাঙ্গাবাদের সব কটা পথের ধারে ধারে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। পথের বাঁকে বাঁকে ঢোল পিটিয়ে পােস্টারের বক্তব্য জনগণের মধ্যে প্রচার করা হয়েছে। ব্যবস্থার কোনােই ক্রটি নেই। নানা সাহেবকে যে বা যারা ধরিয়ে দিতে পারবে, মােটা পুরস্কার প্রদান করা হবে। জীবিত বা মৃত যে কোনাে অবস্থাতে তাকে ধরিয়ে দিতে পারলেই এ পুরস্কার দেওয়া হবে।
    | পােস্টারের বক্তব্য নিয়ে হাটে-বাজারে, পথে-ঘাটে এবং নদীর ঘাটে সর্বত্র একই আলােচনা চলতে লাগল। পুরস্কারের অর্থের লােভটাই আসল ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে।
    আঠারাে শ' সাতান্ন খ্রিষ্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের পর পুরাে দশ দশটা বছর কেটে গেল। সিপাহী বিদ্রোহের কর্ণধার নাকি নেপালে গিয়ে আত্মগােপন করেছিল। এখন ঔরঙ্গাবাদেই এসে মাথা গুঁজেছে, নানাহেব । ইংরেজদের চোখে ধূলাে দিয়ে তিনি অশরীরী ছায়ামূর্তির মতােই এ-বিশাল উপমহাদেশের পথে-প্রান্তরে, আনাচে-কানাচে দিব্যি চলাফেরা করছেন। শত্রু নিপাত করাই বিদেশী শাসকের একান্ত ইচ্ছা। বলা তাে যায় না, চীনের সঙ্গে জোট বেঁধে হয়তাে আবার দেশের বুকে বিদ্রোহের জোয়ার বইয়ে দিতেও পারে।
    . পথ চলতে গিয়ে কিছু লােককে পথের ধারে ভিড় করে কথাবার্তা বলতে দেখে ফকির থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল, কে একজন হম্বি-তম্বি করে কি সব বলছে। দীর্ঘদিন সে নানা সাহেবের শিবিরে বন্দি ছিল। সে সুবাদে নানা সাহেব তার পরিচিত। এখন বাদলা নেবার সুযােগ এসেছে। যে করেই হােক, নানা সাহেবকে ধরে ইংরেজদের হাতে সে তুলে দেবেই।
    ভিড়ের মধ্য থেকে একজন মন্তব্য করল, নানা সাহেব খতম হয়ে গেছে। আঙুল-কাটা একটা মৃতদেহও পাওয়া গেছে। তীব্র প্রতিবাদ করে উঠল বদলা নিতে ইচ্ছুক সেই লােকটা-না, অবশ্যই না। একটা মৃতদেহের আঙুল কেটে বাদ দিয়ে পুলিশের দরবারে আনা হয়েছিল। নানা সাহেব জীবিত, অবশ্যই জীবিত। প্রমাণ সে করবেই করবে। | কথাটা কানে যেতেই সচকিত হয়ে ফকির ঝট করে তার কাটা-আঙুল সমেত হাতটাকে আলখাল্লার ভেতরে চালান দিয়ে দিলেন। ক্রোধে ফেটে পড়ার জোগাড় হল। তবে লুকোবার চেষ্টা না করে লােকটার প্রতি সর্তক দৃষ্টি রাখতে লাগলেন । দেখতে পেলেন, সে নদীর ধারে গিয়ে একটা নৌকায় উঠে পড়ল। ওইটাই তার মাথাগোঁজার অবলম্বন। | সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসতেই ফকির হঠাৎ তার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে হাতের ছুরিটাকে তার বুকে গেঁথে দিলেন। মহুর্তে সব শেষ হয়ে গেল। তার দেহ থেকে আত্মাটা বেরিয়ে যাবার ঠিক আগে সে ফকিরকে চিনতে পারল।
    ফকির এবার শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবার জন্য তৎপর হলেন। শহরের প্রধান ফটকে পাহারা জোরদার করা হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে এক জায়ঘায় এসে তিনি থমকে দাড়িয়ে পড়লেন। একটা বটগাছের ঝুরি বেয়ে তিনি দ্রুত প্রাচীরের ওপর উঠে গেলেন। প্রায় ফুট ত্রিশেক তলায় জমিন। গাছের ডাল ধরে ঝুলতে ঝুলতে তিনি এগুতে লাগলেন। | অকস্মাৎ পর পর কয়েকটা বন্দুকের গুলি এসে গাছের ডালটাকে ভেঙে দিল। ডালটা সমেত এত উচু থেকে আছাড় খেয়ে জমিনে পড়েও তিনি মােটেই আহত হলেন না। অত্যাশ্চর্য এক কায়দায় মাটিতে পড়েই ইংরেজ সৈন্যদের শিবিরের পাশ দিয়ে কায়দা-কসরৎ করে এগিয়ে গিয়ে জমাটবাঁধা অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে দিলেন। ঔরঙ্গাবাদ ছেড়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চললেন।
    | সঁসিয়ে মক্রের ডাইরির ছেড়া পাতায় লেখা রয়েছে-ইঞ্জিনিয়ার ব্যাঙ্কস-এর সাহচর্যে কয়েকদিন কাটিয়ে গল্পগুজব করে কাটানাের উদ্দেশ্যেই আমার ভারতে আসা। প্যারিসে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তারপর ভারতে রেলপথ স্থাপনের কাজের দায়িত্ব নিয়ে সে এদেশে চলে আসেন।
    আঠারাে শ' সাতষট্টিতে আমার ভারতে আসার একমাত্র লক্ষ্য ছিল, তার সাহচর্যে কয়েকদিন থেকে চুটিয়ে ঘুরে বেড়াব আর মজলিশ করে কাটিয়ে দেব। আর ভারতের পুরনাে শহরগুলাে ঘুরে ঘুরে দেখার সাধও কম ছিল না। আমি ভারতে বেড়াতে আসছি শুনে ব্যাঙ্কস তাে খুশিতে একেবারে ডগমগ। কলকাতায় পা দিতেই তার কয়েকজন অভিন্নহৃদয় বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল। তাদের মধ্যে সবার আগে কর্নেল মুনরাে আর ক্যাপ্টেন হুড-এর নাম করতে হয়।
    কলকাতার একান্তে নিরিবিলি এক ফিরিঙ্গি পাড়ায় কর্নেল মুনরাের বাসস্থল।
    তার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। ম্যাকনিল তার সমবয়স্ক। তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। একই সঙ্গে সেনা বিভাগ থেকে অবসর নিয়ে একই বাড়িতে বাস করছে। এক সঙ্গেই যুদ্ধও করেছে। কাজ থেকে অবসর নেবার পর আর নিজের দেশে চলে যেতে কারােরই মন সরে নি। তবে বিশেষ এক কারণে সে দেশে ফেরে নি। স্যার হেকটর মুনরাে নামে তার এক নিষ্ঠুর ও রগচটা পূর্বসূরী এক শ' বছর আগে ভারতে এসেছিলেন । তিনি এক বিদ্রোহ দমন করার সময় কামান দেগে জনা ত্রিশেক বিদ্রোহীকে ঘায়েল করেন।
    কর্নেল মুনরাে তাঁর উত্তরসুরী। সিপাহী বিদ্রোহে তিনি ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তুমুল যুদ্ধ করেন। কিন্তু কানপুরে এসে তাঁকে স্ত্রীকে হারাতে হয়। বিদ্রোহী সিপাইরা তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করে। তারপর থেকেই নানাসাহেবের নামটা কানে যেতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন।

    প্রপেলার আইল্যান্ড Pdf 

    সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে পাহাড়ের চূড়ায়, পাদদেশে আর জঙ্গলে—সর্বত্র। পাহাড়ের গা-বেয়ে আঁকাবাঁকা পথ। ধরে চলতে গিয়ে বাদ্যকরদের ঘােড়ার গাড়িটা আচমকা গড়িয়ে পড়ল।
    মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগে সেটা গড়ালে ভাগ্যে যে কী ঘটত তা আর বলার না।
    ভাগ্যের জোরে একটুর জন্য রক্ষা পাওয়া গেছে। ঘােড়া দুটোর অবস্থা সঙ্গীন, গাড়োয়ান বেচারাও ওঠার ক্ষমতা হারিয়ে বসেছে।
    তবে বাদ্যকর চারজন তেমন জখম হয়নি।
    একদিন বাদেই তাদের সানডিয়েগােতে গানের আসরে যােগদান করার কথা। প্যারিসের বাদ্যকররা কালিফোর্নিয়ার সংগীতরসিকদের বাজনা শােনাবে। খইয়ের মতাে ডলার ছিটিয়ে শহরবাসীরা রুচি পাল্টাবার জন্য পৃথিবীর নামকরা বাদ্যকরদের তলব করে নিয়ে আসছে নিজেদের শহরে। সুযােগের সদ্ব্যবহার করতে গিয়ে চার বাদ্যকর সেই কালিফোর্নিয়া থেকে ছুটে এসেছে। চারজন বাদ্যকরেরই চেম্বার মিউজিকে বেশ নামডাক হয়েছে। অর্কেস্ট্রার বাজনা শুনে শুনে যখন মানুষের মনপ্রাণ অস্থির হওয়ার জোগাড় হয়েছে, ঠিক তখনই এরা আসরে নামার জন্য কোমর বাঁধতে লেগেছে।
    বাদ্যকর চারজনের মধ্যে দলের পাণ্ডা পঞ্চাশ বছর বয়স্ক সিরাস্টিয়ান জর্ন। সে ভায়ােলেনসেলাে বাজানােতেও খুবই দক্ষ। তাদের মধ্যে কনিষ্ঠতম পিঞ্চিনাট। সাতাশ বছরের যুবকমাত্র । ভায়ােলেনসেলােও তার হাত খুবই ভালাে। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। অবশিষ্ট দুজনের মধ্যে একজন বত্রিশ বছর বয়স্ক ইভারনেস ফার্স্ট। ভায়ােলিনে পটু। আর অন্যজন তিরিশ বছর বয়স্ক ফ্রাসকোলিন। সে সেকেন্ড ভায়ােলিন বাজায়। তার একটা পরিচয়ও রয়েছে—কোষাধ্যক্ষ। খুবই হিসেবি বলেই তার ভাগ্যে এ পদটা জুটেছে। আর সে সদাহাস্যময় আর মিশুকও বটে।
    গাড়ি ভেঙে পড়ামাত্র তারা চারদিকে ছিটকে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে গাঝাড়া দিয়ে উঠে বাজনাগুলাে অক্ষত আছে কি না দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
    , বাজনাগুলাের কোনাে ক্ষতিই হয় নি।
    গাড়িটার পরিস্থিতি দেখে সবাই যারপরনাই ভাবিত। এখন উপায়? গাড়ােয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আশানুরূপ কোনাে উত্তর পাওয়া গেল না।
    বাদ্যকররা তখন শহর থেকে দূরে পার্বত্য এলাকায় অবস্থান করছে। জায়গাটা ফ্রেসচেল থেকে মাইলপাঁচেক দূরে। এমনকি কাছে পিঠে কোনাে রেলস্টেশন পর্যন্ত নেই। সমুদ্রের পাড়ে লােকবসতি রয়েছে। হােটেল রেস্তোরাও সেখানে আছে।
    গাড়ােয়ানের সঙ্গে কথাবার্তার মাধ্যমে বাদ্যকররা এও জানতে পারল, গ্রামটায় গেলে চার-চাকার গাড়ি মিলে যাবে। আর মালবাহী দুচাকার গাড়িও পাওয়া যাবে।
    গাড়ােয়ান নিরুপায়। তাকে সেখানেই পড়ে থাকতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি আর জখমি ঘােড়া দুটোকে ফেলে তার পক্ষে অন্য কোথাও যাওয়া কী করে সম্ভব, তার ওপর নিজেও চোট পেয়েছে। সে তাদের অনুরােধ করল, গ্রামে পৌছে যেন লােকজন জোগাড় করে পাঠিয়ে দেয়।
    বাদ্যকররা ফ্লাঙ্ক থেকে সামান্য মদ গাড়ােয়ানের গলায় ঢেলে দিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল।
    কালিফোর্নিয়ার জঙ্গল বড়ই বিপদসঙ্কুল। অন্তত পিস্তল ছাড়া খালি হাতে জঙ্গলের পথে হাঁটতে যাওয়া মােটেই উচিত নয়। কিন্তু বাজনাদার চারজনের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রগুলাে ছাড়া অস্ত্র বলতে কিছুই নেই।
    বাদ্যযন্ত্র কাঁধে নিয়ে জঙ্গলের পথে কিছুদূর যেতে না যেতেই কালােমতাে একটা চলমান ছায়া দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। গা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। গা যেন কেমন ভারী হয়ে আসতে লাগল। পথের ধারে ঝােপের ভেতর থেকে বেরিয়ে ছায়াটা তাদের অনুসরণ করে চলল। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই সেটা তাদের পিছনে, মাত্র দশ বারাে গজ ব্যবধানে চলে এল। তার মতলব মােটেই সুবিধের মনে হল না। এবার ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। কালাে। ছায়ামূর্তিটা অতিকায় নাদুসনুদুস একটা ভালুক। লম্বা লম্বা পায়ে সেটা বাদ্যকরদের অনুসরণ করে চলেছে।
    | ব্যাপার দেখে বাদ্যকরদের তাে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার জোগাড়। দৌড়ে পালাবার চিন্তা পাগলের খেয়ালমাত্র । গাছে উঠলেও রেহাই পাওয়া যাবে না। হতচ্ছাড়াটা সেখানেও হামলা হুজ্জতি চালাবে।
    এমন ভয়ংকর বিপদের মুহূর্তে বেহালার মিষ্টি-মধুর সুর মনকে উতলা করে তুলল। ইভারনেসের মাথা থেকে চমৎকার এ মতলবটা ঝট করে বেরিয়ে এসেছে। ব্যাস, আর মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করে সে বাক্স থেকে বেহালাটা বের করে উন্মাদের মতাে ছড় টেনে চলেছে। পাকা বাদ্যকরের বেহালার সুর ভালুকটার মধ্যে ভাবােন্মাদনার সঞ্চার। করল। এতক্ষণ সে এগােচ্ছিল নখের ধার আর কজির জোর পরীক্ষা করে দেখতে। এখন বেহালার সুর তাকে টেনে আনছে।
    বেহালার সুরের তালে তালে হেলেদুলে নাচতে নাচতে বনের একেবারে কিনারায় এসে ভালুকটা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কয়েকবার সামনের দুপায়ের থাবা দুটো দিয়ে করতালি দিয়ে বাদ্যকরদের বিদায় সম্ভাষণ জানাল।
    বনের এলাকা ছেড়ে বাইরে আসতেই পিঞ্চিনাটের মাথায় একটা দুর্বুদ্ধি ভর করল। সে বলল, “ভায়া, এক কাজ করাে, জোরে জোরে ছড় টেনে ভালুক-নাচানাের সুর বাজাও।'

