Doctor Tharn PDF Bangla

25 minute read
0

ডক্টর থার্ন - হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড এর বই সমূহ pdf

এক 
Doctor Tharn pdf Logo

অধ্যবসায় - ডক্টর থার্ন pdf

ডক্টর থার্ন যে আমার আসল নাম নয়, সেটা আশা করি তেঁড়া পিটিয়ে গােটা দুনিয়াকে জানানাের কোন দরকার নেই। বছর কয়েক আগে নামটা বেশ বিখ্যাতই ছিল। অবশ্য বিখ্যাত না বলে কুখ্যাত বলাটাই বোধহয় বেশি যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু এ ক’বছরে কত ঘটনাই না ঘটে গেল!

ভয়াবহ এক যুদ্ধের সাক্ষী হতে হলো বিশ্বকে। ঘটে গেল এক মহাদেশীয় বিপ্লব। | 
বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত দু’জন ব্যক্তিকে জড়িয়ে স্ক্যাণ্ডাল রটে গেল। যার একটি নৈতিক হলেও, অপরটি পুরোপুরি অর্থনৈতিক! আর আমার মত একজন ডাক্তারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে, এমন ঘটনাও খুব একটা কম ঘটেনি। বিশেষ করে, ইতালি আর ফ্রান্সে আচমকা হানা দেয়া ‘এশিয়াটিক প্লেগ’এর প্রাদুর্ভাবের কথাতো বলাই বাহুল্য।  

রাশিয়া এবং জার্মান নিয়ন্ত্রণাধীন পোল্যাণ্ডে হওয়া অদ্ভুত মধ্যযুগীয় ‘গ্রেইন সিকনেস'-এর কথাই বা বাদ দিই কী করে? প্রায় বিশ হাজার মানুষের প্রাণহানিতো আর মামুলি ব্যাপার নয়, তাই না?  পরপর ঘটে যাওয়া এসব ঘটনাই আসলে মানুষের নজর অন্য দিকে সরিয়ে নেবার জন্য দায়ী।  
তা না হলে গত দুই শরতে ইংল্যাণ্ডে মাথাচাড়া দেয়া স্মল পক্স মহামারীর কথা মানুষ এত সহজে ভুলতে পারত না।  আমার নিজের শহর ডানচেস্টারেই প্রথম আঘাত হানে রােগটা। বিগত বহু বছর ধরে আমিই সংসদে ডানচেস্টারের প্রতিনিধিত্ব করে আসছি।

  1. ডক্টর থারন pdf
  2. ডক্টর থার্ন pdf bangla
  3. Doctor thern pdf bangla

ভয়াবহ রােগটা আমাদেরকে মুক্তি দিয়ে চলে যাবার পর আবিষ্কার করলাম, কম করে হলেও আমার শহরের প্রায় পাঁচ হাজার অধিবাসী হার মেনেছে রােগটার কাছে। যারা বেঁচে আছে, তাদের অনেককেই এখন আর চেনার জো নেই। তবে জনসংখ্যা বাড়ানােটা তাে আর খুব একটা কঠিন কাজ না-আর বসন্তের দাপটাও যেহেতু বংশগত নয়-তাই সহজেই সব কিছু ভুলতে বসেছি আমরা।

অবশ্য ভুলতে বসার আরও একটা বড় কারণও রয়েছে! বাধ্যতামূলক টিকাদানের বর্তমান আইনটা এতই কড়া যে, এমনটা দ্বিতীয়বার হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে শূন্যের কোঠায়!
এখন কেবল মৃতরাই চাইলে আপত্তি জানাতে পারে। তবে সেটা শােনার মত সময় এবং সদিচ্ছা আমাদের আছে। কিনা তা নিয়ে আমি বড্ড সন্দিহান!

মৃত্যুর পর আর কারও আপত্তি জানানাের মত সুযোেগ আদৌ থাকে কিনা, সে-ব্যাপারেও অবশ্য নিশ্চিত নই আমি। মানুষের মগজ আর দেহ সম্পর্কে আমি খুব বেশি জানি। তাই আত্মার ওপর খুব একটা ভরসা নেই আমার। তবে কিনা জীবনে এমন অনেক জিনিসও দেখেছি, যে সরাসরি ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ ছাড়া ঘটা একেবারেই অসম্ভব ছিল। 

প্রার্থনা করি, ঈশ্বর আমার আর্ভার নাজেহাল অবস্থা দেখে নিশ্চয়ই আমাকে ক্ষমা করবে কেননা তিনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন, তাহলে আমার যে কী অবস্থা হবে, তা ভাবতেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে!

