পাওলো কোয়েলহো, বাংলা অনুবাদ সাহিত্য জগৎে চিরপরিচিত এক কিংবদন্তীর নাম। তাঁর দ্য এ্যালকেমিস্ট বইটি ১৯৮৮ সালে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। মোট ৮০ টি বিদেশি ভাষায় অনুবাদ হওয়ার পর বাংলা ভাষায় পিডিএফ অনুবাদ করেন মাকসুদুজ্জামান খান।
দ্য এ্যালকেমিস্ট pdf বইয়ের সবচেয়ে রহস্যময় চরিত্রের নাম সান্তিয়াগো। পাওলো কোয়েলহো এই চরিত্রটিকে দি অ্যালকেমিস্ট বলে অভিহিত করেছেন। অনুবাদক মাকসুদুজ্জামানের হাতধরে বইটির প্রাঞ্জল অনুবাদ করেছে রোদেলা প্রকাশনী।
সান্তিয়াগো নামের এক মেষপালক যুবককে নিয়ে লেখা পাওলো কোয়েলহো এর জনপ্রিয় একটি রূপকধর্মী উপন্যাসের নাম দ্য এ্যালকেমিস্ট। ২০১৪ সাল পর্যন্ত বইটি মোট ৮০ টি বিদেশি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। বইটি আমাদের এমন এক ভ্রমণ যাত্রায় নিয়ে যায়, যেখানে রয়েছে সান্তিয়াগো নামের এক ভেড়ার রাখাল, তার প্রেম ও গুপ্তধন খোঁজার জন্য মিশর অভিমুখী অভিযান। দ্য এ্যালকেমিস্ট তাই একাধারে রহস্যময়, দুঃসাহসিক অভিযান, অন্যদিকে রোমান্টিক, অনুপ্রেরণা ও আত্মউন্নয়নমূলক ফিকশন উপন্যাস বই।
আপনি যদি পাওলো কোয়েলহো এর বইয়ের এখনো পাঠক না হন, তবে আপনি বিশ্বসাহিত্যের অনেককিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। দ্য এ্যালকেমিস্ট শুধু একটি বই নয়, এটি আপনার অনিশ্চিত জীবনে আত্মউন্নয়নমূলক প্রেরণা সৃষ্টিকারী রোমান্টিক গল্পের রহস্য অভিযান। যে বই পাঠ করে হাজারো পাঠক লেখক পাওলো কোয়েলহোর একনিষ্ঠ ভক্ত হয়েছেন।
বাংলাদেশের ছোট বড় অধিকাংশ বইয়ের দোকান এবং লাইব্রেরিতে 'দ্য এ্যালকেমিস্ট' বাংলা অনুবাদ বইটির হার্ডকপি পাওয়া যাবে। বইটি ঘরে বসেও পেতে পারেন। সেজন্য আপনাকে রকমারি, বই বাজার, দুর্দিন ম্যাগাজিন বুকশপ, দারাজ থেকে সুলভমূল্যে অনলাইনে অর্ডার করতে পারবেন।
পাওলা কোয়েলহো রচিত এই বইটির সফটকপি পিডিএফ আকারে অধিকাংশ পিডিএফ ওয়েবসাইটেগুলোতে পাওয়া যাবে। পাওলা কোয়েলহোর লেখা সবগুলো বই সবচেয়ে সহজ উপায়ে পিডিএফ পড়তে ভিজিট করতে পারেন 'বই নিবো পিডিএফ রিভিউজ' ওয়েবসাইটে।
দ্য অ্যালকেমিস্ট নামে আরেকটি বই ভাষান্তর করেছেন অনুপ সাহা। প্রকাশক ঐশী পাবলিকেশন্স।
দ্যা আলকেমিস্ট নামে ভিন্ন ভিন্ন বই ভাষান্তর করেছেন সাঈদা বানু, তামান্না হাফিজ, নাজমুল হাসান, আসিফ এবং আরো কিছু অনুবাদক।
সান্তিয়াগোর পরিচয়
ছেলের নাম সান্তিয়াগাে। শূণ্য গির্জার বুকে উঠে এল সে ভেড়ার পাল নিয়ে, আকাশ বেয়ে উঠে এল অন্ধকার। কত আগে ভেঙে পড়েছে ছাদ। বিশালবপু এক গাছ উঠেছে আজ সেখানে, যেখানে ছিল ধার্মিকদের আনাগোনা।
রাতটা কাটাবে এখানেই। সব ভেড়া ঢুকছে ভাঙা দরজা দিয়ে। ভাঙা ডালপালা জোগাড় করে সে, যেন পালটা এদিক সেদিক বেরিয়ে যেতে না পারে। এ তল্লাটে নেকড়ের নাম নিশানাও নেই। না থাকলে কী হবে, একবার কী এক নাম না জানা পশু হানা দিল। তারপর বেচারাকে পরদিন সারাটা সময় খরচ করতে হল সেটার খােজে। * পরনের ভারি জামাটা দিয়ে মেঝে ঝেড়ে নেয় সে। শুয়ে পড়ে সটান। এইমাত্র পড়ে শেষ করা বইটাই এখন বালিশের কাজ দিবে। নিজেকে শােনায়, এবার ভারি ভারি বই পড়া শুরু করতে হবে। পড়তে বেশি সময় লাগে, শুতে লাগে আরাম।
জেগে উঠে দেখে এখনাে আঁধার কাটেনি। উপরে তাকালে দেখা যায় আধভাঙা ছাদ। আর দেখা যায় তারার দল। আরাে একটু ঘুমিয়ে নিতে চেয়েছিলাম আমি, ভাবে সে। সপ্তাখানেক আগে দেখা সেই স্বপ্নটা আবার এসেছে। আবারাে ফুরিয়ে যাবার আগেই ঘুম হাপিস।
এখনাে ঘুমিয়ে থাকা ভেড়াগুলােকে এবার জাগানাের পালা। হাতে তুলে নেয় লাঠি। যেন কোন অজানা শক্তি তাকে চালায়, চালায় ভেড়ার পালকেও, চালাচ্ছে বছর দুয়েক ধরে, চালাচ্ছে ঘাসের সন্ধানে, পানির খােজে।
এরা আমার সাথে এত অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে সময়ের ব্যাপারগুলােও ঠিক ঠিক বােঝে।' বিড়বিড় করে সে। একটু ভাবে। ব্যাপারটা ভিন্ন হতে পারে, হয়ত সেই তাদের সাথে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে আস্তে আস্তে। কিন্তু কোন কোনটা কুঁড়ের বাদশা। উঠতেই চায় না। পুঁতিয়ে চলে ছেলেটা। আলতাে করে। একে একে জাগিয়ে তােলে সবগুলােকে। নাম ধরে ডাকে প্রত্যেককে। তার নিত্যদিনের বিশ্বাস, ওরা তার কথা বুঝতে পারে। তাই মাঝে মাঝে যখন বই থেকে কিছুটা পড়ে শােনায় ওগুলােকে, সাড়াও যেন পায়। কখনাে কখনাে আপনমনে বকে যায়, শােনায় রাখাল ছেলের একাকীত্বের কথা, শােনায় তাদের আনন্দের কথা। মাঝে মাঝে পেরিয়ে যাওয়া গ্রামগুলােয় কী দেখল সেসবও শােনায়।
The Alchemist by Paulo Coelho pdf
বণিকের মেয়ে ফাতিমা