    ভিলেজ ইন দ্য টি টপস Pdf

    ছয়টা ষাড় অক্লান্ত পরিশ্রম করে পাথরের চার চাকাওয়ালা গাড়িটাকে একনাগাড়ে টেনে নিয়ে চলেছে। এবড়ােখেবড়াে পথ। কখনও খানাখন্দ পেরিয়ে, আবার কখনাে বা প্রায় সমতল পথে এগােতে হচ্ছে বােবা, প্রাণী ছয়টাকে। ইতিমধ্যেই তিন মাস কেটেছে। আরাে নয়-দশ সপ্তাহ গাড়ি চেপে পথ পাড়ি দিতে হবে। গাড়িটার দুটো কামরা। প্রথমটায় রয়েছে পঞ্চাশ বছর বয়স্ক শক্ত সাবুত এক পর্তুগিজ বণিক। নাম তার উর্দা। তার সঙ্গে রয়েছে বছর পঁয়ত্রিশেক বয়স্ক নিগ্রেী ঘামিশ। তার কাজ চলার পথে গাছগাছালি ঝােপঝাড় পড়লে কেটে কুটে পরিষ্কার করে গাড়ি চালাবার মতাে জায়গা করে দেওয়া। আর দ্বিতীয় কামরাটায় যাত্রী দুজন যুবক। উভয়েরই বছর পঁচিশেক বয়স। তাদের একজন ম্যাক্স হিউবার নামে এক ফরাসি, আর অন্যজন জন কট, আমেরিকান।
    ফরাসি কঙ্গোর রাজধানী লিভারভিল থেকে তিনমাস আগে এরা যাত্রা শুরু করেছে। হাতি শিকার করা এদের উদ্দেশ্য। প্রচুর হাতি ইতিমধ্যেই ঘায়েল করেছে। হাতির দাঁতই তাদের কাম্য। সারা পৃথিবীর পিয়ানাের রীড তা দিয়ে। তৈরি করা যেতে পারে। হাতির দাঁতের বােঝ-মাথায় একজন গাট্টাগােট্টা লােক তাদের অনুসরণ করে চলেছে। তাদের সঙ্গে আনন্দ করতে করতে চলেছে লাঙ্গা নামে প্রায় দশ বছরের এক বালক। একে জন আর ম্যাক্স-এর পােষ্যপুত্র জ্ঞান করা যেতে পারে। জঙ্গলি মানুষখেকোদের হাত থেকে তাকে জোর করে ছিনিয়ে আনা হয়েছিল। কেবলমাত্র যে মানুষখেকোই তাই নয়, শিশুখেকোও বটে। নিজের শিশুকে দিয়েও পেটের জ্বালা এরা নেভাতে ইতস্তত করে না। যেদিন শিশু না জোটে সেদিন বড়দের গায়ে হাত দেয়। এমনই ভয়ঙ্কর সে-জাত।
    শিকার করে হাতির দাঁত অনেকই জোগাড় হয়েছে। এবার ফেরার চিন্তা। বাড়ি ফিরতে আরও অন্তত ন-দশ সপ্তাহ লেগে যাবে। | ফেরার পথে এক জঙ্গল পড়ল। পর্তুগিজ বণিক উর্দা বললেন—“জঙ্গলের মাঝ বরাবর যাওয়া ঠিক হবে না। জঙ্গলের ধার দিয়ে দিয়ে আমাদের যেতে হবে।'
    ফরাসি যুবক ম্যাক্স সবিস্ময়ে প্রতিবাদ করে উঠল—একী অদ্ভুত কথা বলছেন। মাঝ বরাবর গেলে পথ অনেক কম। হবে। শীঘ্র পেীছে যাওয়া যাবে। তবুও যেতে চাইছেন না?' | যাওয়া সম্ভব নয় বলেই তাে আপত্তি করছি। আজ অবধি ওখান দিয়ে কেউ যায়ও নি। মােদ্দা কথা হচ্ছে, গাছগাছালি এমন ঘন, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাড়িয়ে রয়েছে যে, তাদের ফাক দিয়ে চলা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।'
    আমেরিকান যুবক জন কর্ট উর্দাকে সমর্থন করতে গিয়ে বলল, ‘গাছগাছালির চক্করে গিয়ে হয়রান হওয়ার দরকারই বা কী? বাদ দিন তাে—'
    তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ম্যাক্স বলে উঠল, সে কী! জঙ্গলটার ভেতরে কি রয়েছে জানার আগ্রহও নেই?
    জন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জবাব দিল, ' জেনে কী-ই বা লাভ? জঙ্গলের ভেতরে অবশ্যই বিচিত্র শহর, দুর্গ আর অদ্ভুত দর্শন মানুষ ও জানােয়ার নেই।'
    ব্যস, ব্যাপারটা নিয়ে তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেল। আসলে ম্যাক্স-এর বক্তব্য হচ্ছে, এতদিন বনে ঘােরাঘুরি করে নতুন কিছুরই দর্শন মিলল না। ব্যাপারটা অবশ্যই পরিতাপের । আশ্চর্য কিছু আবিষ্কার না হলে মন ভরবে কেন, বল তাে?
    একে পথ কম হবে, নতুনতর কোনােকিছু চাক্ষুষ করা যাবে, উপরি পাওনা অভিজ্ঞতালাভ হবে। এ লােভের বশবর্তী হয়েই ম্যাক্স বনের মাঝ বরাবর পাড়ি দিতে আগ্রহী। উর্দা কিন্তু এতে নিতান্তই অনাগ্রহী। আবার জন কর্টও যেতে চাইল
    | কথা কাটাকাটি করতে করতেই রাত্রি সাতটা বেজে গেল। ফলে সেদিন আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হল না। অনন্যোপায় হয়ে রাত্রিটা তাদের সেখানেই কাটাতে হল।
    রাত্রি তখন দশটার কাছাকাছি। গভীর বনে কতগুলাে আগুন জ্বলে উঠল। অভিযাত্রীরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ব্যাপারটা তারা কেউ টেরও পেল না।
    রাত্রি তখন প্রায় সাড়ে দশটা। হঠাৎ নিগ্রো বালক লাঙ্গার ঘুম ভেঙে গেল। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে অস্পষ্ট আলােক-বিন্দু তার নজরে পড়ল। অনুসন্ধিৎসু নজরে আলােটার দিকে তাকিয়ে নিঃসন্দেহ হবার চেষ্টা করল। হ্যা, হেলেদুলে এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছে কতগুলা আলাে। ভাবল, মশাল নাকি? দূরত্ব দেড় মাইল হবে হয়ত। ব্যাপারটা লাঙ্গার সুবিধের মনে হল না। আপন মনে বলে উঠল-মানুষখেকো জঙ্গলিরা নয় তাে? আফ্রিকার গভীর বনে এদের চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কিছুই নেই। সাউথ সী আইল্যান্ড অথবা অস্ট্রেলিয়ার মানুষখেকোরা এদের কাছে নিছকই শিশু। দশপনের বছরের বালক বা কিশােরের মাংস পেলে তাে আর কতাই নেই। দলপতির নির্দেশে সামান্য কারণেই মৃত্যদের গর্দান নেওয়া হয়। তারপর তাদের মাংস দিয়ে—উঃ! লাঙ্গা আর ভাবতে পারছে না। অনিশ্চিত আতঙ্কে তার শরীরের। স্নায়ুগুলাে অবশ হয়ে আসতে লাগল। পরমুহূর্তেই নিজের মনকে শক্ত করে আবার তাকাল চলন্ত আগুনের শিখার দিকে।

    সিক্রেট অব উইলহেম স্টোরিজ Pdf

    ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের চৌঠা এপ্রিল আমার সহােদর ভাইমার্ক ডাইডাল এর লেখা একটা চিঠি পেলাম । লিখেছে, সে আমার প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে বসে। আমি যেন পত্র পাওয়ামাত্র যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার ওখানে চলে যাই। জায়গাটা অতি মনােরম। মনকে দোলা দেয়। সে জেলায় এমন বহু সম্পদ রয়েছে যা যে-কোনাে ইঞ্জিনিয়ারকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা রাখে। কেবল এটুকু বিচার বিবেচনা করলেই নাকি পথশ্রম মােটই আমার কাছে বােঝা হয়ে দাঁড়াবে না। আর হা পিত্যেশও করতে হবে না। এভাবেই চিঠিটা শেষ করা হয়েছে। আসলে এরকম কোনাে আকস্মিক চিঠির জন্য আমি মনের দিক থেকে আদৌ তৈরি ছিলাম না।
    সত্য বলতে কি, চিঠিটা খােলার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আমার মনপ্রাণ বাস্তবিকই শান্ত ছিল। ঠাণ্ডা মাথায়ই শুরু থেকে শেষপর্যন্ত চিঠিটা পড়েও ছিলাম। এমন কি শেষ লাইনকটা পড়ার সময়ও আমার সামান্যতম চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে নি। কিন্তু এ শেষ ছত্র কটার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল অসাধারণ ব্যাপার স্যাপারের বীজ যার সঙ্গে দুদিন বাদেই আমি নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলতে আগ্রহান্বিত হয়ে পড়েছিলাম।
    এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এমন বিদঘুটে একটা কাহিনী বিশ্বাস করতে কেউ উৎসাহী হবে কি? ভাগ্য ঠুকে ঝুলে তাে পড়ি। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ব্যাপারটা তাে পুরােপুরি আপনার ওপর নির্ভর করছে।
    আমার অনুজ মার্ক-এর বয়স তখন আঠাশ চলছে। এ বয়সেই সে যে-কোনাে মানুষকে সামনে বসিয়ে ছবি আঁকার ব্যাপারে খুবই খ্যাতি অর্জন করে ফেলেছে। মার্ক আমার চেয়ে বয়সে আট বছরের ছােট। আমাদের উভয়ের মধ্যে খুবই সম্প্রীতি। খুবই অল্প বয়সে আমাদের মা-বাবাকে হারাতে হয়। ফলে সেই থেকেই ছােট ভাইয়ের শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্বভার আমাকেই বইতে হয়। তখনই তার ছবি আঁকার ব্যাপারে অসামান্য প্রবণতা লক্ষ্য করে আমি তাকে তাতেই প্রেরণা দান করি। ফল তাে হাতে নাতেই পাওয়া গেছে। ছবি আঁকাতেই তার অর্থ ও খ্যাতি সবই আসবে, আমি নিঃসন্দেহ।
    • দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ হাঙ্গেরির নাম করা রাগ শহরে মার্ক বাস করছে। ইদানীং কিছুদিন ধরে তার মাথায় বিয়ের পােকা ঢুকেছে। একেবারে আদাজল খেয়ে লেগেছে। সেখানকার প্রতিষ্ঠিত পরিবারগুলির মধ্যে সবার আগে ডা, রােডরিখ-এর নাম করতে হয়। হাঙ্গেরিতে মুষ্টিমেয় কয়েকজন দাঁতের ডাক্তার খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি তাদেরই একজন। পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া অগাধ ধন-সম্পদ তাে ছিলই, তার ওপর কেবলমাত্র চিকিৎসার মাধ্যমে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। প্রতি বছরই দেশভ্রমণে যেতেন। তখন ধনকুবের অথচ অথর্ব পঙ্গু লােকেরা তার ফিরে আসার প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকত, তার অবর্তমানে কেবলমাত্র ধনকুবেররাই নয়, পথের ভিখারীরাও মনমরা হয়ে পড়তাে। কারণ রােগীর পকেটে একটা ফুটো পয়সা না থাকলেও ডা, রােডরিখ কাউকে হতাশ করে ফিরিয়ে দিতেন না। তার ওপর অমায়িক ব্যবহারের তাে তুলনাই হয় না।
    ডা. রােডরিখ-এর স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যা বর্তমান। তার পুত্রের নাম ক্যাপ্টেন হারালান আর কন্যা মায়রা। আমার অনুজ মার্ক ডাক্তারের বাড়িতে যতবার গেছে যুবতী মায়রার রূপ সৌন্দর্য দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছে। আবার আদর যত্ন পেয়েছে যথেষ্টই । তাই রাগ শহর ছেড়ে আসা তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হয় নি। তবে মায়রার রূপে মার্ক যেমন মজে গেছে তেমনি মায়রাও তার প্রতি কম আকৃষ্ট হয়ে পড়ে নি। এমনটা ঘটা কিছুমাত্রও বিচিত্র নয়। আসলে। মার্ক-এর মতাে আকর্ষনীয় রূপবান যুবক তাে সচরাচর চোখে পড়ে না। আর তার মিশুকে স্বভাবও যে অতুলনীয়। অল্পেতেই কথাবার্তার মাধ্যমে মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে পৌছে যেতে তার জুড়ি নেই। মােদ্দা কথা, একজন শিল্পীর পক্ষে যা দরকার, সে রূপ-সৌন্দর্যের পূজা করার প্রবণতাটুকু তার মধ্যে উপস্থিত।
    রূপসী মায়রাকে একবারটি চাক্ষুষ করার জন্য আমি নিজেই মানসিক চাঞ্চল্য অনুভব করছিলাম । মায়রার সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য আমার অনুজ মার্কও কম উদ্বিগ্ন ছিল না। দায়িত্ব নিয়ে বিয়ের পাট চুকিয়ে দেবার জন্য আমি যেন অন্তত এক মাসের জন্য রাগ শহরে গিয়ে মাথা গুজি ! আমি গেলে তবেই বিয়ের তারিখ পাকা করা হবে। তবে তার আগে মারা নাকি তার ভাবী ভাসুরকে একবারটি চাক্ষুষ করতেও আগ্রহী। কারণ, আমার সম্বন্ধে সে নাকি খুবই উচু ধারণা পােষণ করে। মার্কের চিঠিপত্রের মাধ্যমেই আমি মায়রার সম্বন্ধে যে টুকু জানা দরকার ও সম্ভব জেনে নিয়েছিলাম । আরও ভালাে হত আমার ভাইটি যদি তার প্রিয়তমার একটা প্রতিকৃতি এঁকে পাঠিয়ে দিত। সে নামি মায়রাকে ছবি আঁকার মডেল হয়ে বসার জন্য প্রস্তাবও দিয়েছিল। সে সম্মত হয় নি। মার্ক-এর চিঠিতে জানতে পেরেছি, মায়রা নাকি আমার মুখােমুখি দাঁড়িয়ে আমাকে চমকে দিতে আগ্রহী, ছবিতে নয় ।
    অনন্যোপায় হয়ে রাগ শহরে যাত্রা করার জন্য মন স্থির করে ফেললাম।
    এপ্রিলের তেরাে তারিখ। সেদিন যাত্রা করার কথা। সেদিনই সন্ধ্যার দিকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে পুলিশ লেফটেন্যান্ট-এর দপ্তরে গেলাম। আর আমার পাশপিেটটাও নিয়ে আসার ইচ্ছা। পুলিশ-লেফটেন্যান্ট আমার বন্ধু । পাশপাের্টটা আমার হাতে তুলে দিতে দিতে তিনি আমার অনুজের প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ হয়ে পড়লেন। কারণ, আমার অনুজকে তিনি বহুদিন ধরেই চেনেন।
    পুলিশ লেফটেন্যান্ট বন্ধু সংক্ষেপে শুভ বার্তাদি বিনিময়ের পর কি যেন বলতে গিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলেন।

    ক্লিপার অব দ্য ক্লাউডস Pdf

    মাঠে একটা গরু পরম তৃপ্তিতে ঘাস খাচ্ছে। আচমকা পিস্তল গর্জে উঠল-রুম! দ্রুরুম! মাত্র গজ পঞ্চাশেক দূর। থেকে পিস্তলের সিসার গুলি ছুটে এসে অসহায় নিরাপরাধ গরুটার গায়ে আঘাত করল। একটা নয়, দু-দুটো গুলির আঘাত তার পক্ষে সহ্য করা সম্ভ হল না। বিকট আর্তনাদ করে অসহায় জীবটা মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ল। তার রক্তমাখা দেহটা বারকয়েক মাটিতে আছাড়ি-পিছাড়ি করে এক সময় নিথরভাবে শাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ব্যস। সব শেষ।
    কিন্তু কে গুলি ছুঁড়ল? কেন? কেনই বা অসহায় নিরাপরাধ গরুটাকে অকালে প্রাণ হারাতে হল? কে? কারা এরা?
    হ্যা, একজন তাে নয়। দুজন। ওই তাে ক্রোধােন্মত্ত দুজন যুবককে দেখা যাচ্ছে। কারা এরা? কি-ই বা এদের। পরিচয়? হ্যা, পরিচয় অবশ্যই পাওয়া যাবে। তবে আপাতত চেহারা দেখে যেটুকু অনুমান করা যাচ্ছে এদের একজন ইংরেজ যুবক আর দ্বিতীয়জন আমেরিকান।
    | নায়েগ্রা জলপ্রপাতের বাঁ-পাড়ে দুই ভিনদেশী যুবকের মধ্যে এ গুলি বিনিময়-গুলিযুদ্ধ। যে সেতুটা আমেরিকা আর কানাডার মধ্যে যােগাযােগ রক্ষ করছে তারই কাছাকাছি এ-দ্বন্দ্ব-গুলিযুদ্ধ। জায়গাটা নায়েগ্রা জলপ্রপাত থেকে খুব বেশি হলেও মাইল তিনে দুরে। ক্রোধােন্মত্ত ইংরেজ যুবকটা আমেরিকান দ্রলােকের দিয়ে এগিয়ে এসে মুখােমুখি দাঁড়াল। কর্কশ স্বরে উচ্চারণ করল, পরােয়া নেই—গুলি ফসকেছে বলে পরােয়া করি না। আর একটু অন্তত জেনে রাখুন মশাই-এটা যে-সে পিস্তল নয়। আসলি মাল! রুল ব্রিটানিয়া।'
    “আরে রাখুন সাহেব। এটাও কোনাে অংশে কমতি নয়। ইয়াঙ্কি ডুডল'। পিস্তলের রাজা। বাকযুদ্ধ চলতে চলতে আবার গুলি ছোড়াছুঁড়ি শুরু হয় আর কি।
    মুহূর্তের মেধ্যে যুদ্ধোন্মাদদের সহযােগীদের মধ্যে একজন পরিণাম সম্বন্ধে আঁচ করতে পেরে আৎকে উঠে বলল, ‘কেন ঝুটমুট দ্বন্দ্বের মধ্যে যাচ্ছেন। তার চেয়ে বরং মেনে নিন, রুল ব্রিটানিয়া’ আর ‘ইয়াঙ্কি ডুডল’ দুই সমান। কেউ কারাে চেয়ে কমতি নয়।'
    হ্যা, প্রস্তাবটা তাে চমৎকারই বটে। চমৎকার শান্তিপ্রস্তাব। এতে তাে আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট বৃটেন উভয়েরই সম্মান অক্ষুন্ন থাকছে। আর অবসান ঘটছে রক্তক্ষয়? গুলিযুদ্ধের।
    । যােদ্ধারা যুদ্ধ থেকে বিরত হয়ে নিজ নিজ দেশে ফিরে গেল। সবই তাে হল। যুদ্ধ মিটল। দু-দুটো তাজা প্রাণনিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে অব্যাহতি পেল।
    যুদ্ধের কারণটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ । যদি তা নাই হবে তবে দু-দল এমন ভয়ঙ্কর মুখােমুখি সংগ্রামে লিপ্ত হবে কেন? তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় তাদের মারণাস্ত্র নিয়ে লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়ার আড়ালে একটা গভীর রহস্য অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা এমন কি রহস্যজনক যার ফলে আকাশটা এমন তােলপাড় হচ্ছে। আর এরই ফলে বারুদের উগ্র গন্ধে আকাশ-বাতাস বিষময় হয়ে উঠেছে।
    | পৃথিবীর বুকে মানুষের প্রথম আবির্ভাব তাে আর আঁজ হয় নি। সেই আদ্যিকাল থেকে আজ পর্যন্ত দলে দলে কাতারে কাতারে মানুষ তাে কোনােদিনই এমন করে আকাশের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে নি। কেন? এর পিছনে এমন কোনাে রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। | রহস্যজনক ব্যাপারটা বেশিদিন আগে ঘটে নি। গত রাত্রে-গতরাত্রেই, চব্বিশ ঘন্টা পেরােয় নি এখনাে। রাতের অন্ধকার আকাশ থেকে ট্রাম্পেস্ট সংগীতলহরি ভেসে আসতে শােনা গেছে। অত্যাশ্চর্য সংগীত।
    রাত্রির অন্ধকারে খােলা-আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে কৌতূহলী মানুষ উৎকর্ণ হয়ে লক্ষ্য করেছে, সেটা কি আদৌ ট্রাম্পেস্ট সংগীতলহরি, না কি অন্য কোনাে রহস্যজনক শব্দ তাদের বিভ্রান্ত করেছে? শােনার ভুল না, শােনার ভুল অবশ্যই নয়। হাজার হাজার মানুষ তাে আর ভুল শুনতে পারে না। তারা স্পষ্ট শুনেছে, লেক ওন্টারিয়াে ও লেক হরির মধ্যবর্তী অঞ্চলের আকাশ থেকে ভেসে এসেছে অত্যাশ্চর্য সে সংগীতলহরি ।
    এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দুই যােদ্ধার মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছিল কি নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণ, সংগীতটা কোন দেশের?
    তখনকার মতাে কোনােরকমে ধামা চাপা দিয়ে দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি করা গেছে, সত্য বটে। কিন্তু অন্তরের অন্তঃস্থলে দ্বন্দ্বের রেশ কিন্তু থেকেই গেল।
    আসল রহস্যটা কি? কিসের শব্দ অন্ধকার আকাশ থেকে বাতাস বাহিত হয়ে হাজার হাজার মানুষের অস্বাভাবিক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। তবে কি অন্ধকার উদ্ধাকাশে কোনাে নভােচারি গানের মজলিশ বসিয়েছেন?
    না, তেমন কিছু তাে মনে হয় নি। অনুসন্ধিৎসু নজর মেলে চারদিকে তাকিয়ে কোনাে বেলুনচারিকেই তাে দেখা যায় নি। তবে?
    সত্যই ব্যাপারটা খুবই বিচিত্র, একেবারেই অবিশ্বাস্য।
    ওই-আবার ওই শােনা যাচ্ছে অত্যাশ্চর্য সে সংগীতলহরি। 