হ্যাঁ , ঠিক ধরেছেন। ডানচেস্টারের পাঁচ হাজার অধিবাসীর মৃত্যুর জন্য এই আমিই দায়ী! ওদের অধিকাংশই ছিল অল্পবয়সী প্রাণােচ্ছল তরুণ-তরুণী। এই আমার প্ররােচনা, চটকদার কথাবার্তা এবং সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন হর্তাকর্তাদের প্রভাবিত করার পরােক্ষ ফলই হলাে-তাদের মৃত্যু। | 

‘ডাক্তাররা ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নন; ভুল তাঁদেরও হতে পারে।’-কথাটা সত্যি। | আর যদি সেই ভুল হাজার-হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়, তাহলে এটাও বলা চলে যে, “ঈশ্বর হয়তাে এমনটাই চেয়েছিলেন। কিন্তু যদি সেই ভুলটা ‘ভুল’ না হয়ে উদ্দেশ্যপ্রণােদিত হয়, তাহলে?
তাহলে হয়তাে এই মৃত মানুষের দল আমাকে ঘিরে ধরে বলত, জেমস থার্ন, তুমিই আমাদেরকে হত্যা করেছ। কেননা নিজের স্বার্থে এমন একটা সিদ্ধান্ত তুমি আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছ, যার ফলাফল তুমি আগে থেকেই জানতে। তুমি পাপী, তুমি খুনি। তাই না?

PDF পড়তে আরো নিচে যান

যাক, বলুকগে। আমি ভয় পাই না। কেননা যা ঘটে গেছে তা আর ফেরানাের কোন উপায় নেই। কিন্তু ওই হাজার-হাজার মানুষের ভিড়ে এমন দু’জন আছে, যাদের চোখে চোখ রাখার সাহস আমি আর কখনওইসঞ্চয় করে উঠতে পারব না। ওদের একজন-জেন-আমার মেয়ে ওর জীবনপ্রদীপ বলতে গেলে আমি নিজ হাতেই নিভিয়ে দিয়েছি। আরেকজন আর্নেস্ট মার্টির), ওঁর প্রেমিক। একরকম স্বেচ্ছায়ই আমার মেয়ের সঙ্গে কবরে গিয়েছে ও। 

তবে আমার প্রতি খুব একটা অনুযােগ থাকার কথা নয় ওদের। আমার সমস্ত দোষত্রুটি জানা সত্ত্বেও, আমার লক্ষ্মী মেয়েটা পাগলের মত ভালবাসত আমাকে। | মাৰ্চিসন অবশ্য প্রথমটায় সব হারানাের যন্ত্রণায় প্রায় পাগলপারা হয়ে গিয়েছিল। আদতে সে ছিল একজন সৎ ও সাদা মনের মানুষ। তাই মৃত্যুর সময় আমার আফসােস ও অনুশােচনার গভীরতা বুঝতে পেরে, আমায় ক্ষমা করে দিয়েছিল ছেলেটা।। | তবুও মৃত্যুর পর ওদের মুখােমুখি হতে ভয় পাচ্ছি আমি। সত্যিই পাচ্ছি।

জেনের মা মারা যাবার পর, অন্য কাউকে আর সেভাবে ভালবাসতে পারিনি আমি। আমার জীবনে ছিল শুধু জেন আর জেন। নরক আর আমাকে কী শাস্তি দেবে! মেয়েটা মারা যাবার পর থেকে আজ অবধি প্রতি মুহুর্তেই সীমাহীন নরক যন্ত্রণা ভােগ করে চলেছি আমি। জেন-আমার মেয়ে-এক মিথ্যা দাবিদার আর কাপুরুষের বােকামির শিকার!
আমার বংশের প্রায় সবাই ডাক্তার। আমার দাদা, থমাস থার্ন, অমর হয়ে আছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে। ডানচেস্টারের কাছেই ছিল তার চেম্বার।

আমার বাবা অবশ্য দাদার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে তার চেম্বারটা ছাড়া আর তেমন কিছুই পাননি। বুড়াে মানুষটা আয়েশি জীবন কাটাতে পছন্দ করতেন। যা রােজগার করতেন তার সবটুকুই চলে যেত ভােগবি | নিজের বিয়ের পরপরই বাবা ওই চেম্বারটা বেচে দিয়ে চলে আসেন ডানচেস্টারে। 