কিন্তু গত কদিন ধরে তার কথা শুধু একটা ব্যাপার নিয়ে মেয়েটার ব্যাপার। বণিকের মেয়ে। চারদিন পর সেখানে পৌছানাের কথা। গ্রামটায় গিয়েছিল মাত্র একবার। গেল বছরে। শুকনা পণ্যের বেসাতি করে বণিক লােকটা। তার দাবি, ভেড়াগুলােকে তার সামনেই মুড়িয়ে দিতে হবে, নাহলে ঠকল কিনা বােঝা যাবে না। কোন এক বন্ধুর কাছে দোকানের কথা শুনেছিল ছেলেটা, তারপর সেখানেই ভেড়ার পাল নিয়ে যাবার পালা।
মুরিশ চোখের তারা বড় হয়, বড় বড় হয়ে যায় চোখদুটা ভয় আর বিস্ময়ে । বয়ে চলে সময়। ধীরে ধীরে ছেলেটা কেন যেন আশা করতে থাকে, দিনটা যেন না ফুরায়। যেন বাবা ব্যস্তসমস্ত হয়ে থাকে অহর্নিশি। যেন তিন দিনেও না ডাকে। এমন কোন অনুভূতি হচ্ছে যা আগে কখনাে হয়নি: এক জায়গায় সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়ার ইচ্ছা। দিনগুলাে আর আগের মত কাটবে না।
কিন্তু অবশেষে হাজির হয় দোকানি। চারটা ভেড়া মুড়িয়ে দিতে হবে। টাকাটা দিয়ে জানিয়ে দেয়, আসতে হবে আগামি বছর।
“কিছু উল বিক্রি করা দরকার।' বণিককে বলে ছেলেটা। দোকানের বিকিকিনি চলছে দেদার। তাকে অপেক্ষা করতে হবে বিকাল পর্যন্ত। কী আর করা, সে বসে পড়ে দোকানের সিড়ির এক ধাপে। ঝােলা থেকে বের করে একটা বই।
‘রাখাল ছেলেরাও যে বই পড়তে পারে তাতাে জানতাম না।' পিছন থেকে বলে উঠল মেয়েটা।
আন্দালুসিয়ার সাধারণ বেশভূষার এক মেয়ে। ঢেউ খেলানাে চুল আছে। তার। চোখদুটা দেখলে ঠিক ঠিক মুরিশ শাসকদের কথা মনে পড়ে যাবে। | ‘আসলে আমি বই থেকে যতটা শিখি তারচে বেশি শিখি ভেড়াগুলাের কাছ থেকে।'
দু ঘন্টা ধরে কথা বলল তারা। মেয়েটা জানায়, বণিক তার বাবা। জানায় গ্রামের জীবনের কথা, যেখানে হররােজ একই ভাবে কাটে ।
রাখাল শােনায় আন্দালুসিয়ার দূরপ্রান্তের সব কথা। যেসব শহরে থেমেছে সেখানকার কথা। ভেড়াদের সাথে কথা বলারচে অন্যরকম লাগে তার কাছে।
‘পড়তে শিখলে কী করে? ‘আর সবার মত,' চটপট জবাব দেয় ছেলেটা, 'স্কুলে। “আচ্ছা। পড়তে জানলে তুমি রাখাল ছেলে কেন?"
পাশ কাটিয়ে যাওয়া একটা জবাব ছুড়ে দেয় সে। জানে, মেয়েটা এসব বুঝবে না। তারপর শােনায় বসত থেকে বসতিতে যাবার গল্প; মেয়ের উজ্জ্বল
আর এখন সেখানে যেতে মাত্র চারদিন বাকি। তার অস্থির লাগছে, একটু একটু লজ্জাও হয়। কে জানে, মেয়েটা হয়ত এতদিনে ভুলেই গেছে। কত রাখালই যায় আসে, কতজন বিক্রি করে পশম তার ঠিক নেই।
এতে কিছু এসে যায় না, ভেড়াদের শােনায় সে, “আমি অন্য সব গ্রামে অন্য মেয়েদের চিনি।'
কিন্তু হৃদয়ের গভীর থেকে জানে, কিছু না কিছু এসে যায়। জানে, নাবিক আর ভবঘুরে বিকিকিনি করা লােকজনের মত রাখালরাও কোন না কোন জায়গায় এমন কারাে কথা মনে রাখে যে তাদের থিতু হতে বলে। মুখে না বলুক, মনকে দিয়ে বলায়।
দিনের শুরুতে রাখাল ছেলে সূর্যের দিকে চালিয়ে দেয় পালটাকে। তাদের কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে না, হয়ত এজন্যই আমার কাছে থাকতে ভালবাসে।
ভেড়াগুলাের একটাই চিন্তা। খাবার আর পানি। যতদিন ছেলেটা আন্দালুসিয়ার খাবারের উৎস চিনবে, ততদিন তারা চলবে তার সাথে । অবশ্যই, তাদের দিনরাত সবই একঘেয়ে। কাটে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তারা পড়তে জানে না। জানে না কী করে রাখালের কথা শুনতে হয়। তারা। শুধু খাবার চেনে। বিনিময়ে দেয় পশম। মাঝে মাঝে মাংস।
আমি যদি আজ একটা বিকট দানব হয়ে একে একে তাদের মেরে ফেলতে থাকি, তাহলে বিচ্ছিন্ন হতে দেরি করবে না। বিশ্বাস করে আমাকে, তাই নিজের কল্পনা আর সাবধানতার উপর ভরসা করতে ভুলেই গেছে। কারণ পুষ্টির পথ দেখাই আমি।
ভাবনা থেকে অবাক হয়ে যায় ছেলেটা। হয়ত গির্জা, গির্জার ভিতরের দৈত্যাকার গাছটা ভূতুড়ে। এটাইতাে তাকে এক স্বপ্ন দুবার দেখিয়েছে, রাগিয়ে তুলেছে তার পােষা জীবগুলাের বিরুদ্ধে। কাল রাতের খাবার থেকে বেঁচে যাওয়া একটু মদ চেখে নেয় সে। শরীরের সাথে জ্যাকেটটা আটসাট থেকে ঢিল করে। তারপর খুলে ফেলে। আর একটু পর সূর্যটা যখন মাথার উপরে চলে আসবে তখন কড়া তাপে মাঠের ভিতর দিয়ে ভেড়া চালানাে রীতিমত মুশকিল হয়ে যাবে।
দ্য এ্যালকেমিস্ট by পাওলো কোয়েলহো
স্পেনে কাটানো ভোর
আজ এমন এক ভোর যখন পুরাে স্পেন ঘুমে কাতর। গ্রীষ্মের ভােরতাে, তাই। রাত নামা পর্যন্ত ভারি জামাটা বয়ে নিতে হল তাকে। ভারটা নিয়ে বিরক্ত হতে গিয়ে মনে পড়ে গেল, এটাই ভােরের শীত থেকে রক্ষা করে।
আমাদের বদলের জন্য প্রস্তুত হতে হবে, ভাবে সে, ভাবে, থাক ভারি জামার ওজন। মন্দ নয়।
ভারি জামার একটা উদ্দেশ্য আছে, যেমন আছে ছেলেটার । তার জীবনের লক্ষ্য পরিভ্রমণ, আর আন্দালুসিয়ায় দুটা বছর হেঁটে হেঁটে এলাকার সব শহর চলে এসেছে নখদর্পণে। এবার সে মেয়েটার কাছে ব্যাখ্যা করবে কী করে এক রাখাল ছেলে পড়তে জানে। বলবে, ষােল বছর পর্যন্ত পাঠশালায় ছিল। বাবা মা চেয়েছিল সে হবে যাজক, আর সাধারণ সে পরিবারে আসবে সম্মান। তারা শুধু খাবার পানির জন্য অনেক কষ্ট করত, ঠিক এ ভেড়াগুলাের মত। সে লাতিন পড়েছে, পড়েছে স্প্যানিশ, আর ধর্মতত্ত্ব। কিন্তু একেবারে ছেলেবেলাতেই তার ইচ্ছা ছিল পৃথিবীকে জানার, মনে হয়েছে ঈশ্বর আর পাপ সম্পর্কে জানারচে এসব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তারপর, এক বিকালে সে সাহস করে বাবাকে বলেই ফেলল, যাজক হতে চায় না। 'চায় ঘুরে ঘুরে পৃথিবীটাকে দেখতে।