    অ্যাডভেঞ্চার্স অফ ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস Pdf

    ১৮৬০-এর ৫ এপ্রিল। সেদিন সকালের লিভারপুল হ্যারল্ড পত্রিকার পাতায় খবরটা প্রকাশিত হল। ব্যস, আর দেরি নয়, পরের দিন ভাের হতে না। হতেই ফরােয়ার্ড নামক জাহাজটা অজ্ঞাত দেশের উদ্দেশ্যে নােঙর তুলল। | প্রতিদিন চার মাইল দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট নিউ প্রিন্স বন্দর থেকে কত জাহাজই তাে ছাড়ে, ভেড়েও কত জাহাজ, কে তার খবর রাখে। কিন্তু ৬ এপ্রিলের ব্যাপারটা একেবারেই স্বতন্ত্র। কাকডাকা সকাল থেকেই কৌতূহলী মানুষ দলে দলে কাতারে কাতারে এসে জমা হতে লাগল, একমাত্র ফরােয়ার্ড' নামের জাহাজটির সমুদ্রযাত্রার দৃশ্য স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার অত্যুগ্র বাসনা নিয়ে।

    সত্যই অত্যাশ্চর্য অবিশ্বাস্য গঠন নৈপুণ্যের অধিকারী অত্যাধুনিক জাহাজ এই ফরােয়ার্ড। এটা ইঞ্জিনের সাহায্যে তাে চলেই, পালের দ্বারাও অনায়াসে পথ পাড়ি দিতে পারে। অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা জাহাজটার বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলাে দেখে নিজেদের মধ্যে জল্পনা কল্পনায় লিপ্ত হয়েছে, এটা নির্ঘাত উত্তর মেরুর দিকে চলেছে। বিশেষ করে পালটার আকার তাদের এরকম ধারণা করতে উৎসাহিত করছে। আর জাহাজে বােঝাই করা হয়েছে, পাঁচ-ছয় বছর চলার মতাে খাদ্যসামগ্রী, সিলমাছের চামড়ার পােশাক আশাক আর, বস্তা বস্তা উল আর ওষুধপত্র দিয়ে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, জাহাজের নাবিক ও লঙ্কররা জানে না জাহাজটাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে। কাড়ি কাড়ি টাকা বেতন পাওয়ায় সবাই মুখে কুলুপ এঁটে মহানন্দে নিজ নিজ কর্তব্য পালন করে চলেছে।

    ফরােয়ার্ড জাহাজের ক্যাপ্টেনের পদে নিযুক্ত যিনি হয়েছেন তিনি নিপাত্তা । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শ্যানডন নামে লােকটা ক্যাপ্টেন হবার সবদিক থেকে যােগ্য । আর তাকেই কি না করা হয়েছে জাহাজের মেট। এর চেয়ে হাস্যকর ও অবিশ্বাস্য ব্যাপার আর কী-ই বা হতে পারে? ক্যাপ্টেনকে মুহূর্তের জন্যও কেউ চোখে দেখে নি। গন্তব্যস্থল কোনদিকে, কোথায়, কিছুই জানা নেই। সবচেয়ে বেশি কৌতূহল সঞ্চার করেছে কুকুরটার খবর প্রচার হওয়ার পর থেকে। | একটা কুকুর নাকি ফরােয়ার্ড জাহাজের ক্যাপ্টেনের পদে বহাল হয়েছে। এমন একটা অবিশ্বাস্য কথা প্রচার হলে শহরবাসীদের মনে কৌতূহলের সঞ্চার তাে হবেই। জাহাজের মালিক ও সৃষ্টিকর্তা রিচার্ড শ্যানড়ন। দুহাতে টাকা খরচ করে নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিশালায়তন জাহাজটাকে গড়ে তুলেছেন। নিউ ক্যাসলের এক কারখানা ১২০ হর্সপাওয়ার-বিশিষ্ট ইঞ্জিন তৈরি করে দিয়েছেন। ডেকের ওপর ষােল পাউন্ড কামান রাখা হয়েছে। কামান আর বন্দুকের সংখ্যা বেশি না রাখলে কী হবে বস্তা বস্তা বারুদ কিন্তু তােলা হয়েছে। এসব ছাড়া আর যা কিছু নেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে সিগন্যাস-ল্যাম্প, সহস্রাধিক রকেট, বিচিত্রদর্শন সব যন্ত্রপাতি আর বিশালায়তন কয়েকটা করাত।।

    | রিচার্ড শ্যানডনের হাতে আটমাস আগে আবারডন থেকে ১৮৫৯-এর ২ আগস্ট তারিখে লেখা অদ্ভুত একটা চিঠি এসেছিল। চিঠিটার লেখক ফরােয়ার্ড জাহাজের ক্যাপ্টেন কে, জেড । তিনি লিভারপুলে বসে ওই চিঠিটা হাতে পান। চিঠিটার লেখক জানিয়েছেন, ম্যাকুয়ার্ট কোম্পানির ব্যাঙ্কে ষােল হাজার পাউন্ড মজুত রেখেছেন। নিজের স্বাক্ষরযুক্ত বেশ কিছুসংখ্যক চেকও চিঠিটার সঙ্গেই তিনি পাঠিয়েছেন। তিনি যেন ব্যাঙ্ক থেকে ইচ্ছামত প্রয়ােজনীয় অর্থ তুলে নেন। আর এও লিখেছেন, রিচার্ড শ্যানডন চিঠির লেখক কে, জেডকে চেনেন না বটে, তবে তিনি তাকে চেনেন। ব্যস, এর বেশি কিছু দরকার নেই। তাকে ৫০০ পাউন্ড বেতনের বিনিময়ে ফরোয়ার্ড জাহাজের প্রধান কার্যনির্বাহকের পদ গ্রহণের জন্য অনুরােধ করা হয়েছে। আর বছর বছর পঞ্চাশ পাউন্ড করে বেতন বৃদ্ধি করা হবে। তবে এও লিখতে বাদ দেন নি যে, অভিযানটা দীর্ঘদিনের আর বিপদ ও ঝুঁকিবহুলও বটে। চিঠির সঙ্গে জাহাজের নকশাটাও পাঠিয়ে দিয়েছেন। কারণ জাহাজটা তৈরির কাজ এখনও আরম্ভবই করা হয় নি । নকশা অনুযায়ী মজবুত একটা জাহাজ যেন তিনি তৈরি করে নেন। জাহাজ তৈরির কাজ মিটে গেলে পছন্দমাফিক পনের জন কর্মচারী যেন বহাল করেন। চিঠির লেখক এবং রিচার্ড শ্যানডনকে নিয়ে তা দাঁড়াবে সতের জনে।

    ডা, ক্লববানি নামে আর একজন সময়মতাে হাজির হবেন। তবে একটা শর্ত, নাবিকরা সবাই যেন অবশ্যই ইংরেজ হয় । আর সবাইকে অবিবাহিত এবং সন্তানসন্ততিহীন হতেই হবে। সবার দৈহিক গঠন সুদৃঢ় এবং মাসক্তহীন হতে হবে। পাঁচ গুণ বেতন তাদের জন্য বরাদ্দ করা হবে। প্রতিবছর শতকরা দশভাগ করে বেতন বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা থাকবে। অভিযানের পাট মিটে গেলে প্রত্যেক কর্মীকে অতিরিক্ত ৫০০ পাউন্ড দেয়া হবে। আর তাকে অর্থাৎ রিচার্ড শ্যানড়নকে দেওয়া হবে অতিরিক্ত ২০০০ পাউন্ড। চিঠিটার শেষের দিকে লিখেছেন, রিচার্ড শ্যানডন যদি উপরােক্ত প্রস্তাব মেনে কাজ করতে সম্মত থাকেন তবে যেন কে, জেউকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেন। ঠিকানা দেয়া আছে—পােস্ট রেস্তানডে, গােটবর্গ, সুইডেন। | তিনি আবার লিখেছেন, ১৫ ফেব্রুয়ারি অতিকায় একটা ড্যানিশ কুকুরকে রিচার্ড শ্যানডনের কাছে পাঠিয়ে দেবেন। তার দেখভালের দায়িত্ব তার ওপরই বর্তাবে। কুকুরটার প্রাপ্তিসংবাদ ইতালির পােস্টমাস্টারকে যেন চিঠির মারফত জানিয়ে দেন। প্রয়ােজন হলেই ফরােয়ার্ড জাহাজের ক্যাপ্টেন হাজির হবেন। নইলে তাকে ছাড়াই লিখিত নির্দেশ মেনে রিচার্ড শ্যানডনকেই ফরােয়ার্ড জাহাজকে চালাতে হবে। চিঠির বক্তব্য এ পর্যন্তই।

    রিচার্ড শ্যানন রহস্য সঞ্চারকারী চিঠিটা হাতেপাওয়ার পর অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে একাধিকবার সেটাকে পড়লেন। কিন্তু কিছুতেই রহস্যভেদ করা তাঁর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হল না। ব্যাপারটা তার কাছে কুয়াশাচ্ছন্নই রয়ে গেল। 

    অন দ্য ট্রাক Pdf

    হনন ডানকান জাহাজে ফিরে সহধর্মিণী লেডি হেলেনার কাছে তাদের দক্ষিণ আমেরিকা সফরের ব্যর্থতার কাহন চরে বর্ণনা করলেন। তিনি একথাও বলতে ভুললেন না, আসলে বােতল থেকে উদ্ধার করা কাগজের বক্তব্য উত্তর : গইে তারা মারাত্মক ভুল করেছিলেন।

    জানে হজ তিনটে নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা চালিয়ে যে অর্থ উদ্ধার করেছেন তা নিম্নরূপ| অহরহ বই সাতই জুন ব্রিটানিয়া নামক তিন মাস্তুলবিশিষ্ট গ্লাসগাের যুদ্ধজাহাজটা অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে জলমগ্ন হয়ে যায়। ক্যাপ্টেন গ্রন্ট দুজন নাবিকসহ মহাদেশের মাটিতে পদার্পণ করেন। তাঁরা নিমর্ম-নিষ্ঠুর অসভ্য আদিবাসীদের স্কুহে কয়েদ হন। তাঁরা কাগজসহ বােতলটাকে সাইত্রিশ ডিগ্রি এগারাে মিনিট অক্ষাংশে সমুদ্রবক্ষে নিক্ষেপ করেন। যেখানে জাহাজটা তলিয়ে গেছে সেখানে সাহায্য পাঠান।' | পাজালেন বিবরণীটা পাঠ শেষ করা মাত্র মেজর বলে উঠলেন, কিন্তু আমি বলব, অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানাের আগে আমাদের ব্যাপারটাকে একটু তলিয়ে দেখা দরকার। একবার ভুল যখন হয়েছে তখন আবারও যে আমাদের স্কুলের হ্যাপা পােহাতে হবে না তারইবা নিশ্চয়তা কোথায়?

    সবার আগে আমাদের দেখা দরকার সাইত্রিশ ডিগ্রি এগারাে মিনিট অক্ষাংশ কোন মহাদেশের ওপর দিয়ে বিস্তৃত। মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে সেটা যে-সব জায়গার ওপর দিয়ে অবস্থান করছে তাদের অধিকাংশই পানি। স্কুলের পরিমাণ খুবই কম। দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ আমেরিকার পর স্থলভূমি পড়ছে ক্রিস্তান দ্য কুহা আইল্যান্ড। কাগজে এর নামগন্ধও নেই। অতএব একে বাদ দেয়া যাক। এরপর পাওয়া যাচ্ছে ভারত মহাসাগরের অন্তর্গত আমস্টারডাম আইল্যান্ডে। কাগজ তিনটেতে উল্লেখ না থাকায় বাদ দিলাম। এবার পাওয়া যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়াকে। ইংরেজিতে লেখা বিবরণীটার 'stra' এবং ফরাসি ভাষায় লেখা বিবরণীটার austral-এর অর্থ বুঝাচ্ছে ‘Australia'। অস্ট্রেলিয়ার পর পাওয়া যাচ্ছে নিউজিল্যান্ড। আদৌ মহাদেশ নয়। আসলে দুটো আইল্যান্ডের সমষ্টি। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন দক্ষিণ আমেরিকা ও নিউজিল্যান্ড উপকূলের বিশালায়তন সমুদ্রের মধ্যে একটামাত্র ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে অক্ষাংশ বিস্তৃত। সেটা হচ্ছে মেরিয়া থেরেসা নামক আইল্যান্ড। কিন্তু কাগজ তিনটার কোনােটাতেই মেরিয়া' তেরেসার উল্লেখ নেই। এবার আপনারাই স্থির করুন কোনদিকে, কোথায় যেতে চাচ্ছেন?' | অমিত্রীরা সমস্বরে বলে উঠলেন, 'অহেলিয়া। অস্ট্রেলিয়া। ..

    : *

    *

    | ডানকান দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলল। দুই হাজার একশাে মাইল দশদিনেই অতিক্রম করল। সবাই জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে প্রায় সাত হাজার ফুট উঁচু লিস্তান পর্বতের শিখরটাকে দেখল।

    জাহাজ নােঙর করা হল । গভর্নর লর্ড গ্রেনভােনকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। কিন্তু বহু লােককে জিজ্ঞাসাবাদ করেও ব্রিটানিয়া জাহাজ বা ক্যাপ্টেন গ্রান্টের হদিস পেলেন না। রাত্রির অন্ধকারেই ডানকান দ্বীপ ছেড়ে আবার যাত্রা করল।

    ৬ ডিসেম্বর ডানকান আমস্টারডাম আইল্যান্ডে নােঙর করল। মাত্র তিনজন দ্বীপটায় বাস করে। তাদের দুজন নিগ্রো মুলাটো আর একজন ফরাসি প্রৌঢ়। তাদের মুখে জানা গেল ব্রিটানিয়া জাহাজের কোনাে নাবিক বা ক্যাপ্টেন কেউই এদ্বীপে আসেন নি ।

    পরের দিন আমস্টারডামে কাটিয়ে ডানকান ফের এগিয়ে চলল।

    পাজালে এবার বােতলের কাগজ তিনটার বক্তব্যের নতুন অর্থ বের করলেন। তিনি বললেন, 'তবে কি ব্রিটানিয়ার পক্ষে পেরু উপকূল পেরিয়ে ভারত মহাসাগরে পড়া সম্ভব? | ‘একদিনে অর্থাৎ প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় দশ মাইল পথ পাড়ি দিতে পারলে যে-কোনাে জাহাজের পক্ষে এক মাসে আমেরিকা থেকে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছে যাওয়া সম্ভব’, লর্ড গ্রেনারভান বললেন।

    পাজালেন মুহূর্তকাল নীরবে চিন্তা করে কাগজ তিনটার মধ্যে একটার ওপর চোখ বুলাতে বুলাতে বললেন, এক মাসে যদি সাম্রা সবই হয় তবে এর সাত তারিখের আগে এক বা দুই যা হােক কিছু লেখা ছিল, মুছে গেছে।'

    | ডানকান জাহাজ বিশে ডিসেম্বর বারনউইলি অন্তরীপে পৌছে গেল। দু-বছর বাদে ব্রিটানিয়া জাহাজটার ধ্বংসাবশেষভাঙাচোরা অংশের হদিস এখন আর পাওয়া সম্ভব নয়। তবে এত হ্যাপা করে যখন এসেই পড়া হয়েছে উল্লাশি চালিয়ে দেখতেই হবে। | লর্ড গ্রেনারভান মনস্থির করে ফেলেছেন, এখানে যদি নেহাৎই ব্রিটানিয়া জাহাজটার বা ক্যাপ্টেন গ্রান্টের হদিস না পান তবে ইউরােপেই ফিরে যাবেন। কারণ পাজালেন তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ব্রিটানিয়া এখানে তলিয়ে না গিয়ে যদি অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে তলিয়ে গিয়ে থাকে তবে অনেক আগেই ক্যাপ্টেন গ্রন্ট ইউরােপে ফিরতেন। সেখানে ফেরার জাহাজের সমস্যা নেই আর ইংরেজদের উপনিবেশও রয়েছে সেখানে। কিন্তু ডানকান বর্তমানে যেখানে অবস্থান করছে পশ্চিম উপকূলে উপনিবেশ তাে দূরের কথা, কেবলই মরু অঞ্চল।

    জাহাজ থেকে নেমে অভিযাত্রীরা সামান্য এগােতেই এক পল্লীতে হাজির হল। বেশ বড়সড় একটা বাড়ি থেকে এক প্রৌঢ় চারটে ছেলে ও চারটে কুকুর নিয়ে তাদের কাছে এল । তাদের অভ্যর্থনা করে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল।