সার্জন হিসেবে নাম কামাতে বেশিদিন লাগেনি তাঁর। দিনে-দিনে ক্রমশ উন্নতি করে চলছিলেন তিনি। কিন্তু আমার জন্মের কিছুদিন পরেই ছন্দপতন ঘটে তাঁর সেই ঊর্ধ্বমুখীকেরিয়ারে। | আমার জন্মের মাস চারেক আগের কথা। গুটি বসন্তের এক রােগী দেখতে গিয়ে নিজেই সেই রােগ বাধিয়ে বসেন। 

বাবা অবশ্য খুব একটা গুরুতর না হওয়ায়, কয়েক দিনের মধ্যেই আরােগ্য লাভ করেছিলেন তিনি।
তবে রােগটা তাকে একেবারে কাহিল করে ফেলেছিল। আর তাই বছর না ঘুরতেই ফুসফুসের যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন তিনি। ডাক্তার তাকে উষ্ণ কোন এলাকায় চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

নিতান্ত বাধ্য হয়েই নিজের সহকারী, ডা, বেলের কাছে চেম্বারটা বেচে দিয়ে মাদেইরা-য় চলে আসেন বাবা। ভেবেছিলেন, ইংরেজ পর্যটকদের চিকিৎসা করে অন্তত খেয়েপরে বাঁচতে পারবেন। কিন্তু ভুল হয়েছিল তাঁর। পরবর্তী দুটো বছর বাঁচলেন একরকম ধুকেধুকে। সঞ্চয় যেটুকু ছিল, একেবারেই নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিল তা। তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর আর একটা ফুটো পয়সাও ছিল না মা-র হাতে। | তাঁকে ঠিক কোথায় কবর দেয়া হয়েছিল, সেটা জানা নেই আমার। কোন রেকর্ড রাখা হয়নি। তার শিয়রে কেবল সস্তা একটা কাঠের ফলক ছুঁজে দিতে পেরেছিলেন মা। সেই ফলকটাও মাটির সঙ্গে মিশে গেছে বহুকাল আগে।

PDF পড়তে আরো নিচে যান

কয়েকজন সহৃদয় ইংরেজের সাহায্যে ইংল্যাণ্ডে, আমার নানীর কাছে, ফিরে আসতে পেরেছিলেন মা। বছরে মাত্র একশ’ বিশ পাউণ্ড করে পেনশন পেতেন দ্রমহিলা। বাস করতেন ব্রাইটনের কাছাকাছি এক জেলে অধুষিত গ্রামে। সেখানেই আমার বেড়ে ওঠা। না, আমার লেখাপড়ার ব্যাপারে কোন রকম কার্পণ্য করা হয়নি কখনও। কমদামি স্কুল হলেও, শিক্ষাটা আমি ভালই পেয়েছিলাম। | মা চাইতেন, আমি যেন নানার মত নেভির ক্যাপ্টেন হই। কিন্তু রয়্যাল নেভিতে ঢুকতে যে পরিমাণ টাকা লাগে, তা জোগাড় করা সম্ভব হয়নি অর পক্ষে। আর সমুদ্র খুব একটা পছন্দ করি না বলে, আমারও সওদাগর হবার কোন রকম
আগ্রহ ছিল না।

একদম শুরু থেকে আমি বাপ-দাদার মত একজন ডাক্তার হতে চেয়েছি। নিজের বুদ্ধির ওপর আস্থা ছিল আমার। আর এ-ও জানতাম যে, সফল ডাক্তারদের টাকার কোন অভাব হয়। ।
ছােটবেলা থেকেই দারিদ্র্যের কশাঘাত দেখতে বাধ্য হয়েছি আমি। তাই উনিশ বছর বয়সেই বুঝতে পেরেছিলাম-পৃথিবীতে টাকার কোন বিকল্প নেই। সেই কাঁচা বয়সেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম, দুনিয়াটা আসলে ধনীদের জন্যই। বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমার এত বছরের অভিজ্ঞতাও সেই যুবা বয়সের ধারণাকে পরিবর্তন করতে পারেনি একবিন্দু।