‘ভাল! তাহলে আমি রাখাল ছেলে হব!' বাবা আর কোন কথা বলে না। পরদিন ছেলের হাতে ধরিয়ে দেয়। স্প্যানিশ সােনার তিনটা মােহর।।
একদিন মাঠে পেয়েছিলাম এগুলাে। চেয়েছিলাম তােমার কাজে লাগুক কোনদিন। এম্নি খরচ করে ফেলােনা। পশুর পাল কিনে নিও। মাঠ থেকে মাঠে ঘুরে বেড়াও। তারপর একদিন ঠিক ঠিক উপলব্ধি করবে যে তােমার দেশটাই সেরা। তােমার দেশের মেয়েরাই সবচে সুন্দর।'
তারপর বাবার আশীর্বাদ পড়ে ছেলের উপর। ছেলে দেখতে পায় বাবার চোখজোড়া। অবাক হয়ে দেখে, সেখানেও পৃথিবী ঘােরার উদ্দাম নেশা ঝিলিক খেলে যাচ্ছে। এখনাে সে কামনা মুছে যায়নি। যুগ যুগ ধরে প্রােথিত বুকের ভিতর। স্বপ্ন বুকে নিয়ে বাবা দিনের পর দিন পান করার পানি খুজে বেড়ায়, যুঝে চলে একমুঠো খাবার জন্য, ঘুমায় বা নিঘুম রাত কাটায় একই জায়গায়।
'পৃথিবীর এখান সেখান থেকে কত মানুষ যে এ গ্রাম দিয়ে গেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই, ছেলে। বলেছিল বাবা। তারা নতুনের খােজে আসে এখানে, কিন্তু ছেড়ে যাবার সময় তারা যে মানুষ হয়ে এসেছিল তা হয়েই চলে যায় । দুর্গ দেখার আশায় ওঠে পাহাড়চূড়ায়, তার পরও, মনে করে অতীত বর্তমানেরচে ভাল। কারাে লালচুল, কারাে চামড়া কালাে, কিন্তু সবাই আসলে এখানে থাকা মানুষের মতই। খুব বেশি হেরফের নেই।'
“কিন্তু যেসব শহরে তারা থাকে সেখানকার দুর্গগুলাে দেখার ইচ্ছা ছিল আমার।'
আর তারা যখন আমাদের এখানে আসে, বলে সারাটা জীবন এখানে কাটিয়ে যেতে পারলে মন্দ হত না। আমাদের মধ্যে যারা ভ্রমণ করে তারা রাখাল।
দিগন্তরেখা লালচে হতে হতে এক সময় সূর্যকে নিয়ে এল। বাবার কথা মনে পড়ে যায় ছেলেটার, কেন যেন নিজেকে সুখি সুখি মনে হয়; অনেক দুর্গ দেখেছে সে, দেখেছে অনেক নারীর রূপ (কিন্তু কেউ আর কদিন পর যার সাথে দেখা হবে তার সাথে তুলনীয় নয়)। একটা ভারি জামা আছে তার, আছে বেচে দিয়ে বা বদলে নিয়ে নতুন একটা কেনার মত বই, আর আছে। একদল ভেড়া। আর আছে হররােজ স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকার সাহস। আন্দালুসিয়ান মাঠে মাঠে এক সময় ক্লান্ত হয়ে যেতেই পারে সে, তখন প্রিয় ভেড়াগুলােকে বিক্রি করে দিয়ে পাল তুলে দিবে সাগরের বুকে। উত্তাল সমুদ্রের বুকে ভাসতে ভাসতে হরেক রকমের নগর দেখা হয়ে যাবে, দেখা পাবে অতুল রূপের সব রমণীর, দেখা পাবে বিচিত্র সব সুখের।
ধর্মশালায় আমি ঈশ্বরের দেখা পাব না, হয়ত পেতাম না কোনদিন, ভাবে সে উঠতে থাকা টকটকে লাল সূর্যের দিকে তাকিয়ে।
যখনি সম্ভব নতুন পথ ধরে সে, আগে কখনাে ভাঙা গির্জায় যায়নি, যেমন যায়নি একই জায়গায় বারবার। পৃথিবী বিশাল, এখানে ক্লান্তির কোন স্থান নেই, তাকে শুধু ভেড়ার পাল চড়িয়ে যেতে হবে, তারপর তাকিয়ে দেখতে হবে অনির্বচনীয় সব দৃশ্য। সমস্যা হল, ভেড়াগুলাে বুঝতেও পারে না তারা যে প্রতিদিন এক একটা নতুন পথে যাচ্ছে। দেখে না ঋতু বদলের খেলা। তাদের চিন্তা শুধু খাবার আর পানীয়, পানীয় আর খাবার।
বণিকের মেয়ের দেখা
হয়ত আমরা কাছাকাছি চলে এসেছি। মৃদু হাসির রেখা ছেলেটার ঠোটের কোণায়। বণিকের মেয়ের দেখা পাবার পর আর কারাে কথা ভাবেনি সে। দুপুরের আগে তারিফায় পৌছে যাবে, সূর্যের দিকে তাকিয়ে বুঝে নেয় । সেখানে বইটা বদলে ভারি আরেকটা নিয়ে নেয়া যাবে। ভরে নেয়া যাবে মদের বােতলটা, দাড়ি কামিয়ে ছেটে নেয়া যাবে চুল। মেয়ের সাথে দেখা হবার আগে একটু সুন্দর হয়ে নিতে হবে তাে। ভাবতেও পারে না যে আরাে বড় কোন পাল নিয়ে অন্য কোন রাখাল এসে এর মধ্যেই মেয়েটার হাত ধরে বসেছে।
একটা স্বপ্নকে সত্যি করে দেখা, জীবনটাকে আরাে একটু সাজিয়ে নেয়া, সূর্যের দিকে তাকিয়ে গতি আর একটু বাড়ানাে, এসবই এখন মনের ভিতরে হানা দেয়। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল । তারিফায় এক বয়েসি মহিলা আছে। সে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে জানে।
“বিচিত্র ব্যাপার,' ছেলের হাত থেকে চোখদুটা এক পলকের জন্য না সরিয়ে বলে মহিলা। তারপর একেবারে চুপ বনে যায়।
আস্তে আস্তে অস্থির হয়ে উঠছে ছেলেটা। মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। মৃদু কাপছে হাতদুটা। টের পায় মহিলা। সাথে সাথে হাত সরিয়ে নেয় সান্তিয়াগাে।
“আমি এখানে আমার হাত দেখাতে আসিনি তাে!' এর মধ্যেই তার আসার জন্য আফসােস হচ্ছে। কেন খামােখা বিপদ ডেকে আনা বাবা! এখন ভালয় ভালয় পাওনা টাকাকড়ি বুঝিয়ে দিয়ে কেটে পড়তে পারলেই বাঁচে।
স্বপ্নকে এত গুরুত্ব দিচ্ছে কেন?