    মিস্টিরিয়াস ডকুমেন্ট Pdf

    ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের উনত্রিশে জুলাই। নর্থ চ্যানেল দিয়ে হেলতে দুলতে একটা ছােট্ট জাহাজ এগিয়ে চলেছে। তার চোঙ দিয়ে গল গল করে ধোয়া বেরােচ্ছে। মাস্তুলের ডগায় ব্রিটিশ পতাকাটা পৎপৎ করে উড়ছে। আর সােনালি সুতাে দিয়ে আঁকা ইংরেজি ‘ই, জি.' অক্ষর দুটো, মার্কুইসের নিম্নপদস্থ অভিজাত আর্লের সম্মানসূচক চিহ্ন।

    জাহাজটার গায়ে তার নাম 'ডানকান' কথাটা স্পষ্টা অক্ষরে লেখা। মালিকের নাম লর্ড গ্লেনারভান। তিনি ইংল্যান্ডের রয়্যাল টেমস ইয়ট ক্লাবের এক নামকরা সদস্য। তাঁর সহধর্মিণীও লেডি হেলেনা সঙ্গে রয়েছেন। আর রয়েছেন তার খালাতাে ভাই ম্যাকনবস।

    জাহাজ উত্তাল উদ্দাম সমুদ্রের বুক চিরে উল্কার বেগে ধেয়ে চলেছে। হঠাৎ দূরে, অনেক দূরে একটা বিশালায়তন মাছ দেখা গেল ।

    জাহাজের ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করে লর্ড গ্লেনারভান জানতে পারলেন, সেটা একটা হাঙর। এরা স্থানীয় মানুষদের কাছে 'ব্যালেন্স ফিস' নামে পরিচিত। দুর্দান্ত প্রকৃতির। লর্ড গ্রেনারভান ক্যাপ্টেনকে নির্দেশ দিলেন হাঙরটাকে মারার জন্য।

    ব্যাপারটা লেডি হেলেনাকে দেখানাের জন্য তাকে ডেকে আনানাে হল।

    নাবিকরা মােটা দড়ির মাথায় শক্ত বঁড়শি বেঁধে তার সঙ্গে মাংসের টুকরাে গেঁথে দিল। এবার সেটাকে ফেলে দেয়া হল সমুদ্রের পানিতে। মাংসের গন্ধে হাঙরটা দ্রুত বেগে ধেয়ে এল। তার কালাে আর ছাই রঙের ডানাটা কেবল জলের ওপর ভেসে রইল। থেকে থেকে তার মাথাটা ভুস করে জলের ওপর ভেসে উঠতে লাগল। হাঁ করামাত্র ঝকঝকে চকচকে দাতের পাটি সূর্যের কিরণে স্পষ্ট দেখা যেতে লাগল। ক্যাপ্টেন ঠিকই বলেছেন, এরা মৎস্যপরিবারের জঘন্যতম প্রাণী। | ছুটতে ছুটতে এসে হাঙরটা টপ করে বঁড়শিসহ মাংসের টুকরােটা গিলে ফেলল । ব্যাস, দড়ি ধরে টানতে শুরু করল। তাকে কাবু করার জন্য এবার তারা ল্যাজে দড়ির ফাঁস পরিয়ে দিল। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে সবাই মিলে ডেকের ওপর তুলে নিল। একজন নাবিক মসৃণ কুড়লের এক কোপে তার ল্যাজটাকে কেটে ফেলল। | নাবিকরা এবার তার পেট চিড়ে সােনা দানা কিছু আছে কি না দেখতে লাগল।

    লেডি হেলেনা সে ধীভৎস দৃশ্য চোখের সামনে দেখতে না পেরে দ্রুত নিজের কেবিনে চলে গেলেন। হাঙরটার ওজন প্রায় দুশাে পাউন্ড। আর দৈর্ঘ্য দশফুট তাে হবেই। সেটাকে টুকরাে টুকরাে করে নাবিকরা জলে ফেলে দেয়ার জন্য। তৈরি হতে লাগল। ঠিক তখনই দেখা গেল তার পাকস্থলিতে পাথরের টুকরাের মতাে কী যেন ঝুলছে। ঘাটাঘাটি করে তারা একটা 'বােতল বের করল। ক্ষিদের জ্বালায় কবে এটাকে গিলে ফেলেছিল কে জানে। বােতলের কথা শুনে কেবিন থেকে লেডি হেলেনা ছুটে এলেন। বােতলের ছিপিটা খােলা হল। তার ভেতর থেকে বের করা হল কয়েকটা কাগজের টুকরাে । খুবই জীর্ণদশা। কী সব লেখা সেগুলাের গায়ে। প্রায় মুছে গেছে। তিনটে কাগজেরই একই হাল হয়ে গেছে। লর্ড গ্লেনারভান কাগজ তিনটেকে আলাের সামনে নিয়ে বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলেন। তিনটে দলিল। ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান তিন ভাষায় তর্জমা করা। যেটুকু ইংরেজিতে লেখা তা হল-'Sink, a land, this, and. los, শব্দগুলাে সম্পূর্ণ। আর 'Skipp' এক জায়গায় লেখা, শেষেরটুকু মুছে গেছে। লর্ড গ্লেনারভান বললেন, 'Skipp" বলতে 'Skipper' বুঝানাে হচ্ছে। আর একজায়গায় লেখা রয়েছে gr'! লর্ড গ্লেনারভান বললেন, 'মনে হচ্ছে 'gr' জাহাজটার নামের অংশবিশেষ। অর্থাৎ যে জাহাজটা সমুদ্রে তলিয়ে গেছে তার কথা বলতে চাইছি।'

    ক্যাপ্টেন কাগজটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বলতে লাগলেন, 'docum এবং asistance শব্দাংশ দুটোর বক্তব্য। অবশ্য পরিষ্কার। নিশ্চয়ই এদের একটার দ্বারা document এবং Assistance অন্যটার দ্বারা বুঝে নিতে হবে।'

    | 'সবই তাে বুঝলাম। কিন্তু অনেকগুলাে ছত্র যে মুছে গেছে। জাহাজের নাম, জাহাজডুবির জায়গাটার নাম-ঠিকানা কিছুই তাে পাওয়া যাচ্ছে না।' মেজর কপালের চামড়ায় চিন্তার ভাঁজ এঁকে বললেন।

    এবার ক্যাপ্টেন দ্বিতীয় কাগজটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললেন, 'সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে এটার। এখানে লেখা '7 Juni' মানে ৭ জুন, ইংরেজি কাগজটার সঙ্গে তারিখটা জুড়ে দিলে মানে দাঁড়াচ্ছে, ৭ জুন, আঠারােশাে বাষট্টি। জার্মান glas-এর পাশে ইংরেজি ‘gow-কে এনে রাখলে মানে দাঁড়াচ্ছে Glasgow'। এতে বােঝা যাচ্ছে, জাহাজটা গ্লাসগাে বন্দরের। কিন্তু দ্বিতীয় ছত্রটার অস্তিত্বই নেই। সম্পূর্ণ মুছে গেছে। তবে তৃতীয় ছত্রে দুটো খুবই দরকারি দুটো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে । জার্মান ভাষায় "Zwei' মানে দুই। আর atresen' বা 'matrosen' উভয়ের অর্থই নাবিক। চতুর্থ ছত্রে দেখা যাচ্ছে 'graus' শব্দটার অর্থ ঠিক বুঝতে পারছি নে। তৃতীয় কাগজটা থেকে যদি এর অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব। হয়। আর বাকি শব্দ দুটো-'bring ibein' আর 'bring ihhen'-কে ইংরেজি 'assistance' অথবা 'assistance'-এর। পাশে রাখলে হবে 'bring them assistance'—এতে বুঝাচ্ছে সাহায্য পাঠাও।

    লর্ড গ্লেনারভার বললেন, 'সাহায্য পাঠাতে বলছে। কিন্তু কীরকম সাহায্যের কথা বলতে চাইছে তার পরের কাগজটা থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে।' তৃতীয় কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে তিনি এবার বললেন, 'এটা ফরাসি ভাষায় লেখা । আমাদের কারােরই পড়তে অসুবিধা হবে না। এই যে, এখানে লেখা 'trols' এবং 'ats'-বলতে চাইছে, 'trois mats' অর্থাৎ তিনটে মাস্তুল বিশিষ্ট জাহাজ! ফরাসি আর ইংরেজি কাগজ দুটোর বক্তব্য জুড়ে জাহাজটার নাম পাওয়া যাচ্ছে 'Britania' এবং 'Austral'-এর ফরাসি ও ইংরেজিতে একই অর্থ—দক্ষিণ দিক।'

    সিটি ইন দ্য সাহারা Pdf 

    পৃথিবীর প্রায় তিনলক্ষ বর্গমাইল এলাকা মরুভূমির অবস্থান। এ শতকের প্রারম্ভে আধুনিক মানচিত্রে এ জায়গাকে ফাকা দেখানাে হয়েছে। বারজাক কমিশন যখন অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট স্বীকার করে অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন এ মরুভূমি অতিক্রম করা তাে দূরের ব্যাপার কেউ পদচিহ্নও আঁকেনি এর বুকে । আসলে সাহারা তখনাে সভ্য মানুষের কাছে অজানা-অচেনা ছিল। তখন থেকে এ-অঞ্চলটাকে নিয়ে কতই না মজার মজার কল্পকাহিনী লােকের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াত। কারাে কারাের মুখে শােনা যেত, লকলকে আগুনের শিখা মুখ দিয়ে অনবরত নির্গত করতে করতে আগুন-পাখি মরুপ্রান্তরের ওপর দিয়ে চক্কর মেরে বেড়াতে দেখেছে। তার চোখ দুটো দিয়েও নাকি আগুনের শিখা ঠিকরে বেরতাে। আবার লাল দৈত্যাকৃতি দস্যুরা নাকি দল বেঁধে মরুভূমির বুকের ওপর দিয়ে ছুটে যেত । আগুনে জ্বালিয়ে পুরিয়ে খাক করে দিত একের পর এক শহর। লুঠ করে আবার উদ্ধার বেগে ধেয়ে যেত মরুভূমির বুকে। মােট কথা মরুভূমি ছিল অপদেবতাদের নিশ্চিন্ত বাসস্থল। কেউ এ রহস্যভেদ করতে প্রয়াসীও হয় নি। সমগ্র নাইজার এবং মরুভূমির প্রান্তদেশ থেকে প্রায় একশাে মাইল পর্যন্ত আজও অসহায় মানুষরা এমনি হাজারাে গুজবে আতঙ্কিত বুকে শুনেছে। ভয় ডরে সিটকে থেকে এমনি করে কাটিয়েছে সহায়সম্বলহীন মানুষগুলাে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আর বছরের পর বছর।

    কিন্তু কেউ যদি দুঃসাহসের কাধে ভর করে মরুভূমির অভ্যন্তরে ঢুকে যেত তবে চমৎকার একটা শহর দেখে চোখ ও মনকে তৃপ্ত করতে পারত। শহর বলতে যা বুঝায় সবই তার রয়েছে। এর বয়স্ক অধিবাসীর সংখ্যা ছ'হাজার আটশশা আট। কিন্তু ম্যাপে স্থান লাভ করার সৌভাগ্য এর হয়নি। সাহসে ভর করে যে কোনাে অভিযাত্রী মরুর কেন্দ্রস্থলের দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানতে পারবে শহরটার নাম ‘ব্ল্যাকল্যান্ড'।

    আফ্রিকার জঙ্গলে যখন বারজাক কমিশন অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে পথ পাড়ি দিচ্ছিলেন, তখন ব্ল্যাকল্যান্ড শহরে অবস্থান করছে পাঁচ হাজার সাতশাে আটাত্তর জন সাদা চামড়ার মানুষ। তাদের অধিকাংশই জেল পালানাে কয়েদি আর এরকমই কোনাে না কোনাে অসামাজিক কাজে অপরাধী। তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পালিয়ে এখানে এসেছে বলে তাদের জাত, ধর্ম ও ভাষা ভিন্ন ভিন্ন। তবে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ইংরেজরা। তাই সরকারী কাজকর্ম সবই চলত ইংরেজিতে। ব্ল্যাকল্যান্ডে থান্ডার বােল্ড' নামে একটা দৈনিক সংবাদপত্রও প্রকাশিত হত ইংরেজি ভাষাতেই। সংবাদপত্রটার রকমসকম কেমন অদ্ভুত প্রকৃতির ছিল, তা তার কয়েকটা সংখ্যার বক্তব্য পড়লেই সম্যক ধারণা করে নেওয়া সম্ভব। একটা সংখ্যায় ছাপা হয়েছে—নিগ্রো কোরােমােকো মধ্যাহ্ন ভােজনের পর পাইপ আনতে ভুলে যাওয়ার জন্য জন অ্যান্ড তাকে ফাসির কাঠে ঝুলিয়েছেন। আর একটা কাগজে ছাপা হয়েছে, কর্নেল হিরাম হার্বাট দশজন মেরিফেলােসহ হেলিপ্লেনে চেপে আগামীকাল সন্ধ্যা ছটায় কৌরসৌ ও বিডি যাচ্ছেন। তিন বছর বাদে ফের গ্রামের ওপর হামলা হুজ্জতি চালিয়ে, বেধড়ক হত্যা আর লুঠতরাজ চালিয়ে প্রচুর ধনদৌলত নিয়ে চম্পট দেবে।' আর একদিনের খবর-খবর পাওয়া গেছে বারজাক নামক এক ডেপুটির অধিনায়কত্বে কোনাক্রি থেকে অতি শীঘ্র এক ফরাসি অভিযাত্রী দল যাত্রা করছে। কমিশন সিকাসাে ও ওখাদৌগৌয়ের ওপর দিয়ে নাইজারে যাবে । দুজন মেরিফেলাে এবং বিশজন ব্ল্যাক গার্ড নিয়মিত কমিশনের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে চলবে। পরবর্তীকালে ক্যাপ্টেন এডােয়ার্ড রুফুজের দলে যােগ দেওয়ার কথা, তিনি পদাতিক সেনাবাহিনীর একজন পলাতক সৈনিক। তিনি কৌশলে সুযােগ মতাে লেফটেন্যান্ট ল্যাকোর ছদ্মনামে বারজাকের অভিযাত্রীদের দলে ভিড়ে যাবেন। তার একমাত্র উদ্দেশ্য থাকবে অভিযাত্রীরা যাতে নাইজারে পৌছতে না পারে, কৌশলে সে প্রয়াস চালিয়ে যাবেন। | কাউন্সিলর এ হল উহলিস ভাবলেন মেরিফেলাে কনস্টানটিন বার্নাডের মাথার খুলির মধ্যে কয়েকটা কার্তুজ ঢুকিয়ে দিতে হবে। তাঁর মাথার খুলির ওজন এমনিতেই বেশি, তার ওপর কার্তুজের ওজন যােগ হলে সেটা অনায়াসেই রেড রিভারের জলে ডুবে যাবে। বার্নাডের পরিবর্তে গিলম্যান হিলিকে নতুন মেরিফেলাে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। তিনি জার্মানি, ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের আদালত থেকে সতেরাে বার শাস্তি পেয়ে মােট উনত্রিশ বছর কারাগারে এবং পয়ত্রিশ বছর জাহাজের খােলের অন্ধকারে কাটাননার শাস্তি পেয়েছিলেন। গিলম্যানক সিভিল বডি থেকে মেরিফেললার বাড়িতে আনা হল।

    প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী ব্ল্যাকল্যান্ড কেবলমাত্র চিফ এবং জনা কয়েককে ছাড়া কাউকেই পদবি অনুযায়ী সম্বােধন করা হবে না। একমাত্র চিফ'ই পদবি জানবেন। তাই খবরগুলােতে কেবলমাত্র পদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। চিফের এক নাম অবশ্যই আছে। সে নাম শুনলেই বুকের ভেতরে ঢিবঢিবানি শুরু হয়ে যায় । ভয়ঙ্কর সে নামটা হচ্ছে-‘হ্যারি কিলার'।

    বারজাক কমিশনের অভিযান ব্যর্থ হওয়ার দশ বছর আগে হ্যারি কিলার এখানে আস্তানা গেড়েছিল। সে যে কোনো দেশের কোনাে অঞ্চল থেকে এখানে উদয় হয়েছিল কারােরই জানা নেই। সাম্প্রতিককালে যে অঞ্চল ব্ল্যাকল্যান্ড বলে চিহ্নিত সেখানে একটা তাঁবুর খুঁটি মাটিতে গুঁজে দিয়ে ঘোষণা করেছিল, এখান থেকেই নগর পত্তন করা হােক। ব্যস, এবার ভেজবাজির খেলার মতাে বিস্ময়কর নগরী ব্ল্যাকল্যান্ড’ গড়ে উঠল।

    | তখন তাফাসেট আউদ একটা মজে যাওয়া খাল বা খাদ । হ্যারি কিলারের প্রয়াসে সেটা জলপূর্ণ হয়ে একটা নদীতে পরিণত হয়ে গেল। তার বাঁ দিকে গড়ে উঠল নগর। তার ক্ষেত্রফল তিনশাে বিঘার কিছু বেশি। প্রাচীর তুলে নগরটাকে তিনটে ভাগে বিভক্ত করা হল। নদীটার নাম দেওয়া হল হ্যারি কিলার রেড রিভার'। নদীর তীরবর্তী নগরটার ব্যাসার্ধ দুশাে পঞ্চাশ গজ। একটা চমৎকার বাগিচা নদীর তীরের প্রথম অংশের সঙ্গে দ্বিতীয় আর তৃতীয় অংশের সংযােগ সাধন করেছে। এতে প্রথম অংশের সঙ্গে ক্ষেত্রফল বেড়ে গিয়ে মােট ক্ষেত্রেফল দাঁড়িয়েছে প্রায় এক শাে বিঘা।

    দ্য পারচেজ অব দ্য নর্থ পােল Pdf

    জে, টি. ম্যাসটন ও মিসেস স্করবিট তখন নারীর প্রতিভা নিয়ে আলােচনায় লিপ্ত । ম্যাসটনের মতে পৃথিবীর কোনাে কোনাে নারী অঙ্কের প্রতিভা নিয়ে জন্মেছেন বটে, তবে রাশিয়ায় এরকম প্রতিভা সম্পন্ন নারীর অস্তিত্ব নেই। তারা আর যাই পারুক না কেন, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একেবারেই অচল। কোনাে নারীই কেপলার, প্লেস বা ইউক্লিড-এর সমকক্ষ হওয়া তাে দূরের ব্যাপার তাদের কাছাকাছিই যেতে পারেনি।

    মিসেস স্করবিট কিন্তু ম্যাসটনের যুক্তি কিছুতেই মানতে নারাজ। তার মতে অতীতের নারী সমাজের সঙ্গে আজকের নারী সমাজের তুলনা করতে বসলে ভুলই করা হবে। অতীতের মাপকাঠি দিয়ে ভবিষ্যতের বিচার করতে বসার অর্থই হচ্ছে চরমতম ভুলকে আঁকড়ে ধরে থাকা।

    মিসেস স্করবিট নিজেকে অবলা ও দূর্বল ভাবতে কিছুতেই রাজি নন। তিনি আমেরিকান। দারুন একটা কঠিন ও সমস্যা সঙ্কুল ব্যাপারে তিনি উৎসাহী হয়েছেন। দুহাতে টাকা খরচ করে পরিকল্পনা তৈরি করেছেন। তার পরিকল্পনাটা মােটামুটি এরকম

    সেন্ট মার্টিন, মালটি ব্রান এবং রিকুজ প্রভৃতি ভূগােল-বিশারদদের মতে সুমেরু অঞ্চল ৭৮° অক্ষরেখার ওপর অবস্থিত। আর তার সাত লক্ষ বর্গমাইল এলাকা জল ও চৌদ্দ লক্ষ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে রয়েছে স্থলভূমি।

    একালের অকুতােভয় অভিযাত্রীরা ৮৪° অক্ষাংশের ওপরেই। কিন্তু ওই হিমশৈল অতিক্রম করার ক্ষমতা কারােরই। নেই। সুমেরু অবধি ৬° অক্ষাংশে জল না স্থলভূমি বিরাজ করছে তা আজও মানুষের কাছে অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। | আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সরকার আঠারাে শশা খ্রিস্টাব্দে মনস্থ করলেন, সুমেরুর চারদিকে যে-অনাবিষ্কৃত অঞ্চল অবস্থান করছে তা নিলামে বিক্রি করে দেবেন। উত্তরমেরু অঞ্চল ক্রয় করার উদ্দেশ্য নিয়ে একটা আমেরিকান সংস্থা আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল ।

    তবে এও সত্য যে, বার্লিনের এক বৈঠকে অন্যের জমিতে হানাদার বৃহৎ শক্তিগুলির জন্য, আলােচনার মাধ্যমে কিছু নিয়মকানুন তৈরি করা হয়। বৃহৎ শক্তিগুলি যেন উপনিবেশ গড়ে তােলার ব্যাপারে সে সব শর্ত পালন করে এটাই ছিল বৈঠকের উদ্দেশ্য। কিন্তু বার্লিন-বৈঠকে বেশ কিছু সংখ্যক দেশ মােটেই আমল দেয় নি। তাদের মতে, উত্তরমেরুর জমি জায়গা কারাের অধিকারেই থাকতে পারে না, নেইও। সেখানে কোনাে বসতিও নেই। অতএব সেখানে সবারই সমান অধিকার।

    তাই সদ্য গড়ে ওঠা সংস্থা উত্তরমেরুর দখলই কেবল নয়, অন্যের দখলের প্রতিবন্ধকতাও করতে আগ্রহী।

    আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে কেউ কোনাে মহৎ প্রয়াসে লিপ্ত হলে সেখানে টাকার অভাব হয় না। মাত্র কয়েক বছর আগে বাল্টিমাের গান-ক্লাব চাঁদের উদ্দেশ্যে এক প্রােজেকটাইল পাঠাতে গিয়ে হাতেনাতে এর প্রমাণ পেয়েছে। তাদের লক্ষ্য ছিল-চাদের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ স্থাপন করা। অবিশ্বাস্য ঝুঁকিটি নেওয়ার জন্য গান-ক্লাবের সদস্যদের বাহবা দিতেই হয়।

    সুমেরুকে নিলামে খরিদ করার পরিকল্পনাটা নিয়ে দেশজুড়ে নানারকম কথাবার্তা উঠল। চাঁদার খাতা না থাকার দরুন বিশেষ জটলার উদ্ভব হল। সংস্থাটি আগে থাকতে চাঁদা সংগ্রহের প্রয়ােজন বােধ করে নি।

    প্রচুর পরিমাণ নগদ অর্থ নিয়েই তারা নিলামে উত্তরমেরু ক্রয় করার ইচ্ছার কথা প্রচার করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্চে,উত্তরমেরু ক্রয় করে ফয়দা কী হবে? সেটা কোনাে উপকারে আসবে কি? না। কোনাে কিছুতেই কোনােদিক থেকে ফয়দা লােটা যাবে না। তাই পরিকল্পনার কথাটা শােনামাত্র সবাই বলে উঠল, ‘কোন উর্বর মস্তিষ্ক ছাড়া কারাে মাথায় এমন উদ্ভট খেয়াল কিছুতেই চাপতে পারে না।' | সংস্থার পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার কাজে কিন্তু তিলমাত্রও গাফিলতি ছিল না। পৃথিবীর সব দেশের খবরের কাগজের পাতায় ছাপিয়ে দেওয়ার জন্য দুটো বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার খবরের কাগজের জন্য একটা আর অন্যটা ইউরােপের খবরের কাগজের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমেরিকার খবরের কাগজের পাতায় যে বিজ্ঞপ্তিটা ছাপা হয় তার বক্তব্য হচ্ছে—

    “৮৪৭ ডিগ্রির ওপর অবস্থিত সুমেরু অঞ্চলটি অনাবিষ্কৃত থাকার জন্য এতদিন নিলামে তােলা হয় নি। ১৮৪৮ সালের জুলাইয়ে ৮২৭-৪৫ পর্যন্ত ইংরেজ অভিযাত্রী প্যারি পৌছতে সক্ষম হয়েছিলেন। স্পিটবার্গের পশ্চিম দিকে জায়গাটার অবস্থান। অভিযাত্রী স্যার জন জর্জেস নারেস ১৮৬৭-র মে মাসে ৮৩°-২৪-২৮ পর্যন্ত অগ্রসর হতে পেরেছিলেন। তার অবস্থান গ্রিনল্যান্ডের উত্তর দিকে। আমেরিকার অভিযাত্রীরা ১৮৮২-এর মে মাসে লেফটেন্যান্ট থিলির অধিনায়কত্বে ৮৩°-৩৫ অক্ষাংশ পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন। নারেসল্যান্ডের পশ্চিমদিকে তার অবস্থান।

    | ব্যস, কোনাে অভিযাত্রীর পক্ষেই এর বেশি অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয় নি। ৪৮-র পর ৬ পরিমাণ অঞ্চল সুমেরুবিন্দু পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ও অখণ্ড এক অঞ্চল। তাই একরম একটা অঞ্চলকে নিলামে কিনে নিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পত্তিতে পরিণত করা সম্ভব নয়।

    বিশাল অঞ্চলটা কারাের মালিকানাধীন না থাকার জন্য এখানে কোনাে বসতি গড়ে ওঠে নি। সে কারণে যুক্তরাষ্ট সরকার সাব্যস্ত করেছে, একটা সিদ্ধান্তে এসে বিশাল অঞ্চলটাকে কাজে লাগাতে হবে। 

    ফাইভ উইকস ইন এ বেলুন

    ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাস। রয়্যাল ভৌগােলিক সমিতির সভাকক্ষ। সমিতির সদস্যরা জরুরি এক সভায় মিলিত হয়েছেন। সভাপতির ভাষণ শেষ হতেই করতালিতে সভাকক্ষ মুখরিত হতে লাগল। তিনি আসন গ্রহণ করার পূর্ব মুহূর্তে বললেন, "ইংল্যান্ড ভৌগােলিক তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। ইংল্যান্ডের সে খ্যাতি ড. ফারগুসন বৃদ্ধি করতে চলেছেন। তিনি যদি সাফল্য লাভ করেন।'

    তার কথার ফাকে শ্রোতাদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলেন, 'অবশ্যই সাফল্য লাভ করবেন।'

    পূর্ব কথার জের টেনে সভাপতি বলে চললেন-“হ্যা, তিনি সাফল্য লাভ করলে আফ্রিকার অসম্পূর্ণ মানচিত্রকে সম্পূর্ণ করে তােলা সম্ভব হবে। আর যদি ব্যর্থ হন তবে প্রমাণিত হবে, মানুষ যে কেবলমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী তাই নন, সাহসিকতার দিক থেকেও তার সমকক্ষ কেউ নেই।

    তার ভাষণ শেষ হতে না হতেই আবার ঘন ঘন করতালি শুরু হয়ে গেল। ব্যস, চাঁদ ওঠা শুরু হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তার অভিযান উপলক্ষ্যে সাইত্রিশ হাজার পাঁচ শে পাউন্ড জোগাড় হয়ে গেল।

    ডা, ফারগুসন তখন সভাকক্ষে অনুপস্থিত। উপস্থিত সদস্যরা তাকে একবারটি চক্ষুষ দেখার জন্য বায়না ধরল। কেউ কেউ এমন মন্তব্যও করল, আসলে ফারগুসন নামে নাকি কারাের অস্তিত্বই নেই । পুরাে ব্যাপারটাই ভাওতা।

    | সভাপতির অনুরােধে গম্ভীর প্রকৃতির মাঝবয়সী এক জ্বলােক সভাকক্ষে প্রবেশ করলেন। তাঁর বয়স চল্লিশের কাছাকাছি।

    আগন্তুক মঞ্চে উঠতেই সবাই লক্ষ্য করল, তিনি পেশীবহুল দীর্ঘাকৃতি একজন সুপুরুষ। পা দুটোর দিকে এক নজরে তাকালেই নিঃসন্দেহ হওয়া যায়, তিনি দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে সক্ষম।

    আগন্তুক ডান হাতের তর্জনি উচিয়ে গুরু গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করলেন, “ঈশ্বরের ইচ্ছাই পূর্ণ হােক!'

    ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে করতালিতে সভাকক্ষ মুখরিত হয়ে উঠল। মুহূর্তে তিনি উপস্থিত হাজার হাজার শ্রোতার অন্তরের অন্তঃস্থলে স্থায়ী আসন লাভ করে ফেললেন।

    ফারগুসনের পিতা ছিলেন, ইংরেজ নৌ-সেনাবিভাগের একজন দুঃসাহসী সেনাপতি। বালক ফারগুসনকে সঙ্গে করে তিনি সাগরে-সাগরে ঘুরে বেড়াতেন, যুদ্ধের সময়েও কাছে কাছে রাখতেন। বিপদ যত কঠিনই হােক না কেন কিছুতেই তাকে কাছছাড়া করতেন না। বাল্যের সে দিনগুলাে থেকেই বিপদকে পায়ের ভৃত্য করতে শিখে ফেললেন। বয়স আর একটু বাড়লে ভ্রমণ কাহিনী পাঠে মন দিলেন। ছেলের ইচ্ছার কথা বুঝতে পেরে তার বাবা তাকে পদার্থবিজ্ঞান, বলবিদ্যা, জলবিদ্যা, জ্যোতিষবিদ্যা এবং ভেষজবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞানবান করে তােলার জন্য শিক্ষালাভের ব্যবস্থা করলেন।

    | বাবা মারা গেলে ফারগুসন সেনাবিভাগে যােগ দিয়ে বাংলাদেশে হাজির হলেন। কিন্তু যুদ্ধের দামামা তার কাছে অসহ্য হয়ে পড়ায় তিনি চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে ভারতবর্ষ পর্যটনে বেরিয়ে পড়লেন। কলকাতা থেকে সুরাটের উদ্দেশ্যে তিনি পায়ে হেঁটে যাত্রা করলেন। তারপর এক এক করে রাশিয়া, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ সেরে এলেন।

    | ফারগুসন সভা-সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার চেয়ে ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় নিয়মিত ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখতে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন, লিখতেনও। তাই তার নামটার সঙ্গে সবাই পরিচতি ছিল। আর সভা-সমাবেশে বৃথা সময় নষ্ট না করে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে মেতে থাকাকেই তিনি বেশি পছন্দ করতেন।

    | ডেইলি টেলিগ্রাফের পাতায় একদিন ছাপা হল—আফ্রিকার মৌত এবার ভঙ্গ হতে চলেছে। দু হাজার বছরেও যে-দেশ অজ্ঞাত রয়ে গেছে তার রহস্য আজ উঘাটিত হবে নীলনদের উৎসস্থল আবিষ্কার এতদিন অসম্ভব বিবেচিত হত । দীর্ঘদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রয়াসে রহস্যাবৃত আফ্রিকার তিনটি প্রবেশপথ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। | ক্লাপার্টন আর ডেনহামের আবিষ্কৃত পথ ধরে ড, বার্থ সুদানে হাজির হন। ড. লিভিংস্টোন বহু কষ্ট ও শ্রম স্বীকার করে উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে জাম্বেসি অবধি গিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন স্পিক আর ক্যাপ্টেন গ্রান্ট আলাদা পথে অগ্রসর হয়ে কটা হ্রদ আবিষ্কার করেন। এ-পথ তিনটের মিলনস্থলই আফ্রিকার কেন্দ্রবিন্দু। ফারগুসন শীঘ্রই আফ্রিকার সে-কেন্দ্রবিন্দুর, উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবেন। আকাশযানে চেপে আফ্রিকার পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্তে পৌছবেন। জাম্বিয়া দ্বীপ থেকে বেলুনের। সাহায্যে পশ্চিমদিকে পাড়ি জমাবেন মনস্থ করেছেন। তার এ যাত্রা কোথায় এবং কীভাবে শেষ হবে তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।'

    ড, ফারগুসনের খবরটা ডেইলি টেলিগ্রাফের পাতায় ছাপা হতেই দেশজুড়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হল। উড়াে জাহাজ তখনও আবিষ্কৃত হয় নি। কেউ কেউ বলতে লাগল-বেলুনে চেপে এমন দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। কেউ বা বলল, “আসলে ফারগুসন বলে কারাের কোনাে অস্তিত্বই নেই। এটা ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর কারসাজি। ইংল্যান্ডের মানুষগুলােকে বােকা বানানােই তাদের মতলব। আবার ডেইলি টেলিগ্রাফকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে অন্যান্য খবরের কাগজগুলাে ফলাও করে লেখা ছাপতে লাগল । ব্যাস, ফারগুসন এক্কেবারে চিপসে গেলেন।'

    কদিন বাদে শােনা গেল ফারগুসনের বাঞ্ছিত বেলুন তৈরি করে দিতে লায়ন কোম্পানি রাজি হয়েছে।

    ইটারন্যাল অ্যাডাম Pdf

    জারটা মাথার ভেতরে জটপাকানাে চিন্তা নিয়ে অস্থিরচিত্ত জারটগ একা পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন। কিসের চিন্তা? মনুষ্যজাতির অতীতের কথা নিয়ে তিনি ভাবনায় ডুবে রয়েছেন। তিনি একজন মহা পণ্ডিত। পৃথিবীর ইতিহাস তাঁর নখদর্পণে । তা ছাড়াও বহু বিষয়েই তার পাণ্ডিত্য রয়েছে। এতকিছু সত্ত্বেও বহু বিষয়ের রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন ভদ্রলােক।

    | তাঁর সমসাময়িককালের ইতিহাস তিনি খুব ভালােই রপ্ত করেছেন। আট হাজার বছরের অতীত কাহিনীর কথা বলতে চাইছি। কিছু সংখ্যক মানুষের নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি করে মরার ইতিহাস। ছােট্ট এক এক চিলতে জায়গায় অনেক মানুষ বসবাস করতে গেলে যা হয় সে কথা বলতে চাইছি। কেপহর্ণ ও বার্লিনের মধ্যবর্তী ছােট্ট ভূখণ্ডটুকুকে কেন্দ্র করে আট হাজার বছর ধরে কম মারামারি কাটাকাটি হয়নি, কম রক্তপাত ঘটে নি। কেবলমাত্র এ অংশটুকুই ভূখণ্ড, অবশিষ্টাংশে তাে কেবল জল আর জল। সম্পূর্ণ পৃথিবীকে জল বেষ্টন করে রেখেছে। তাই তাে আট হাজার বছরের ইতিহাসের পাতায় কেবল রক্ত আর রক্ত ছড়িয়ে রয়েছে। জারটগ যে সাম্রাজ্যের নাগরিক তার এক শ' পঁচানব্বইতম বার্ষিকী উৎসব, এই তাে সবে উদযাপন করা হল। সাম্রাজ্যটার বিচিত্র এক নামকরণ করা হয়েছে।

    এর চারদিকে সমুদ্র অবস্থান করছে বলে এর নামকরণ করা হয়েছে 'চার সাগরের দেশ। আট-আটটা হাজার বছর ধরে এখানকার মানুষ অনবরত লড়াই-ই করে এসেছে। আট হাজার বছরের লড়াইয়ের কাহিনীকে চারটে ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। শেষের দিকে তিনটে সম্প্রদায় একটু বেশি করে হাত-পা ছোড়াছুঁড়ি করেছিল। শেষপর্যন্ত দুটো সম্প্রদায়কে পরাজিত করে একটা সম্প্রদায় চাঙা হয়ে উঠল ।

    প্রায় দুশ' বছর আগে এক ভয়ঙ্কর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ছােট্ট একটা ভূখণ্ডে জারটগদের সাম্রাজ্য ‘চার সমুদ্রের দেশের জন্ম হয়। 


    আট হাজার বছর ধরে মানুষ হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। প্রথমে তারা শিখল লিখতে। তারপর একরকম লেখার ছাঁচ তৈরি করল। তা থেকে বহু সংখ্যক কপি করার পদ্ধতি মাথা খাটিয়ে বের করল। একজনের চিন্তা-ভাবনাকে অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার উপায় রপ্ত করল।

    এবার এক এক করে কয়লা, বাষ্পশক্তি ও যান্ত্রিকশক্তি উদ্ভাবন করা হল। মাত্র পাঁচ শ' বছর আগে বিদ্যুৎ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। জারটগদের পূর্বপুরুষরা আকাশের বিদ্যুৎকে নিজ বশে নিয়ে এল।

    আসল প্রশ্ন তাে এটা নয়। তার সমাধানতাে এখনাে হল না। এ দুনিয়ার মালিক যে মানুষ, তার প্রকৃত পরিচয় কি ? কে এই মানুষ? কোথা থেকে আসে এ-মানুষ? যায়-ই বা কোথায় ?