‘তুমি এসেছ, এসেছ স্বপ্ন বিষয়ে জানতে। আর স্বপ্ন কী তা জান নাকি? স্বপ্ন হল ঈশ্বরের ভাষা। যখন তিনি আমাদের ভাষায় কথা বলেন, তখন আমি সেটা অনুবাদ করে দিতে পারি। কিন্তু যখন কথাটা হয় আত্মার ভাষায়, তখন শুধু তুমিই ধরতে পারবে প্রকৃত অর্থ। যাই হােক, আমি উপদেশের জন্য তােমার কাছ থেকে কিছু নিব।'
আবার ছলচাতুরি, ভাবে ছেলেটা। কিন্তু একটা সুযােগ নেয়া যেতে পারে। রাখাল ছেলে সব সময় নেকড়ের ঝুকি নেয়, ঝুকি নেয় খরার, আর এসব করলেই জীবনটা হয়ে ওঠে দারুণ।
আমি একই স্বপ্ন দুবার দেখেছি। ভেড়াগুলােকে নিয়ে একটা মাঠে ছিলাম, এমন সময় এক ছেলে কোখেকে যেন এসে সেগুলাের সাথে খেলা শুরু করে । এমনধারা মানুষ আমার মােটেও ভাল্লাগেনা। কারণ আছে, ভেড়াগুলাে নতুন কাউকে দেখলে ভড়কে যায় । কিন্তু শিশুরা কী করে যেন তাদের ভয় না পাইয়ে সুন্দর খেলে যায়। কে জানে কীভাবে করে কাজটা। মানুষের বয়সটা কেমন করে পশুরা আন্দাজ করে তাও জানি না।'
স্বপ্নটার ব্যাপারে আরাে কিছু বল দেখি। চটজলদি রান্নাবাড়ার কাজে যেতে হবে। বােঝাই যায়, তােমার কাছে খুব বেশি পয়সা নেই, যখন খুব বেশি পয়সা নেই, তখন আমার হাতে খুব বেশি সময়ও নেই।'
বাচ্চাটা আমার ভেড়াগুলাের সাথে বেশ কিছুক্ষণ খেলল।' সামান্য হতাশ হয়ে বলতে থাকে ছেলেটা, তারপর হঠাৎ সে আমাকে জড়িয়ে ধরে। ধা করে নিয়ে যায় মিশরের পিরামিডে।'
দি আলকেমিস্ট pdf free
রাখালের স্বপ্নের ব্যাখ্যা
ইচ্ছা করেই থামে সান্তিয়াগাে। বােঝার চেষ্টা করে মহিলা মিশরিয় পিরামিডের ব্যাপারে কিছু জানে কিনা। কিন্তু কোন জবাব নেই মহিলার মুখে।
তারপর, মিশরিয় পিরামিডে,'- ধীরলয়ে বলে চলে সে, যেন প্রতিটা বর্ণ ঠিক ঠিক ধরতে পারে মহিলা নিয়ে গিয়ে মেয়েটা বলে, এখানে এলে পাবে এক লুকানাে জিনিস। গুপ্তধন। তারপর যখনি সে ঠিক জায়গাটা দেখাতে চায় তখনি ঘুম ভেঙে যায়। দু বারই একভাবে জেগে গেছি আমি।'
তাকে বাসার পিছনে একটা কামরায় নিয়ে গেল মহিলা; রঙচঙে পর্দা দিয়ে ঘরটা শােবার ঘর থেকে আলাদা করা। ঘরটায় যিশুর পবিত্র হৃদয়ের ছবি, একটা টেবিল আর খান দুয়েক চেয়ার ছাড়া কিছু নেই।
মহিলা বসে পড়ে তাকেও বসতে বলে। তারপর হাতে তুলে নেয় হাত। নিরব প্রার্থনা করতে থাকে। শুনে মনে হয় বেদুইনদের কোন প্রার্থনা। পথেঘাটে অনেক বেদুইনের সাথে পরিচয় হয়েছে তার; তারাও ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু কোন পশুর পাল নেই। লােকে বলে বেদুইনরা অন্যদের ঠকিয়ে 'টকিয়ে জীবন চালায়। তাদের সাথে নাকি দুষ্ট আত্মার খুব দহরম মহরম। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েকে তুলে নিয়ে গােপন জায়গায় নিয়ে যায়। তারপর জন্মের তরে দাস দাসী বানিয়ে রাখে। ছেলেবেলায় সে সর্বক্ষণ একটা আতঙ্কে থাকত। এই বুঝি বেদুইনরা এল, এই বুঝি তারা তাকে চিরদিনের জন্য নিয়ে গেল। সেই বাল্যকালের স্মৃতি ফিরে আসে মহিলার হাতে হাত রাখার সাথে সাথে।
কিন্তু এখানে তাে যিশুর পবিত্র হৃদয় আছে, ভয়ের কী? ভাবে নিজেকে ফিরে পাবার চেষ্টা করতে করতে। হাত যেন না কাঁপে, তাহলে ভয়ের ব্যাপারটা বয়েসি মহিলা টের পেয়ে যাবে।
গুপ্তধনের খোঁজে রাখাল
এরপর মহিলা তাকে চলে যেতে বলে। অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। আর নয়। ছেলেটার আশাভঙ্গ হয় । সে আর কখনাে স্বপ্নে বিশ্বাস করবে না। কখনাে না। অনেক ব্যাপারে ভাবতে হয় তাকে, অনেক বিষয় মাথায় রেখে চলতে মহিলা কিছুক্ষণ কোন কথা বলে না। তারপর আবার সান্তিয়াগাের হাত হাতে তুলে নেয়ার পালা। আবার সেগুলাে খুটিয়ে দেখার পালা।
'এখন আমি তােমার কাছ থেকে সােনা-রূপা কিছুই চাই না। কিন্তু গুপ্তধন পেলে দশভাগের একভাগ চাই।'
ঝলমলিয়ে হেসে ওঠে ছেলেটা। যাক, গুপ্তধনের স্বপ্নের ব্যাখা চাইতে গিয়ে যে টাকাটুকু জলে যেত সেটা আর হারাল না।
“ঠিক আছে। স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিন।
“আগে শপথ কর । শপথ কর যে আমি যা বলব সে অনুসারে গুপ্তধন পেলে আমাকে দশভাগের একভাগ দিয়ে দিবে।'
শপথ করে সান্তিয়াগাে। মহিলা আবার যিশুর হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে শপথ করতে বলে।
‘স্বপ্নটা পৃথিবীর ভাষায় এসেছে, ব্যাখ্যাতাে আমি করতে পারি হরহামেশা, ' কিন্তু অর্থ বের করা একটু জটিল। তাই মনে হচ্ছে আমি তােমার পাওনা থেকে কিছু প্রাপ্য।
‘আর এ হল আমার অর্থ: তােমাকে অবশ্যই মিশরের পিরামিডে যেতে হবে। আমি কখনাে তাদের কথা শুনিনি, তবে কোন শিশু যদি তােমাকে সেসব দেখিয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তেমন কিছু আছে। সেখানে সম্পদ পাবে। ধনী বনে যাবে তুমি।
এবার সান্তিয়াগাের অবাক হবার পালা। এরপর বিরক্ত। এ কথা জানার জন্যতাে বয়েসি মহিলার কাছে আসার কোন দরকার নেই। তার পর মনে পড়ে যায়, ভাগ্য ভাল, কোন টাকাকড়ি দিতে হচ্ছে না।
‘আমি এসবের জন্য সময় নষ্ট করব বলে মনে হয় না।'
‘আগেই বলেছি, তােমার স্বপ্নটা জটিল। এ হল জীবনের সাধারণ ব্যাপার যা ধীরে ধীরে অসাধারণ হয়ে ওঠে। শুধু জ্ঞানীরাই মূল অর্থ ধরতে পারে। কিন্তু আমি অনী নই। আর জ্ঞানী নই বলে আর সব জিনিস শিখতে হয়, শিখতে হয় হাতের তালু পড়া।
“তাহলে কী করে মিশরে যাব?'
‘আমার কাজ স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা। কী করে বাস্তব করতে হয় সে সম্পর্কে আমি ক অক্ষর গাে-মাংস। তাইতাে আমাকে মেয়ের উপর নির্ভর করে থাকতে হয়। বাজারে গিয়ে কিছু খাবার দাবার কিনে খেয়ে নেয় প্রথমে। তারপর পুরনাে বইটা বিকিয়ে দিয়ে আরাে একটু মােটা দেখে বই কিনে নেয়। তারপর চত্বরে বসে নতুন মদ থেকে একটু চেখে দেখে। ভ্যাপসা গরমের দিনে সামান্য মদ্যপান মন্দ লাগে না।
দি আলকেমিস্ট pdf
অচেনা জায়গায় ভ্রমণ
শহরে ঢোকার পথে ভেড়াগুলােকে কোন এক বন্ধুর আস্তাবলে রেখে এসেছে সে। ভ্রমণের এই এক মজা। দেশ থেকে দেশ দেশান্তরে যাও, নতুন নতুন বন্ধু বানাও, আবার তাদের সাথে বেশি সময় কাটিয়ে বিরক্ত হবার সুযােগও নেই হাতে । মানুষ যখন নিত্যদিন একই মুখ দেখতে থাকে ধর্মশালায় থাকার দিনগুলাের মত, তখন সেই অবয়বগুলাে জীবনের অংশ হয়ে যায় । তখন মানুষের মনে তাদের একটু বদলে দেখার ইচ্ছা হয় । যখন বদলে দেখা যায় না, কেন যেন রাগে ফেটে পড়ে কেউ কেউ। সবারই যেন একটা গত্বাধা নিয়ম আছে, সবাই যেন চায় অন্যের জীবনের চালচলন তার ইচ্ছামত বা তার আদর্শমত হােক। শুধু নিজের জীবনটার ব্যাপারে এসব থলি শূণ্য।
সূর্য আরো একটু নেমে যাবার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে সান্তিয়াগাে । তখন পাল নিয়ে মাঠের দিকে রওনা হওয়া যাবে। আর মাত্র দিন তিনেক। তার পরই মেয়ের সাথে দেখা। সেই মেয়েটার সাথে দেখা। | কিনে আনা বইটা পড়তে শুরু করে সে। প্রথম পাতাতেই কবর দেয়ার অনুষ্ঠানের বর্ননা। সেখানকার মানুষগুলাের নামও কেমন বিদঘুটে। উচ্চারণ করতে দাত ভেঙে যায়। যদি কখনো বই লিখি, ভাবে সে, তাহলে এক সময়ে। একজনের বেশি মানুষ হাজির করব না যাতে লােকে নাম মনে করতে গিয়ে ভিড়মি না খায়।
পড়ার দিকে অবশেষে মন দিতে পেরে ভাল লাগে তার। বইটা মন্দ না। শুধু কবর দেয়ার দিনটা কেমন যেন মন খারাপ করে দেয়। রীতিমত তুষারপাত হচ্ছিল তখন। শিতল অনুভূতি এসে যায় মনে।
পড়া চলছে, এমন সময় বয়েসি এক লােক ধপ বসে পড়ে তার পাশে। কথা চালানাের জন্য যেন উসখুস করছে লোকটা।
“কী করছে এরা, এ্যা?' চত্বরের দিকে আঙুল তাক করে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় লােকটা।
“আর যদি কখনাে মিশরে না যাই?