    ভূতত্ত্ববিদরা ভূত্বক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন পৃথিবীর বয়স চার শ’ হাজার বছর। চার সাগরে ঘেরা এদেশ, মহাদেশ বললেও অত্যুক্তি হবে না। গােড়াতে এটা জলের নিচে অবস্থান করছিল। এর মাটির প্রকৃতিই বলে দিচ্ছে এদেশ জলের নিচ থেকে উঠে এসেছে। সে না হয় হল, কিন্তু কি করে তা সম্ভব হয়েছে ? এত বড় একটা দেশকে কোনাে শক্তি ঠেলে ওপরে তুলে দিয়েছে? পাহাড় সংলগ্ন সামুদ্রিক পলিমাটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এমন অনেক তত্ত্ব জানা সম্ভব হয়েছে। মানুষ, পশু, পাখি প্রভৃতি কি সমুদ্রের বুক থেকে উঠে এসেছে ? তবে এদের উৎপত্তি কীভাবে সম্ভব হল? মানুসের উত্তরসূরীদের নিয়েই তাে সে-জিজ্ঞাসা ।

    ভূতত্ত্ববিদদের মতে বিশ্ব সংসারের যাবতীয় স্থলভূমিই এক সময় জলের নিচে ছিল। সবই জল থেকে সৃষ্টি হয়েছে।

    তবে? তবে বিচিত্র এসব মাথার খুলিগুলাে কোথেকে এল? তাদের অবস্থানও কি জলের নিচেই ছিল ? জারটগ মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করার সময় খুলিগুলাে উদ্ধার করেছেন। এগুলাে যে মানুষেরই মাথার খুলি কিছুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু এগুলাে বিভিন্ন মাপের। ছােট-বড়-মাঝারি বিভিন্ন রকম । ছােট খুলিগুলাে দু-তিন বছর আগেকার, সে তুলনায় শরীরের হাড়ের কাঠামােটা অনেক বড়। আরাে পিছিয়ে গেলে, অতীতের খুলির মাপ ক্রমেই বড় হয়ে গেছে। অর্থাৎ মস্তিষ্কের পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে কি আজকের মানুষের তুলনায় অতীতের মানুষ খুবই বেশি বুদ্ধিমান। ছিল। অবশ্যই না, সন্দেহের নামমাত্র অবকাশও নেই। অতীতের মানুষ অনেক বেশি বুদ্ধিমান ছিল। তাদের কাছে। জাটগদের শিশু বললেও কিছুমাত্রও বাড়িয়ে বলা হবে না।

    এ তাে অদ্ভুত ব্যাপার দেখা যাচ্ছে, বিবর্তনবাদ কি তবে ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়ে যাবে? পুরানাে খুলিগুলাে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা ও হিসাব-নিকাশ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেগুলাে বিশ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার বছরেরও আগের খুলি। তখনকার মানুষের মধ্যে সভ্যতার আলাে কতখানি বিস্তার লাভ করেছিল তা-তাে কোথাও লেখা-ঝােখা নেই। বিশ হাজার বছর পুরনাে কথা ভাবলেও রীতিমতাে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়।

    বিশ হাজার বছর আগের মানুষ জারটগদের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে ঢের উন্নত ছিল একথা শুনলেও লােকের হাসির উদ্রেক ঘটবে। তবে কোথায় সে সভ্যতা ? চল্লিশ হাজার বছর আগে যারা পৃথিবী জুড়ে আধিপত্য ঘটিয়েছিল।


    দ্য সিক্রেট অব দ্য আয়ল্যান্ড Pdf


    আজ দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হল। রহস্যময় লিঙ্কন দ্বীপে আজ সত্যি সত্যিই জাহাজ এসে নােঙর করল। কিন্তু দ্বীপবাসীরা মােটেই আনন্দিত হতে পারছে না। কেন? নির্বাসন-জীবনের অবসান ঘটতে চলেছে, তবু কেন তাদের মনপ্রাণ আনন্দের বদলে বিষাদে ভরপুর? আসলে দীর্ঘদিন অবস্থানের ফলে দ্বীপের প্রতিটা জিনিসের সঙ্গে আত্মিকযােগ, নাড়ীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে । আজ সে সম্পর্ক চিরদিনের মতাে ছিন্ন হতে চলেছে। | চোখে দূরবীণ লাগিয়ে পেনক্রফট জাহাজটার ওপর সতর্কদৃষ্টি রেখে চলেছে। জাহাজ ও দ্বীপের মধ্যে এখন বিশ মাইল ব্যবধান। দ্বীপবাসীরা বন্দুকের গুলির মাধ্যমে আওয়াজ করে পাহাড়ের মাথায় আগুন জ্বেলে এবং নিশানের মাধ্যমে সঙ্কেত জানিয়ে জাহাজের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার কোনােরকম ত্রুটি রাখল না ।

    ব্যাপারটা কিন্তু ভাববার মতােই বটে। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অবস্থিত অখ্যাত অজ্ঞাত এ দ্বীপটার খোজ কারােরই জানা নেই। তাই যদি হয় তবে জাহাজটা গতি এমুখাে কেন? কী তার উদ্দেশ্য? হার্বাটের সন্দেহ হল, এটা ডানকান জাহাজ হলেও হতে পারে। স্পিলেটের পরামর্শে টেলিগ্রাফ করে আয়ারটনকে তলব করা হল। সে দূরবীণটা চোখে লাগিয়েই বলে উঠল-'ধুৎ এটা ডানকান জাহাজ হতে যাবে কেন। ডানকানের তাে আসার কথাও নয়।'

    পেনক্রফট চোখে দূরবীণ লাগিয়েই রেখেছে। একসময় দেখল, জাহাজ অন্যদিকে মােড় নিয়েছে।

    হার্ডিং কিন্তু ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক মনে করতে পারলেন না। এ দ্বীপের দিকে জাহাজ আসার এমন কী কারণ থাকতে পারে?

    পেনক্রফট আর নেব পাহাড়ের মাথায় আগুন জ্বালার উদ্যোগ নিতে লাগল । পরমুহূর্তেই দেখা গেল, আবার জাহাজটার মুখদ্বীপের দিকে ঘুরে গেছে। তবে কি জাহাজটা বেলুন বন্দরেই নােঙর করবে?

    আয়ারটন দূরবীণের সাহয্যে স্পষ্ট লক্ষ করল, এতে ধোয়া বেরােবার চিমনি অনুপস্থিত। অতএব এটা কিছুতেই ডানকান হতে পারে না।

    | পেনক্রফট দূরবীণটা চোখে লাগিয়ে রেখেই বলে উঠল-জাহাজের মাস্তুলের ওপরের উড়ন্ত নিশানটা ইংল্যান্ডের নয় । ইংল্যান্ডের নিশানার রঙ লাল। আমেরিকারও নয় । জর্মানি বা ফ্রান্সেরও নয়। স্পেনেরও নয়। সে দেশের নিশান হলুদ। আর রাশিয়ার হলে সাদা হত । তবে যাই হােক না কেন এক রঙের—'

    | তার মুখের কথা শেষ হবার আগেই আয়ারটন দূরবীণের মুখটাকে অস্থিরভাবে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে সচকিত হয়ে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল—কী সর্বনাশা কাণ্ড! এ যে কালাে নিশান বলেই মনে হচ্ছে। তবে? তবে কি জলদস্যুদের জাহাজ ওটা!

    হার্ডিং সবাইকে প্রবােধ দিতে গিয়ে বললেন, 'ব্যাপারটা ভাববারই বটে। তবে এত সহজে মুষড়ে পড়লে চলব কেন? আবার এমনও তাে হতে পারে লিঙ্কলন দ্বীপ তাদের লক্ষস্থল নয়। তবু আমাদের সতর্ক হতেই হবে।'

    নেব আর আয়ারটন দৌড়ে গিয়ে বায়ুকলের ছাউনি নামিয়ে নিল। যাবতীয় আগুন নিভিয়ে দিল। আর ডালপালা দিয়ে গ্রানাইট হাউসের দরজা-জানালাগুলাে চাপা দিয়ে দিল। ম হার্ডিং এবার নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করতে গিয়ে বললেন, 'জলদস্যুরা যদি লিঙ্কলন দ্বীপ বা আমাদের ওপর চড়াও হয়, তবে আমাদের কর্তব্য কী হবে?' | সবাই সমস্বরে গর্জে উঠল, 'আমরা সর্বশক্তি নিয়ােগ করে প্রতিরােধ করব। জীবন গেলেও লিঙ্কলন দ্বীপের দখল হাতছাড়া করব না।'

    রাত ক্রমে গভীর হল। আচমকা কামান দাগার শব্দে উৎকণ্ঠিত দ্বীপবাসীরা সচকিত হয়ে পড়ল। কামানের গর্জন আর আলাের ঝলকানির মধ্যে সময়ের পার্থক্য ছিল মাত্র ছয় সেকেন্ড। হিসাবমতাে দ্বীপ থেকে জাহাজটার দূরত্ব তখন প্রায় সওয়া মাইল। | হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে নােঙর ফেলার শব্দ দ্বীপবাসীদের কানে এল। মনে হল জলদস্যুরা বুঝি গ্রানাইট হাউসের গায়েই জাহাজ ভিড়িয়েছে। সেখানেই রাতের অন্ধকারে ঘাপটি মেরে রয়েছে।

    হার্ডিং বেগতিক দেখে শত্রুপক্ষের মােকাবেলা করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নিলেন।

    এগিয়ে গিয়ে আয়ারটন কাপ্তেন হার্ডিংয়ের কাছে অনুমতি চাইল, অন্ধকারে সবার নজরের আড়াল থেকে দেখে আসবে জাহাজে কয়জন জলদস্যু রয়েছে। সওয়া মাইল সাঁতারে যাওয়া তার পক্ষে মােটেই সমস্যা নয়। কাপ্তেন হার্ডিং দেখলেন, আয়ারটনের আগ্রহ এমন অত্যুগ্র যে, তাকে বাধা দেওয়ার পরিণাম ভালাে হবে না।

    আয়ারটন কাপ্তেন হার্ডিংয়ের অনুমতি পাওয়ামাত্র পেনক্রফটকে নিয়ে তীরের দিকে যাত্রা করল। আর নেব মার্সি নদীর তীর থেকে ছােট্ট ডিঙিটা নিয়ে এল । সেটা দুজনকে নিয়ে অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে চলল। দ্বীপের অন্যদিকে পেীছে আয়ারটন নৌকো থেকে পানিতে নামূল। আর পেনক্রফট পাহাড়ের পাথরের আড়ালে আত্মগােপন করে রইল।

    আয়ারটন সাধ্যমতাে সতর্কতার সঙ্গে জাহাজটার নােঙরের শেকল বেয়ে ডেকের ওপরে উঠে গেল। দেখল একধারে খালাসিদের পােশাক শুকোতে দিয়েছে। ঝট করে একটা জামা প্যান্ট টেনে নিয়ে গায়ে চাপিয়ে নিল। এবার দুই পা এগিয়ে গিয়ে জলদস্যুদের বাক্যালাপ শােনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে রইল। সে জানতে পারল, জাহাজটার নাম “স্পিডি' আর কাপ্তেনের নাম বব-বব হার্ডি।

    দ্য স্কুল ফর রবিনসন্স Pdf

    প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অবস্থিত ছােট্ট একটা দ্বীপ। ছােট্ট এ-দ্বীপটাকে কেন্দ্র করে যে এমন সােরগােল উঠবে তাই কে জানত। নির্জন-নিরালা দ্বীপটার ধারকাছ দিয়ে কোনাে জাহাজ ভুলেও কোনােদিন যাতায়াত করে না। আসলে এটা মনুষ্য বসবাসের অনুপযােগী । এমন কি উল্লেখযােগ্য কোনাে পশুও এখানকার জঙ্গলে দেখা যায় না। | এমন একটা অনাবশ্যক দ্বীপের মালিকানা স্বত্ব হাতে রেখে লাভই বা কী? যে-দ্বীপ আজ কোনােই উপকারে লাগল , ভবিষ্যতেও লাগবে বলে সম্ভাবনা নেই—সেটা বেঁচে দিলেই তাে ল্যাটা চুকে যায়। বিনিময়ে যে অর্থাগম হবে তা উপরি পাওনা বলেই মনে করা যেতে পারে। তাই মার্কিন সরকার নিতান্ত অপ্রয়ােজনীয় স্পেনসার আইল্যান্ডকে নিলামে বেচে দেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।

    দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে খবরের কাগজের পাতায় স্পেনসার আইল্যান্ড সম্বন্ধে বহু প্রবন্ধ ছাপা হল। তবে এও লেখা হল দ্বীপটা যিনি কিনবেন তিনি কোনােদিক থেকেই লাভবান হবেন না।

    আমেরিকায় ধনকুবেরের সংখ্যা কম নেই । সেরকম কারাের কাছে দ্বীপটাকে বেচে দিয়ে কিছু টাকা কামিয়ে নেওয়ার ধান্ধাতেই সরকার সেটাকে বেচার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

    নির্দিষ্ট দিনে নিলামঘর ক্রেতা ও কৌতূহলী মানুষের ভিড়ে রীতিমতাে গমগম করতে লাগল। উপস্থিত অধিকাংশ মানুষের মুখেই একই প্রশ্ন—মানুষ নেই, এমন কি আগ্নেয়গিরি পর্যন্ত যে দ্বীপে নেই, এমন একটা দ্বীপ কিনতে কোনাে আহাম্মক আগ্রহী হবে। উপস্থিত শ্রোতাদের টিটকিরি মস্করা এমন পর্যায়ে পৌছে গেল যে সেখানে তিষ্ঠোয় কার সাধ্য! নিলামওয়ালা শেষপর্যন্ত হৈ-হট্টগােল থামাতে না পেরে তিতি-বিরক্ত হয়ে নিলাম বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে যাবেন ঠিক তখনই এতগুলাে মানুষের কণ্ঠ চাপিয়ে একজন বাজখাই গলায় দর হেঁকে বসলেন। ব্যাপারটা উপস্থিত সবার মধ্যে কৌতূহলের সঞ্চার করল। অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে, এদিক-ওদিক তাকিয়ে তার খোঁজ করতে গিয়ে দেখল, সানফ্রান্সিসকোর ধনকুবের উইলিয়ম ডব্লিউ কোল্ডরূপ নিরুদ্বেগ মুখে এককোণে বসে রয়েছেন। হ্যা, এঁর পক্ষে এতগুলাে ডলার হাতের ময়লা মনে করে জলে ফেলে দেওয়া সম্ভব বটে। কোটি কোটি ডলারের মালিক ইনি। সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন ব্যবসা ফেঁদে রেখেছেন। এরকম ধনকুবের নিলাম হেঁকেছেন। ব্যস, উপস্থিত সবার মুখ শুকিয়ে গেল। এর ওপরে নিলাম হাঁকার সাধ বা সাধ্যি কোনােটাই কারাের নেই। নিলামওয়ালা নানা কথার মারপ্যাচের মাধ্যমে নিলামের দর চড়াবার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাতে লাগল ।

    , কারাের দিক থেকেই কোনাে সাড়া পাওয়া গেল না। আসলে কোল্ডরূপের ওপরে দর হাঁকার মতাে বুকের পাটা কারাের নেই, বুঝা গেল। কোনাে বুদ্ধিই যখন খাটল না তখন নিলামওয়ালা বাধ্য হয়ে হাতুড়ির আঘাত হানল-এক-দুইতিন বলার জন্য যেইনা মুখ খুলতে যাবে, অমনি ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে একজনকে বগম্ভীর কণ্ঠে কোন্ডরূপের দরকে ছাড়িয়ে দর হাঁকাতে শােনা গেল। আবার কৌতূহলী চোখগুলাে ব্যস্ত হয়ে নতুন কণ্ঠস্বরের মালিককে খুঁজতে লাগল। বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হল না। নতুন কণ্ঠস্বরের কোন্ডরূপের প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম টাসকিনার। কালিফোর্নিয়ার অধিবাসী। মােটাসােটা গােলগাল তার চেহারা।

    কোন্ডরূপ আর টাসকিনারের মধ্যে দীর্ঘদিন দা-কুমড়াে সম্পর্ক। তারা অর্থ, বুদ্ধি আর ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত। কেউ, কারাের নামটা পর্যন্ত শুনতে পারে না। তবে টাসকিনার মনে মনে কোন্ডরূপকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবলেও কোন্ডরূপ কিন্তু তাঁকে পাত্তাই দেন না। আর আজকের নিলাম হাঁকার পিছনেও টাসকিনার-এর উদ্দেশ্য একই-কোন্ডরূপকে একটু জব্দ করা।

    কিন্তু কোল্ডরূপ এত সহজে মাথা নােয়াবার পাত্র নন। তিনি এক লাফে অনেকটা উঠে গেলেন। টাসকিনারও পাল্টা দরহাঁকলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত কোল্ডরূপকে বে-ইজ্জৎ করা তাে দূরের কথা নিজেই ধরাশায়ী হয়ে পড়লেন। মুখ গােমড় করে নিলাম-ঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হলেন।

    শেষপর্যন্ত সবচেয়ে বেশি দর হেঁকে কোল্ডরূপই স্পেনসার দ্বীপের মালিকানা স্বত্ব লাভ করলেন।

    পরাজিত টাসকিনার রাগে গমগম করতে করতে নিলামঘর ছেড়ে যাবার সময় বলে গেলেন, এ অপমানের প্রতিশােধ আমি নেবই নেব!”