তখন আমার আর কষ্টের ফল পাওয়া হবে না। এর আগেও এমন হয়েছে।'
কাজ।' এমন শুদ্ধভাবে জবাব দেয় সান্তিয়াগাে যেন লােকটা বুঝে যায় সে কথা চালাচালিতে খুব একটা আগ্রহী নয়।
আসলে তার মনে এখন বণিকের মেয়ের সামনে ভেড়া মুড়িয়ে দেয়ার কল্পনা। মেয়েটা তাহলে বুঝবে। বুঝবে এ যে সে ছেলে নয়। কঠিন কঠিন কাজ করে ফেলতে পারে সহজেই । সে অনেকবার ভেবে ফেলেছে কথাগুলাে । আস্তে আস্তে মেয়েকে বলবে, কী করে ভেড়া ন্যাড়া করতে হয়। শুরু করতে হবে পিছনদিক থেকে। মুড়িয়ে নেয়ার সময় কিছু গালগল্প চালাতে হবে, কী কথা বলা যায় সেসব ভেবে ভেবেও হয়রান সে। মেয়েটা বইয়ের গল্প আর তার বলা গল্পের ফারাক বুঝতে পারবে না মােটেও। পড়তেই জানে না।
এদিকে এখনাে বুড়াে লােকটা কথা চালানাের জন্য অস্থির হয়ে আছে। আগেই বলেছে, একেতাে ক্লান্ত তার উপর তৃষ্ণার্ত। সান্তিয়াগাের বােতল থেকে এক চুমুক মিলবে নাকি? তার এদিকে ছেড়ে দে মা কেদে বাচি অবস্থা। বােতল এগিয়ে দেয়। তাও সে তাকে ছেড়ে যাক। কিন্তু বয়েসি লােকটার একটাই ইচ্ছা। আরাে একটু কথা বলা। কী বই পড়ছে সে? এবার আর পারে না সান্তিয়াগাে। অন্য কোন বেঞ্চিতে গিয়ে বসবে কিনা ভাবছে। কিন্তু বাবা বলেছিল, বয়স্কদের সাথে সম্মান দেখিয়ে আচরণ করতে হয়। ফলে বইটা এগিয়ে দেয় তার দিকে দুটা উদ্দেশ্যে: প্রথমত, সে নিজেও ছাই জানে না নামের উচ্চারণটা কী হবে; দ্বিতীয়ত বয়েসি লােকটা যদি পড়তে না জানে তাহলে সে লজ্জা পেয়ে অন্য কোন বেঞ্চে গিয়ে বসবে।
‘হুম...' উল্টেপাল্টে এমনভাবে বইয়ের দিকে তাকায় বুড়ো, যেন বিচিত্র কিছু দেখছে, 'বইটা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বিরক্তিকর।'
এবার সান্তিয়াগাের অবাক হবার পালা। লােকটা শুধু পড়তে জানে না, আগেভাগেই সেটা পড়ে রেখেছে। আর তার কথামত সত্যি সত্যি যদি এ বই বিরক্তিকর হয়ে থাকে তাে এখনাে বদলে নেয়ার সময় আছে।
এ বইতে যা আছে প্রায় একই কথা থাকে দুনিয়ার আর সব বইতে,' কথা বলার বিষয় পেয়ে গেছে বয়েসি লােকটা, এখানে কী ব্যাখ্যা করা আছে জান? ব্যাখ্যা করা আছে যে মানুষ তার আসল গন্তব্য নিজে নিজে ঠিক করে নিতে পারে না। আর শেষে লেখা আছে যে সবাই সর্বশান্ত হয়ে ধরে নেয় পৃথিবী আসলে বিশাল এক ফক্কিকার।'
তাহলে পৃথিবীর সবচে বড় মিথ্যাটা কী? অবাক না হয়ে পারে না ছেলেটা।
‘তা হল: আমাদের একেকজনের জীবনের এক একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে এসে আমাদের আশপাশে যা হচ্ছে তার উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। তখন জীবনের নিয়ন্ত্রণ নেয় ভাগ্য। এটাই দুনিয়ার সবচে বড় মিথ্যা।'
কিন্তু এমন কিছু আমার ক্ষেত্রে হয়নি। তারা আমাকে ধরেবেধে যাজক বানাতে চেয়েছিল। আমি চেয়েছিলাম রাখাল হতে। তাই হয়েছি।'
‘ভাল। দারুণ। কারণ তুমি সত্যি সত্যি ভ্রমণ করতে ভালবাস।'
‘আমি কী ভাবছি তার নাড়িনক্ষত্র দেখি জানে লােকটা!' ফিসফিসিয়ে নিজেকে বলে সান্তিয়াগাে। এদিকে লােকটা পাতার পর পাতায় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। এখন আর তার দিকে কোন মনােযােগ নেই। এতক্ষণে তার নজরে পড়ল, লােকটার বেশভূষা বিচিত্র। দেখে মনে হয় আরব। এ তল্লাটে আরবদের দেখা পাওয়া দুরাশা । তারিফা থেকে আফ্রিকা যেতে মাত্র কয়েক ঘন্টা সময় লাগে। শুধু সরু জলাশয় পেরিয়ে যেতে হবে জাহাজে করে। নৌকা হলেও চলে। ও, আরবরাতাে এ শহরে মাঝেমধ্যেই আসে। তারপর বিকিকিনি করে। অবাক করা প্রার্থনা করে দৈনিক কয়েকবার।
‘কোথেকে এসেছেন আপনি? ‘অনেক জায়গা থেকে।'
'কেউ অনেক জায়গা থেকে আসতে পারে না। আমি রাখাল, অনেক। অঞ্চলে গিয়েছি, কিন্তু এসেছি মাত্র একটা এলাকা থেকে। আদ্যিকালের দুর্গের পাশের শহর। সেখানেই জন্ম।'
“আচ্ছা, তাহলে বলতে হয় আমি জন্মেছিলাম সালেমে।'
কে জানে সালেম কোথায় । কিন্তু প্রশ্ন করতে সাহস হয় না। যদি ছােট চোখে দেখে বৃদ্ধ লােকটা। চত্বরে ভিড় করা হরেক ধরনের মানুষের দিকে তাকায় সে। সব আসছে যাচ্ছে। যাচ্ছে আসছে। মহাব্যস্ত।
'মানে, সালেম জায়গাটা কেমন? কোন সূত্র পাবার আশায় আন্দাজে ঢিল ছােড়ে সান্তিয়াগাে।
সব সময় যেমন ছিল তেমনি।'
কোন সূত্র পাওয়া গেল না। এটুকু সে জানে, সালেম আন্দালুসিয়ার কোন এলাকা নয় । থাকলে এতদিনে যাক না যাক, শুনতে পেত সে এলাকার কথা।
‘সালেমে কী করেন আপনি?
'আমি সালেমে কী করি?' এবার সত্যি হেসে উঠল লােকটা। আসলে... আমি সালেমের রাজা!'