    গডফ্রে নামে কোল্ডরূপের এক ভাগ্নে রয়েছে। তার বয়স বছর কুড়ি। আর ফেনা নামে পনের বছরের এক পালিতা কন্যা চোখের মণির মতাে সর্বদা তাঁরা কাছাকাছি পাশাপাশি থাকে। কোল্ডরূপের ইচ্ছা গডফ্রে আর ফেনার বিয়েটা যতশীঘ্র সম্ভব মিটিয়ে দেবেন। তিনি চাইলেই তাে আর বিয়ে হয়ে যাবে না। আসলে গডফ্রে যে সম্পূর্ণ অন্য ধাতের যুক। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করে জোয়াল ঘাড়ে নিতে কিছুতেই সে রাজি নয়। তার একান্ত ইচ্ছা পৃথিবীটাকে ঘুরে ফিরে দেখে তারপর বিয়ের শেকল পায়ে জড়াবেন।

    এক্সপেরিমেন্ট অব ড. অক্স Pdf

    কুইকোয়েনডন নামক ছােট্ট শহরটার খোঁজ করতে গিয়ে যদি ফ্ল্যানডার্সের পুরনাে বা নতুন যে-কোনাে মানচিত্র চোখের সামনে ধরা যায় তবে হতাশ হতেই হবে। তবে? তবে কি এটাই মনে করতে হবে অন্য বহু শহরের মতােই কুইকোয়েনডন শহরটা হাফিস হয়ে গেছে অবশ্যই না। ভূগােলবিশাদরা যাই বলুন না কেন গত আট নশাে বছর ধরে অবস্থান করছে। আর তার তিনশাে নিরানব্বইজন বাসিন্দাও রয়েছে। | বার্গিস থেকে সােয়া কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং আডিনার্দে থেকে প্রায় সাড়ে তেরাে কিলােমিটার উত্তর-পশ্চিমে অর্থাৎ ফ্লানডার্সের প্রায় কেন্দ্রস্থলে শহরটা অবস্থান করছে। শহরটার তিনটে সেতুর নিচ দিয়ে এসকটের শাখানদী কুলকুল রবে বয়ে গেছে। এগারােশাে সাতানব্বই খ্রিস্টাব্দে বসতিটির প্রথম প্রস্তর ফলক স্থাপিত হয়। ফলকটা স্থাপন করেছিলেন। কাউন্ট বডইন। পরবর্তীকালে তিনি কনস্টান্টিনােপলের সম্রাট হয়েছিলেন। এখানে ভূমি থেকে তিন শাে সাতান্ন ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট একটা টাউনহলেরও অস্তিত্ব রয়েছে। প্রাচীরবেষ্টিত সুউচ্চ বুরুজে রয়েছে অতিকায় একটা ঘণ্ট্য, যা বাস্তবিকই বিস্ময় উৎপাদনের ক্ষমতা রাখে। প্রতিটা ঘন্টাধ্বনি এখান থেকে শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

    | কোন বিদেশী কুইকোয়েনডনে এলে টাউনহল না দেখে শহর ছাড়ে না। এখানে বারডনের আঁকা উইলিয়ম আব ন্যার পূর্ণাবয়ব প্রতিকৃতি শোভা পাচ্ছে। আর ষােলশতকের শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য-নিদর্শন ম্যাগলয়ের গির্জার ছবিও এখানে রক্ষিত আছে। আর দেখা যাবে, প্লেসসেন্ট এরনাফের লােহা ঢালাইয়ের কুঁয়াের ছবি। যার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব চিত্রকর-কর্মকার কুয়েনটিন মেটসিসেরই প্রাপ্য। আর দেখা যাবে, চার্লস দ্য বােন্ডের মেয়ে ম্যারি অব বার্গান্ডির প্রাচীন সমাধি-মন্দিরের চিত্র। সম্প্রতিকালে তার কফিন নেতারদামের বার্গিস গির্জায় সংরক্ষণ করা হচ্ছে। টাউন হলে এরকম আরও কত মূল্যবান শিল্পকর্ম যে রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।

    দুগ্ধজাত দ্রব্য আর প্রচুর পরিমাণে যবের চিনি তৈরি কুইকোয়েনডনের প্রধান উৎপাদন শিল্প। বাবার পর শাসন কর্তৃত্ব গ্রহণ করছেন তার ছেলে। তারপর শাসনভার বর্তাচ্ছে তার ছেলের উপর—এভাবে বংশপরম্পরায় শাসনকার্য পরিচালনা করছে। এতকিছু সত্ত্বেও কুইকোয়েনডন শহরের নাম ফ্লানডার্সের মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্যাপার কি? ভূগােলবিশারদরা কি ইচ্ছে করেই কুইকোয়েনডনের নামটাকে বাদ দিয়েছেন, নাকি নামটার কথা ভুলেই গেছেন? আমার পক্ষে এটা বলা সম্ভব নয়। তবে এও ঠিক, ছবির মতাে ছােট্ট শহর কুইকোয়েনডনের অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। সে কথাই এ কাহিনীতে ব্যক্ত করা হচ্ছে।

    এ কাহিনীতে পশ্চিম ফ্লানডার্সের ফ্লেমিংদের ব্যাপারে কোনাে বক্তব্যই স্থান পাবে না। তবে মানুষ হিসাবে তারা ভালাে, স্বীকার করতেই হবে কারণ, তারা যথার্থই জ্ঞানী, অতিথিবৎসল সামাজিক এবং ঠাণ্ডামাথার মানুষ। এমনকি মানসিক নীচতাকে তারা এড়িয়ে চলে। তবুও তাদের দেশেরই এমন একটা সার্বাধিক কৌতূহল সঞ্চারকারী নগরকে কেন যে আধুনিক মানচিত্রে স্থান দেওয়া হয় নি–এর স্বপক্ষে কোনাে যুক্তি মেলে না। এর জন্য আমরা অবশ্যই মর্মাহত। কুইকোয়েনডনের নামের উল্লেখ কি ইতিহাসেও নেই? ঐতিহাসিকরা যদি ভুল করে থাকে, তবে আঞ্চলিক নিবন্ধে? তাও যদি ভুল করে থাকে, তবে দেশসমূহের ঐতিহ্যের তালিকায় মানচিত্র, ইতিহাস আর ঐতিহ্যের তালিকা প্রভৃতি কোথাও ছােট্ট এ শহরটা স্থান পায়নি, এতে দেশের সওদাগরী কাম-কাজের ক্ষতি হবে? কুইকোয়েনডন শহরে কোনাে শিল্প বা রমরমা ব্যবসা নেই যার জন্য চিন্তা ভাবনা করা দরকার। আর নেহাত যদি কিছু থাকে তবে নগরবাসীরা নিজেরাই তৎক্ষণাৎ তার ফয়সালা করে নেয়। দুগ্ধজাত দ্রব্য আর যবের ছাতু যা উৎপাদিত হয় তা নিজেদের প্রয়ােজনেই লাগে, রপ্তানির প্রশ্নই ওঠে না। মােদ্দা কথা, কুইকোয়েনড়নের অধিবাসীরা কারােরই ধার ধারে না। তাদের চাল-চলন সহজসরল আর চাহিদাও সীমিত। এসকর্ট ও উত্তর সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে এরকম মানুষের আজও অস্তিত্ব রয়েছে।

    একদিন কাউনসেলর নিকলসি ও বার্গোমাস্টার ভ্যান ট্রিকসি আলােচনায় লিপ্ত। কথা প্রসঙ্গে বার্গোমাস্টার বললেন, দেখুন মি. ট্রিকসি, হঠাৎ করে এমন কাজ করা মােটেই সঙ্গত হবে বলে আমি অন্তত মনে করি না।'

    | ‘কিন্তু গত দশ দশটা বছর ধরে আমরা ব্যাপারটা নিয়ে আলােচনা করছি । কিন্তু আজ অবধি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হল না। | ‘কোন জায়গাটায় আপনার দ্বিধা তা আমি ভালােই বুঝতে পারছি। আর আমি আপনার দ্বিধার ভাগীদারও হচ্ছি। তবে ব্যাপারটা সম্বন্ধে আরও সতর্কতা অবলম্বন করে হৈ হট্টগােল জুড়ে না দেওয়াই আমাদের পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে।'

    ‘খুবই সত্য যে, কুইকোয়েনডনের মতাে এমন একটা নিরুপদ্রব শান্তিপূর্ণ নগরের নগরপালের পদটা একেবারেই অনাবশ্যক'—কাউনসেলর নিকলসি ভ্যান ট্রিকসির কথার জবাব দিতে গিয়ে বললেন।

    আমাদের পূর্বসূরীরা এমন কথা ঘুণাক্ষরেও বলেন নি যে, কোনে কিছু সম্পূর্ণ নিশ্চিত। বলার সাহসেও কুলােয়নি তাদের। তারা বিশ্বাস করতেন যে, কোনাে নিশ্চিত কাহিনীর দুর্ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে।'

    ব্যস, উভয়েই নির্বাক। কারাের মুখে টু-শব্দটিও নেই। এক সময় নিকলসি বললেন, ‘মি. ট্রিকসি, বলুন তাে কুড়ি বছর আগে আর পূর্বসূরী কতােয়ালের এ অফিসটা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, ঠিক তাে? ব্যাপারটা কিন্তু মােটই সাধারণ নয়। এ অফিসটার জন্য তেরােশাে পঁচাত্তর ফ্রা আর কয়েকটা সেনটাইম এ নগরকে ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে।'

    হ্যা, এরকম চিন্তা করা হয়েছিল বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই এমন বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণমানুষটা পৃথিবী ছেড়ে গেলেন। ফেরল মাত্র এ ব্যাপারটাই নয় শাসন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় তার সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন।

    দ্য গ্রিন ফ্ল্যাশ Pdf

    স্যাম আর সিব অভিন্ন হৃদয় দুই ভাই। তাদের একজন পরিচারিকাকে বেটসি আর অন্যজন বেষ্টি সম্বােধন করে ডাকাডাকি করতে লাগল । তাদের ডাক শুনে তুত্য প্যাজি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল হেলন্সবার হলঘরের দরজায় । বলল, 'স্যার, সে। তাে বাড়িতে নেই । ডেম বেস মিস হেলানার সঙ্গে বেরিয়েছে।'

    | সিব আর স্যামের আসল নাম যথাক্রমে সেবাস্টিয়ান ও স্যামুয়েল। তারা উভয়েই মিস ক্যাম্বেলের মামা। তাদের মধ্যে স্যাম সিবের চেয়ে বয়সে মাত্র পনের বছরের বড়। ভাগ্নী মিস হেলানা স্যাম আর সিবের মনপ্রাণ জুড়ে রয়েছে। তাদের বিধবা দিদি শিশু-কন্যাকে রেখে পরলােকে পাড়ি জমিয়েছিলেন। ব্যস, তারপর থেকেই দুই ভাইয়ের সর্বস্ব হয়ে দাড়িয়েছে মা-বাপহারা শিশু ভাগ্নীটি। আজও সেই স্নেহের বন্ধন এতটুকুও ম্লান হয়নি। এমন কি ভাগ্নীর কোনােরকম অযত্ন হয় ভেবে দুভাই বিয়ে-থা পর্যন্ত করেন নি। ভাগ্নী তাদেরই মা বাবা জ্ঞান করে। সে সিবকে মা আর স্যামকে বাবা সম্বােধন করে।

    সিব আর স্যাম একই কলেজে, একই ক্লাসে পড়াশুনা করেছে। তাদের চাল-চলন আচার-আচরণ আর ভাবনাচিন্তার মধ্যে সামান্যতম ফারাকও নেই। বলা চলে আলাদা অবয়বধারী হলেও আসলে এরা একই ব্যক্তি। কেবলমাত্র দৈহিক গড়নের দিক থেকে তাদের মধ্যে একটু-আধটু বৈসাদৃশ্য লক্ষিত হয়। সাদাসিধে আচরণের মতােই পােশাক পরিচ্ছদের দিকেও তাদের ঔদাসিন্য দেখা যায়। কেবলমাত্র রঙের ব্যাপারে পছন্দের হেরফের হয় বটে। সিব যে-কোনাে জিনিসে তামাটে লাল পছন্দ করে আর স্যামের পছন্দ গাঢ় নীল রঙ। তারা কোনাে নেশারই বশীভূত নয় । সুঠামদেহীও বটে। তাই তার বয়সে প্রবীণ হলেও মন কিন্তু আজও নবীন-কচিকাচাই রয়ে গেছে।

    | সিব আর স্যাম যে নিজেদের মধ্যে আমৃত্যু হৃদ্যতার সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে পারবে এতে তিলমাত্রও সন্দেহের অবকাশ নেই। আর একটা ব্যাপারে এ মানিকজোড়ের দারুণ মিল দেখা যায়উভয়েই মুটো মুঠো নস্যি ব্যবহার করে। তবে আলাদা আলাদা কৌটা থেকে আবশাই নয়, একই কৌটা থেকে তারা নস্যি নেয় । ইয়া পেল্লাই একটা কৌটা নিয়ে তার দিনভর লােফালুফি খেলে। ব্যবসায়িক বুদ্ধির অভাব তাদের। রাজনৈতিক জ্ঞান তাে ছিটেফোঁটাও কারাের নেই।

    ভাগ্নী হেলেনা বাড়ির বাইরে গেছে। পাচটা বাজে। দু-মামারই বিশ্বাস, সে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবে।

    হেলেনা অষ্টাদশী। রূপসী তাে বটেই, এমন কি বুদ্ধি সুদ্ধিও রবরয়ের নায়িকার মতােই প্রখর। ওয়েভারলির নায়িকার মতাে তার চিন্তাধারা একেবারে মৌলিক। সর্বজনবন্দিত সাহিত্যিক দুজনের এবং আরও কয়েকটা বিশিষ্ট চরিত্রের সঙ্গে ভাগ্নীর তুলনা করতে যারপরনাই গর্ববােধ করত লাগল।

    কচি গােলাপের চারার মতাে হেলেনা দ্রুত বেড়েই চলছে। যা এবার তার একটা অবলম্বন দরকার। মনের মতাে একটা বর আর ঘর। কেবলমাত্র পণ্ডিত হলেই তাে হবে না, কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও অধ্যাবসায়ও তাে থাকা চাই। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ফ্যারাডের রসায়নে পাণ্ডিত্য আর টিনড্যালের মতাে পদার্থবিদ্যায় দখল—জিভের ডগায় যাবতীয় প্রশ্নের জবাব থাকে—নামডাক আছে এমন ফাউফশায়ার পরিবারের সন্তান। কিন্তু এমন পণ্ডিত পাত্রকে কি হেলেনার পছন্দ হবে? ব্যাপারটা নিয়ে চিরকুমার ভাই দুজন মােটই ভাবে নি। ভাবী বর হেলেনাকে দু-একবার দেখেছেও। কিন্তু হেলেনার রূপ-সৌন্দর্যতার মনে তেমন দাগ কাটতে পেরেছে বলে মনে হয়নি। দু-ভাই হেলেনার সঙ্গে প্রখ্যাত উপন্যাসের ডায়না ডারনামের সঙ্গে তুলনা করে বসল। কিন্তু তারা ভুলেও কেউ ভাবল না, ডায়না যার সঙ্গে গােড়া থেকে হৃদতার সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছিল শেষপর্যন্ত সে কিন্তু তার গলায় বরমাল্য দেয় নি।

    দুভাই এবার এক প্রখ্যাত কবির কথা ভাবতে লাগল। তাদের ভাবী বর যদি হেলেনাকে পছন্দ করে, হেলেনাও যে তাকে ভালবেসে কাছে টেনে নেবে ওতে দুভাইয়ের কারােরই তিলমাত্র সন্দেহ নেই। এবার তারা শেক্সপিয়ারের কমেডি নাটক থেকে বাছা বাছা কটা উদ্ধৃতির আবতারণার মাধ্যমে মনের ভাব বিনিময় করল।

    | হেলেনার বিয়ের ব্যাপারে সিব আর স্যাম ভাই দুজন নিশ্চিত হতে পারল। এখন প্রশ্ন একটাই বিয়েটা কোথায় হবে? তার গ্লাসগােতে তাে আবশ্যই । কিন্তু সেন্টম্যাগনাস আর সেন্ট মুলগাে চার্চে জায়গা খুবই কম। অন্তত সেন্ট জর্জ চার্চে যেতে পারলে ভালাে হয়। ব্যস, ভােজের আসব কোথায় কীভাবে ব্যবস্থা করা হবে, কোনো পানীয় বিতরণ করা হবে, তাও সঙ্গে সঙ্গে তারা ঠিক করে ফেলল। ভাগ্নী ঘটা করে বিয়ে করতে রাজি না হলে তারা কিছুতেই তার ইচ্ছায় সম্মত হবে না।

    দু-ভাই যখন ভাগ্নী হেলেনার বিয়ের পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত তখনই সমস্বরে তাকে বলল, 'শােন, মি. অ্যারিসটোবিউলিসের সঙ্গে তাে বিয়ে আমরা দেব মনস্থির করে ফেলেছি।'

    তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে হেলেনা বলল আমি যতদিন না সবুজ রশিকে দেখতে পাচ্ছি, ততদিন বিয়ের কথা ভাবতেই

    ক্লইভ নদীর ডানদিকে গয়ার লেক নামে চমৎকার একটা লেক রয়েছে। লেকের লাগােয়া একটা বাড়িতে অভিন্নহৃদয়। দুই মামা বাস করে। গ্লাসগাের একটা পুরানাে বাড়িতে তারা শীতের দু-মাস থাকে। হেলেনার মন চাইলে দুই মামা তাকে নিয়ে ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন প্রভৃতি দেশে চক্কর মেরে বেড়ায়। হেলেনার মেজাজ মর্জি হলে সবাই ফিরে আসে গ্লাসগাের গয়ার লেকের ধারে বাড়িতে। মের তৃতীয় হপ্তায় গ্লাসগাের হৈ-হট্টগােল ছেড়ে নিরিবিলিতে থাকার জন্য ভাগ্নী অস্থির হয়ে পড়ে। ব্যস তল্পিতল্পা গুটিয়ে মামারা তার ইচ্ছা পুরণের জন্য গয়ার লেক থেকে প্রায় এক কিলােমিটার। 