মানুষ কত বিচিত্র কথাই না বলে! মাঝে মাঝে তাই মনে হয়, ভেড়াদের সাথে থাকাটা মােটেও মন্দ নয়। তারা কি বলতে পারে না। আর সাথে একটা বই হলে- তােফা। সেখানে আছে বিচিত্র সব কাহিনী। আর সবখানে যাওয়া, সব পরিবেশ বুঝে নেয়া কঠিন; সহজ হল, সাথে একটা বই রাখা। কিন্তু মুশকিল হয় লােকজনের সাথে কথা বলার সময়, মাঝে মাঝে ধুপ করে মানুষ এমন সব কথা বলে বসবে যে কথার পিঠে কোন কথা খুজে পাবে না।
কিছু হয়ে থাকে তাে এখনো বদলে নাও
তুমি।
'আমার নাম মেলসিজেদেক,' অবশেষে বলল লােকটা, কতগুলাে ভেড়া আছে তােমার?'
'যথেষ্ট।' ঠান্ডা জবাব দেয় সান্তিয়াগাে। লােকটা তার সম্পর্কে আরাে জানার চেষ্টা করছে। বােঝা যায়।
'আচ্ছা! তাহলে আমাদের একটা সমস্যা দেখা দিল যে। তােমার যদি সত্যি সত্যি যথেষ্ট পরিমাণে ভেড়া থেকে থাকে তাহলে আমি তােমাকে কোনভাবেই সহায়তা করতে পারব না।'
এবার আরাে বিরক্ত হচ্ছে ছেলেটা। সে সাহায্য চাইল কোন সময়? বুড়াে লােকটাইতাে আগ বাড়িয়ে তার কাছ থেকে একটু মদ খেতে চেয়েছিল। গায়ে পড়ে কথা শুরু করাটাও তারই কাজ।
‘বইটা দেন দেখি। আমার এখন উঠতে হবে। অনেক কাজ বাকি । ভেড়াগুলাে একত্র করে রওনা দিতে হবে।'
তােমার ভেড়াগুলাের দশভাগের একভাগ আমাকে দাও,' বলল বয়েসি লােকটা, তাহলে আমি তােমাকে গুপ্তধন পাবার পথের কথা বলতে পারি।'
স্বপ্নের ব্যাপারটা মনে পড়তেই বাকি কথাগুলাে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বয়েসি মহিলা তার কাছ থেকে কিছু নেয়নি, কিন্তু এ বুড়াে লােকটা কে জানে মহিলার স্বামী কিনা- এমন কিছু চাচ্ছে যা দিয়ে মহিলার টাকাও পুষিয়ে যাবে, আবার বাড়তি কিছু পাওয়া যাবে । মনে হয় বুড়াে লােকটা বেদুইন।
কিন্তু সে কিছু বলার আগেই বয়স্ক লােকটা উবু হয়ে চত্বরের ধুলার গায়ে সান্তিয়াগাের লাঠি দিয়ে কী যেন লেখা শুরু করল। তার বুক থেকে উজ্জ্বল কীসের আলাে যেন বিচ্ছুরিত হয়। এক পলকের জন্য রীতিমত অন্ধ বনে যায় ছেলেটা। মুহুর্তের মধ্যে, এ বয়েসি লােকদের জন্য যা বেমানান গতি, সে গতিতে বুক ঢেকে ফেলল লােকটা। এবার দৃষ্টি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। মাটিতে লেখাগুলাে পড়তে পারছে সে।
সেখানে, এক খুদে শহরের ক্ষুদ্রতর চত্বরে জমে ওঠা ধুলার উপর ছেলেটা দেখতে পায় তার বাবার নাম, দেখে মায়ের নাম, যে ধর্মশালায় পড়েছিল সেটার নাম । দেখে বণিকের মেয়েটার নাম- যে নাম জানে না সে। দেখে আরাে অনেক শব্দ, যেগুলাে কখনো বলেনি কাউকে। ছেলেটা জানে না কোন মানুষের লক্ষ্য জিনিসটা কী।
লক্ষ্য হল সে বিষয় যা কেউ সব সময় চায়। কম বয়েসি থাকতে সবাই তার লক্ষ্য চিনে যায়।
‘সেটা পরিচিত হবার পর স্পষ্ট হয়, সম্ভব। সব সম্ভব। স্বপ্নে আর ভয় পায় না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অদ্ভুত এক শক্তি তাদের বিশ্বাস করাতে শুরু করে যে লক্ষ্যে পৌছানাে অসম্ভব।
সব অর্থ ছাই বুঝছে রাখাল ছেলে। তার শুধু একটাই চিন্তা। সেই রহস্যময় শক্তির ব্যাপারটুকু বুঝে নিতে হবে। শুনলে চোখ বড় বড় করে ফেলবে বণিকের মেয়ে।
‘এও এক শক্তি। শক্তিটা না-বােধক । কিন্তু আসলে সেটাই তােমাকে লক্ষ্য অর্জনের পথ দেখাবে। তােমার আত্মা, তােমার ইচ্ছাকে প্রস্তুত করে এটা, শিখায় এ গ্রহের বড় সত্যিটা: যেই হও না কেন তুমি, যাই কর না কেন, যখন সত্যি সত্যি মন থেকে চাইবে কিছু, চাও এ কারণে যে বিশ্বব্রহ্মান্ডের ভিতর থেকেই ইচ্ছা জেগে ওঠে তােমার ভিতরে। পৃথিবীর বুকে এটাই তােমার অভিযান।'
এমনকি যদি আমি ভ্রমণ করতে চাই, যদি কাপড়-সুতার বণিকের মেয়েকে বিয়ে করতে চাই, সেটাও লক্ষ্য হতে পারে?'
আবার কোন গুপ্তধনের পিছু ধাওয়াও হতে পারে। বিশ্বের আত্মা শুদ্ধ হয়। কী করে জান? মানুষের আনন্দে। আবার নিরানন্দ, হিংসা, ক্রোধ দিয়েও হয়। লক্ষ্য বুঝতে পারাই মানুষের জীবনের আসল উদ্দেশ্য। সব জিনিসই এক।
আর যখন তুমি কিছু যাও, পুরাে সৃষ্টিজগতে সাড়া পড়ে যায়। ফিসফাস করে তােমাকে সাহায্য করার জন্য কোমর বেঁধে নেমে পড়ে সবকিছু।'
নিরবতা নেমে আসে ছােট শহরের চত্বরে। আবার কথা বলে ওঠে বয়েসি লােকটা।
“তুমি ভেড়ার পাল চালাও কেন?” ভ্রমণ করতে চাই, তাই।
লােকটা এক রুটিওয়ালার দিকে আঙুল তােলে। লােকটা দাঁড়িয়ে আছে নিজের দরজার সামনে। বাচ্চা থাকতে ঐ লােকটাও পরিভ্রমণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রথমে চিন্তা করল একটা রুটির কারখানা কিনে কিছু পয়সাকড়ি জমিয়ে নিবে। বুড়াে হলে মাসখানেক কাটিয়ে আসবে আফ্রিকায় । লােকটা বুঝতেই পারল না যে আসলে মানুষ যার স্বপ্ন দেখে তা করতে পারে যে কোন সময়ে।'
লােকটার তাে রাখাল ছেলে হবার কথা তাহলে।
pdf bangla the Alchemist by Paulo Coelho
“আমি সালেমের রাজা।' বলেছিল বয়েসি লােকটা। ‘রাজা কেন সামান্য এক রাখালছেলের সাথে কথা বলবে?”
“বেশ কিছু কারণে। সবচে বড় কারণ, তােমার লক্ষ্য খুজে বের করতে পেরেছ তুমি।
লােকটাকে ছেলেটা তার লুকানাে সম্পদের ব্যাপারে বলে।
লোকটা পাথর হয়ে গেল
‘বহতা ধারার আঘাতে জেগে ওঠে সম্পদ, আবার ডুবে যায় সেই একই ধারার নিচে,' বলছে লােকটা, তুমি যদি নিজের সম্পদ সম্পর্কে জানতে চাও, ভেড়া থেকে দশভাগের একভাগ দিয়ে দিতে হবে।'
সম্পদের এক দশমাংশ হলে কেমন হয়? হতাশ দেখায় লােকটাকে।
তুমি যদি যা হাতে নেই তা নিয়েই ওয়াদা দিতে থাক, সেটা পাবার আশাই চলে যাবে।
এ জানালাটা দিয়ে লােকে আফ্রিকার টিকেট কাটে। আর সে জানে, মিশর আফ্রিকায় ।
‘কোন সাহায্য করতে পারি?' জানালার পিছনে বসা লােকটা জিজ্ঞেস
কথাটা কিন্তু তার বিবেচনায় ছিল।' বলল বয়েসি লােক, কিন্তু রুটিওয়ালারা, রুটির কারখানার মালিকরা রাখালেরচে বেশি সম্মানিত। তাদের আছে ঘর, আর রাখালের আছে খােলা মাঠ। বাবা মা মেয়েকে রাখালের সাথে বিয়ে দিতে চায় না, দিতে চায় রুটি কারখানার মালিকের সাথে।'
হৃদয়ের কোথায় যেন একটু ধাক্কা লাগে সান্তিয়াগাের। এক বণিকের মেয়ে আছে কাছাকাছি কোথাও। সেখানে যে রুটিওয়ালাও আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বলে যাচ্ছে বুড়াে, অবশেষে মানুষ রুটির কারখানার মালিক আর রাখালদের ব্যাপারে কী ভাবে সেটাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল জীবনের লক্ষ্যেরচে।'
লােকটার কথা থেমে যায় হঠাৎ করে। সে মন দেয় বইয়ের পাতায়। পড়তে থাকে একমনে । তারপর আচমকা বাধা দেয় সান্তিয়াগাে।
‘আমাকে এসব বলছেন কেন?
কারণ তুমি তােমার উদ্দেশ্য খুজে বের করার চেষ্টা করছ। আর যে পর্যায়ে আছ তাতে যে কোন মুহুর্তে ইচ্ছাটা ত্যাগ করতে পার।'
‘আর ঠিক এ মুহুর্তে দৃশ্যে আপনি হাজির হন?
না। সবসময় এভাবে হাজির হই না। কিন্তু কোন না কোন গড়ন নিয়ে হাজির হই বৈকি। কখনাে সামাধান আকারে, কখনাে ভাল কোন ধারণা হিসাবে। আবার কখনাে খুব গুরুত্বপূর্ণ পল অনুপলে ঘটনাগুলােকে সহজে ঘটিয়ে দেই। আরাে নানা ঘটনা ঘটাই, শুধু লােকে বুঝতে পারে না যে আমিই এসব করছি।' লােকটা বুঝিয়ে বলে, গত সপ্তাহের আগের সপ্তায় খনি শ্রমিকের সামনে তাকে পাথর হয়ে আসতে হয়েছিল। তার গত পাঁচ বছরের শ্রম শুধু রত্নের জন্য। এমারাল্ড পাথর বের করবে সে পাথর থেকে। সেজন্য লাখ লাখ পাথর। ভেঙেছে সে নদীর নিচ থেকে তুলে এনে, পাহাড়ের গা থেকে খুলে এনে।
আর মাত্র একটা, একটা পাথর ভাঙলেই সে এমারাল্ড পেয়ে যেত। লােকটা যখন লক্ষ্যের জন্য সব ছেড়ে দিয়েছে, হাজির হতে হল বৃদ্ধকে। পাথর হয়ে গেল সে। পাথরটা গড়িয়ে এল তার পায়ের কাছে।
পাঁচ বছরের রাগ সামলাতে না পেরে সে পাথরটাকে ছুড়ে দেয় দূরে। এত জোরে ছেড়ে সে যে পাথর ভেঙে যায়। সেটার ভিতরেই ছিল পৃথিবীর সবচে সুন্দর এমারাল্ডটা।
‘মানুষ তার জীবনের শুরুতে জানতে শুরু করে জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে,' কেমন যেন তিক্ত শােনায় বয়েসি লােকটার কন্ঠ, আর সে কারণেই হয়ত চটজলদি হালও ছেড়ে দেয়। এই হল ঘটনা।
হয়ত কাল, সরে যেতে যেতে বলে ছেলেটা। একটা ভেড়া বিক্রি করলেই সে অপর প্রান্তে পৌছে যাবার রাহা খরচ পেয়ে যাবে। কিন্তু ভাবনাটা কেমন যেন ভয় ধরিয়ে দেয়।
‘আরেক স্বপ্নবিলাসী,' সাথের লােকটাকে শােনায় টিকিটওয়ালা, যাবার মত টাকা নেই, ইচ্ছা আছে।'
টিকেটের জানালায় বসে থাকার সময় তার মনে হঠাৎ দেখা দেয় ভেড়াগুলাের চিন্তা। আর সে চিন্তা কী করে যেন অস্থির করে তােলে। ফিরে যেতে ইচ্ছা হয় । ইচ্ছা করে আবার রাখাল ছেলে হয়ে যেতে। দু বছরে রাখালদের সব কাজ শিখে ফেলেছে: কী করে ভেড়ার পাল চালাতে হয়, গর্ভবতী ভেড়াগুলাের যত্ন নিতে হয় কী করে, কী করে বাঁচাতে হয় শিকারী পশুর হাত থেকে। আন্দালুসিয়ার সব মাঠ, সব পানির ধারা তার পরিচিত । এবং সে তার প্রত্যেক ভেড়ার ন্যায্য মূল্য কতটা তাও জানে।
যত ঘুরপথে সম্ভব আস্তাবলের দিকে পা বাড়ায় সে। যাবার পথে শহরের বাইরে থাকা বিশাল দুৰ্গটার পাশ দিয়ে উপরে ওঠে। দেখতে পায় জলরাশি। জলরাশি ছাড়িয়ে দেখতে পায় আফ্রিকার উপকূল। সেখান থেকেই মুররা এসেছিল স্পেনে। জয় করেছিল স্পেন।
এখান থেকে পুরাে নগরীও দেখা যায়। দেখা যায় বুড়াে লােকটার সাথে বসে থাকার জায়গা। এ শহরে এসেছিল শুধু এক মহিলাকে পাবার জন্য।