    মাস্টার অব দ্য ওয়ার্ল্ড Pdf

    কতকগুলাে বিস্ময়কর ঘটনার সঙ্গে আমাকে লিপ্ত হতেই হয়েছিল। বিস্ময়কর বলে উল্লেখ করছি এজন্য যে, হয়তাে বিশ শতকে আর এমন অতুলনীয় বিয়ের উদ্ভব ঘটবে না। মাঝে মধ্যে নিজের মনেই প্রশ্নের উদ্ভব ঘটে, সত্যিই কি এমন অত্যাশ্চর্য কোনাে ঘটনা ঘটেছিল? আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে পটে আঁকা ছবির ঘটনাটা গেঁথে রয়েছে। বাল্যের সেই দুরন্ত দিনগুলাে থেকেই অজ্ঞাত রহস্য ভেদ করার জন্য আমি ঔৎসুক্য বােধ করতাম। আর রহস্যাবৃত ঘটনা তখন থেকে চুম্বকের লােহাকে আকর্ষণ করার মতাে আমাকেও দুর্নিবার আকর্ষণে টেনে নিয়ে যেত । আর তা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার মধ্যে উত্তরােত্তর বেড়ে চলেছিল বলেই আজ আমি ওয়াশিংটন ফেডারেল পুলিশ ডিপার্টমেন্টের চিফ ইন্সপেক্টরের পদ লাভ করতে সক্ষম হয়েছি।

    কর্তব্য আর নেশা উভয়ের তাগিদে আমি মাঝে-মধ্যে এমন সব অদ্ভুত-অবিশ্বাস্য ঘটনার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি যা কখন সখন নিজের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার বলে মনে হয়। সরকার আমার মতাে একজন অল্পবয়স্ক কর্মীর ওপর গােপন রহস্য ভেদ করার দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন। আবার বহুরকম জটিল সমস্যার গােপন তদন্তের দায়িত্বভার অর্পণ করেছেন। তাই এ বিস্ময়কর ঘটনার তদন্ত ও সমাধানের দায়িত্ব যে আমার উপরেই বর্তাবে তাতে আর অবাক হবার কিই বা থাকতে পারে। অবিশ্বাস্য অত্যাশ্চর্য ঘটনাটার তদন্ত করতে নেমে যেসব রহস্যাবৃত ঘটনার সঙ্গে আমাকে যুজতে হয়েছে তার আর দ্বিতীয় নজির আছে বলে আমার অন্তত জানা নেই।

    অত্যাশ্চর্য-অবিশ্বাস্য এই ঘটনাটার কেন্দ্রস্থল আমেরিকাস্থ দক্ষিণ ক্যারােলিনার পশ্চিমের এক স্থান! -রিজ পর্বতমালা আর গ্রেট আইরি পর্বতশিখরের মধ্যবর্তী স্থানেই অবস্থিত। পাহাড়টার গম্বুজাকৃতি চেহারাটা ক্যাট বা নদীর পাড়ে অবস্থিত মরগ্যাটন নামে পার্বত্য গ্রাম থেকে স্পষ্ট নজরে আসে। তবে প্লেজ্যান্ট গ্রামের মধ্যবর্তী পথ পাড়ি দেবার সময় পাহাড়টাকে আরও অনেক, অনেক স্পষ্ট দেখা যায়। | গ্রেট আইরির এরকম নামকরণ হয়েছে কেন, ভাববার মতাে ব্যাপারই বটে। নইলে এত নাম থাকতে-আসলে স্থানীয় অধিবাসীদের কোনাে নামই মনে ধরল না। হয়ত সদম্ভে মাথা উঁচিয়ে দাড়িয়ে থাকা পাহাড়টার কথা ভেবেই তাদের এমন মতি হয়েছে। তবে আমার পক্ষে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়।

    গ্রেট আইরির চুড়াটা একেবারেই ন্যাড়া। যা-ই হােক এটা তাে নিছক একটা পাহাড়ই বটে। আর এটা তাে পাথর, নিছকই নিরেট পাথর মাত্র। তবে? এর দিকে চোখ পড়ামাত্রই বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করতে থাকে। এর শীর্ষে আরােহন করার হিম্মত কারােরই নেই। বিশেষ বিশেষ আবহাওয়ায় পাহাড়টা নীল বর্ণ ধারণ করে।

    নানারকম পাহাড়ী পাখির নামানুসারেই হয়তাে বা পাহাড়টার নামকরণ করা হয়েছে। জানা-অজানা কতরকম অতিকায় সব পাখি যে পাহাড়টার গায়ে আশ্রয় নিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু গ্রেট আইরি এখন আর তাদের যেন আকৃষ্ট করতে পারছে না। তারা এখন পাহাড়টার শীর্ষদেশ বার-কয়েক চক্কর মেরে পরম বিতৃষ্ণায় অন্যদিকে চলে যায়।

    | তবে? গ্রেট আইরি নামটার অস্তিত্ব কি তবে অব্যাহত রয়ে গেল। তার চেয়ে বরং এর নাম আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ নামকরণ করলেই সঙ্গত হত। গম্বুজাকৃতি পাহাড়টার গায়ে অতিকায় কোন গহ্বর আছে কিনা তাই বা কে বলতে পারে? তা যদি না হয় তবে কোনাে হদ আছে কিনা তাই বা কে জানে? অ্যাপ্লালাচিয়ান পর্বতমালার খানা খন্দে বৃষ্টি আর বরফগলা জল জমে জমে কিছু সংখ্যক উপহদের অস্তিত্ব লক্ষিত হয় ।

    আসলে গ্রেট আইরি একটা প্রাচীন আগ্নেয় পর্বত কি না, কারাের জানা নেই। দীর্ঘদিন সুপ্ত, অগ্নি উদগীরণ করে নি। তবে কি গ্রেট আইরি তার পাশ্ববর্তী অঞ্চলগুলােতে আগ্নেয় পর্বত ক্রাকাটোয়া বা মপিলির মতাে আবার ভেতরে ভেতরে ভয়ানক প্রলয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে পাথরের ফাটল দিয়ে জল চুইয়ে চুঁইয়ে ভূগর্ভস্থ ফুটন্ত গলিত লাভার সংস্পর্শে গিয়ে বাষ্পীভূত হবে। ব্যস, তা বেরােবার উপযুক্ত পথ না পেয়ে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটাবে। চোখের পলকে গলিত লাভা, বিষাক্ত গ্যাস, পাথরে পাথরে ছেয়ে ফেলবে শান্তি-সুখের ক্যারােলিনা গ্রামটাকে। ঠিক এমনই ভয়ঙ্কর ঘটনা তাে উনিশ শশা দুই-এ মাটিনিকে ঘটেছিল, ঠিক কি না? এরকম সম্ভাবনার ইঙ্গিতই যেন এখন প্রকাশ পাচ্ছে। আর এসবই অগ্নৎপাতের ইঙ্গিতবাহী বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। তাদের একটা হচ্ছে, পাহাড়ে শীর্ষদেশে জমাটবাধা ধোয়া দেখা গেছে। আবার চাষীরা মাঠেঘাটে কাজ করতে যাওয়ার সময় পায়ের তলা থেকে চাপা আওয়াজ উঠতে শুনতে পেয়েছে। আবার এমনও দেখা গেছে গভীর রাত্রে পাহাড়ের ওপরের আকাশ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। বাতাসের কাধে ভর করে জমাটবাধা ধোয়া ভাসতে ভাসতে পূবের প্লেজান্ট গার্ডেনের দিকে দুলকি চালে এগিয়ে গেছে। রাশি রাশি ছাই নেমে এসেছে ভূমিতে। ব্যাপার দেখে গ্রামের বাসিন্দারা চমকে উঠেছে। তারা ভেবেছে পাহাড়টা বুঝি প্রলয়ঙ্কর কাণ্ডের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

    ধারে-কাছের মানুষের আতঙ্ক-মিশ্রিত কৌতুহলের সঞ্চার ঘটেছে। ক্যারােলিনার সব ক'টা খবরের কাগজ ‘গ্রেট আইরির রহস্য' নাম দিয়ে খবর ছেপে বাজার গরম করতেও দেরি করল না। সবারই মােদ্দা কথা, গ্রেট আইরির কাছাকাছি বাসবাস করা কি সঙ্গত হবে? খবরের কাগজের বক্তব্য কারাের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করল, আবার কারাের মধ্যে বা সঞ্চার করল অফুরন্ত কৌতুহল, আসলে তাদের বসতি যে বিপদসীমার বাইরে। তাই তাে তাদের ভীতির বদলে কৌতূহলের সঞ্চারই বেশি হল। প্রলয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটলে ধারে কাছে চাষীভূষিগুলিই আগে খতম হবে। 

    অ্যাডভেঞ্চার্স অফ ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস Pdf

    ১৮৬০-এর ৫ এপ্রিল। সেদিন সকালের লিভারপুল হ্যারল্ড পত্রিকার পাতায় খবরটা প্রকাশিত হল। ব্যস, আর দেরি নয়, পরের দিন ভাের হতে না। হতেই ফরােয়ার্ড নামক জাহাজটা অজ্ঞাত দেশের উদ্দেশ্যে নােঙর তুলল। | প্রতিদিন চার মাইল দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট নিউ প্রিন্স বন্দর থেকে কত জাহাজই তাে ছাড়ে, ভেড়েও কত জাহাজ, কে তার খবর রাখে। কিন্তু ৬ এপ্রিলের ব্যাপারটা একেবারেই স্বতন্ত্র। কাকডাকা সকাল থেকেই কৌতূহলী মানুষ দলে দলে কাতারে কাতারে এসে জমা হতে লাগল, একমাত্র ফরােয়ার্ড' নামের জাহাজটির সমুদ্রযাত্রার দৃশ্য স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার অত্যুগ্র বাসনা নিয়ে।
    সত্যই অত্যাশ্চর্য অবিশ্বাস্য গঠন নৈপুণ্যের অধিকারী অত্যাধুনিক জাহাজ এই ফরােয়ার্ড। এটা ইঞ্জিনের সাহায্যে তাে চলেই, পালের দ্বারাও অনায়াসে পথ পাড়ি দিতে পারে। অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা জাহাজটার বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলাে দেখে নিজেদের মধ্যে জল্পনা কল্পনায় লিপ্ত হয়েছে, এটা নির্ঘাত উত্তর মেরুর দিকে চলেছে। বিশেষ করে পালটার আকার তাদের এরকম ধারণা করতে উৎসাহিত করছে। আর জাহাজে বােঝাই করা হয়েছে, পাঁচ-ছয় বছর চলার মতাে খাদ্যসামগ্রী, সিলমাছের চামড়ার পােশাক আশাক আর, বস্তা বস্তা উল আর ওষুধপত্র দিয়ে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, জাহাজের নাবিক ও লঙ্কররা জানে না জাহাজটাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে। কাড়ি কাড়ি টাকা বেতন পাওয়ায় সবাই মুখে কুলুপ এঁটে মহানন্দে নিজ নিজ কর্তব্য পালন করে চলেছে।
    ফরােয়ার্ড জাহাজের ক্যাপ্টেনের পদে নিযুক্ত যিনি হয়েছেন তিনি নিপাত্তা । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শ্যানডন নামে লােকটা ক্যাপ্টেন হবার সবদিক থেকে যােগ্য । আর তাকেই কি না করা হয়েছে জাহাজের মেট। এর চেয়ে হাস্যকর ও অবিশ্বাস্য ব্যাপার আর কী-ই বা হতে পারে? ক্যাপ্টেনকে মুহূর্তের জন্যও কেউ চোখে দেখে নি। গন্তব্যস্থল কোনদিকে, কোথায়, কিছুই জানা নেই। সবচেয়ে বেশি কৌতূহল সঞ্চার করেছে কুকুরটার খবর প্রচার হওয়ার পর থেকে। | একটা কুকুর নাকি ফরােয়ার্ড জাহাজের ক্যাপ্টেনের পদে বহাল হয়েছে। এমন একটা অবিশ্বাস্য কথা প্রচার হলে শহরবাসীদের মনে কৌতূহলের সঞ্চার তাে হবেই। জাহাজের মালিক ও সৃষ্টিকর্তা রিচার্ড শ্যানড়ন। দুহাতে টাকা খরচ করে নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিশালায়তন জাহাজটাকে গড়ে তুলেছেন। নিউ ক্যাসলের এক কারখানা ১২০ হর্সপাওয়ার-বিশিষ্ট ইঞ্জিন তৈরি করে দিয়েছেন। ডেকের ওপর ষােল পাউন্ড কামান রাখা হয়েছে। কামান আর বন্দুকের সংখ্যা বেশি না রাখলে কী হবে বস্তা বস্তা বারুদ কিন্তু তােলা হয়েছে। এসব ছাড়া আর যা কিছু নেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে সিগন্যাস-ল্যাম্প, সহস্রাধিক রকেট, বিচিত্রদর্শন সব যন্ত্রপাতি আর বিশালায়তন কয়েকটা করাত।।
    | রিচার্ড শ্যানডনের হাতে আটমাস আগে আবারডন থেকে ১৮৫৯-এর ২ আগস্ট তারিখে লেখা অদ্ভুত একটা চিঠি এসেছিল। চিঠিটার লেখক ফরােয়ার্ড জাহাজের ক্যাপ্টেন কে, জেড । তিনি লিভারপুলে বসে ওই চিঠিটা হাতে পান। চিঠিটার লেখক জানিয়েছেন, ম্যাকুয়ার্ট কোম্পানির ব্যাঙ্কে ষােল হাজার পাউন্ড মজুত রেখেছেন। নিজের স্বাক্ষরযুক্ত বেশ কিছুসংখ্যক চেকও চিঠিটার সঙ্গেই তিনি পাঠিয়েছেন। তিনি যেন ব্যাঙ্ক থেকে ইচ্ছামত প্রয়ােজনীয় অর্থ তুলে নেন। আর এও লিখেছেন, রিচার্ড শ্যানডন চিঠির লেখক কে, জেডকে চেনেন না বটে, তবে তিনি তাকে চেনেন। ব্যস, এর বেশি কিছু দরকার নেই। তাকে ৫০০ পাউন্ড বেতনের বিনিময়ে ফরোয়ার্ড জাহাজের প্রধান কার্যনির্বাহকের পদ গ্রহণের জন্য অনুরােধ করা হয়েছে। আর বছর বছর পঞ্চাশ পাউন্ড করে বেতন বৃদ্ধি করা হবে। তবে এও লিখতে বাদ দেন নি যে, অভিযানটা দীর্ঘদিনের আর বিপদ ও ঝুঁকিবহুলও বটে। চিঠির সঙ্গে জাহাজের নকশাটাও পাঠিয়ে দিয়েছেন। কারণ জাহাজটা তৈরির কাজ এখনও আরম্ভবই করা হয় নি । নকশা অনুযায়ী মজবুত একটা জাহাজ যেন তিনি তৈরি করে নেন। জাহাজ তৈরির কাজ মিটে গেলে পছন্দমাফিক পনের জন কর্মচারী যেন বহাল করেন। চিঠির লেখক এবং রিচার্ড শ্যানডনকে নিয়ে তা দাঁড়াবে সতের জনে।
    ডা, ক্লববানি নামে আর একজন সময়মতাে হাজির হবেন। তবে একটা শর্ত, নাবিকরা সবাই যেন অবশ্যই ইংরেজ হয় । আর সবাইকে অবিবাহিত এবং সন্তানসন্ততিহীন হতেই হবে। সবার দৈহিক গঠন সুদৃঢ় এবং মাসক্তহীন হতে হবে। পাঁচ গুণ বেতন তাদের জন্য বরাদ্দ করা হবে। প্রতিবছর শতকরা দশভাগ করে বেতন বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা থাকবে। অভিযানের পাট মিটে গেলে প্রত্যেক কর্মীকে অতিরিক্ত ৫০০ পাউন্ড দেয়া হবে। আর তাকে অর্থাৎ রিচার্ড শ্যানড়নকে দেওয়া হবে অতিরিক্ত ২০০০ পাউন্ড। চিঠিটার শেষের দিকে লিখেছেন, রিচার্ড শ্যানডন যদি উপরােক্ত প্রস্তাব মেনে কাজ করতে সম্মত থাকেন তবে যেন কে, জেউকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেন। ঠিকানা দেয়া আছে—পােস্ট রেস্তানডে, গােটবর্গ, সুইডেন। | তিনি আবার লিখেছেন, ১৫ ফেব্রুয়ারি অতিকায় একটা ড্যানিশ কুকুরকে রিচার্ড শ্যানডনের কাছে পাঠিয়ে দেবেন। তার দেখভালের দায়িত্ব তার ওপরই বর্তাবে। কুকুরটার প্রাপ্তিসংবাদ ইতালির পােস্টমাস্টারকে যেন চিঠির মারফত জানিয়ে দেন। প্রয়ােজন হলেই ফরােয়ার্ড জাহাজের ক্যাপ্টেন হাজির হবেন। নইলে তাকে ছাড়াই লিখিত নির্দেশ মেনে রিচার্ড শ্যানডনকেই ফরােয়ার্ড জাহাজকে চালাতে হবে। চিঠির বক্তব্য এ পর্যন্তই।
    রিচার্ড শ্যানন রহস্য সঞ্চারকারী চিঠিটা হাতেপাওয়ার পর অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে একাধিকবার সেটাকে পড়লেন। কিন্তু কিছুতেই রহস্যভেদ করা তাঁর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হল না। ব্যাপারটা তার কাছে কুয়াশাচ্ছন্নই রয়ে গেল। 
    1. The Secret of the Iland Jules Verne pdf in Bengali
    2. The Light House Jules Verne pdf in Bengali
    3. Around The World in 80 Days Jules Verne Pdf in Bengali
    4. Black Diamonds Jules Verne PDF in Bengali



    জুল ভার্ন সমগ্র pdf পড়ুন এখানে।


    Tags

    Post a Comment

    0Comments
    * Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
    Post a Comment (0)

    #buttons=(Accept !) #days=(20)

    Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
    Accept !