ডক্টর থার্ন pdf Bangla


আরাম-আয়েশের কথা নাহয় বাদই দিলাম। কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষাটাই বা মানুষ টাকা ছাড়া পূরণ করতে পারে? সফল রাজনীতিবিদদের কথাই ধরা যাক। এদের প্রায় প্রত্যেকেই কিন্তু অসম্ভব ধনী।
এই দেশটা যতই মানুষে ভরে থাক, এদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক মানুষই নিজেদেরকে আলাদাভাবে চেনাতে পারে। যদি নতুন করে আবার জীবন শুরু করতে পারতাম, তাহলে এই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে শুরু করতাম নতুন জীবন। হয়তাে আমেরিকায় যেতাম, অথবা অন্য কোন সভ্য দেশে। অন্তত ওসব জায়গায় এখানকার মত এতখানি নগ্ন প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। তাই সফল হওয়ার সম্ভাবনাও ওসব জায়গায় ঢের বেশি। ওখানে পরিশ্রম কতোই যােগ্যতার মূল্য পাওয়া যায়। সাফল্যের শিখরে আরােহণ করতে ভাগ্যদেবীর সাহায্যের প্রয়ােজন পড়ে না। | আচমকা পুরােপুরি অপ্রত্যাশিতভাবে ঘুরে গেল আমার জীবনের মােড়! এক চাচা ছিলেন আমার বাবার ছােট ভাই। বলতে দ্বিধা নেই, জীবদ্দশায় আমার দিকে কখনও ফিরেও তাকাননি তিনি। 

কিন্তু মৃত্যুর সময় সেই তিনিই কিনা আমার জন্য সাত শ পঞ্চাশ পাউণ্ড রেখে গিয়েছিলেন! বিশ্বাস হয়? | সাত শ পঞ্চাশ পাউণ্ড! টাকার অঙ্কটা তখন বিশাল ছিল আমার জন্য। এই টাকা দিয়ে লণ্ডনে ঘর ভাড়া নিলাম। সেই সঙ্গে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হলাম ইউনিভার্সিটি কলেজে।
আমার কলেজ ক্যারিয়ার নিয়ে গল্প ফেঁদে কাউকে আর বিরক্ত করতে চাচ্ছি না। তবে কারও যদি জানতে ইচ্ছে হয়, তাহলে কেবল এতটুকু বলি: যথেষ্ট ভাল ছিল আমার রেজাল্ট।

একে তাে নিজের পছন্দের বিষয়, তার ওপর পরিশ্রমও করেছিলাম বিস্তর। তাই আশানুরূপ ফল পেতে বেগ পেতে হয়নি আমাকে। আমার মনে হয়, দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান হলাে এই ডাক্তারি। আর একেবারে সূচনালগ্ন থেকেই এই শাখার একজন উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত হবার লক্ষ্য ছিল আমার।  

চব্বিশ বছর বয়সে সর্বোচ্চ সম্মানের সঙ্গে পাশ করি ডাক্তারি । গােল্ড মেডেল পেয়েছিলাম মেডিসিন এবং সার্জারি দুটোতেই। তারপর হাউস-সার্জন হিসেবে যােগ দিই লণ্ডনের এক হাসপাতালে। চুক্তি শেষ হয়ে যাবার পরও, বাড়তি অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আরেক বছর থেকে যাই ওখানে। | ইচ্ছে ছিল, এর পর থেকে নিজস্ব প্র্যাকটিস শুরু করব। ওই বছরটার শেষ দিকেই মা মারা যান। যদিও খুব বেশি বয়স হয়নি তাঁর। আসলে বাবাকে হারানোর শােকটা তিনি কখনও ঠিক সামলে উঠতে পারেনি। জমাট বাঁধা দুঃখ ধীরে-ধীরে শুষে নিয়েছিল তাঁর সমস্তু শক্তি। | আমাদের মধ্যে খুব বেশি মিল ছিল না সত্যি, তবুও তাঁর মৃত্যুতে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম আমি।

PDF পড়তে আরো নিচে যান

মায়ের মৃত্যুর দুঃখটা ভুলতে-আর আমার ওপর জেঁকে
বসা একঘেয়েমি কাটাতে-নতুন কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নিই আমি। আমার এক বন্ধু ছিল ওয়েস্ট ইণ্ডিজ থেকে মেক্সিকোগামী এক জাহাজ কোম্পানির ডিরেক্টর। ওর জাহাজের ডাক্তার হওয়ার প্রস্তাব দিলাম ওকে। বিনিময়ে আমাকে বিনা খরচে ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

খুশিমনেই রাজি হয়ে যায় সে। এমনকী এটাও প্রস্তাব করে যে, ইচ্ছে করলে মাস তিনেক মেক্সিকোতে থাকতে পারি আমি। তারপর জাহাজটা ফেরার সময় আবার ওটায় চড়ে বসার সুযােগ তাে থাকছেই।
আরামপ্রদ এক ভ্রমণের শেষে ভেরা ক্রুজে গিয়ে পৌছলাম আমি। জায়গাটা কিছুটা অদ্ভুত হলেও বেশ আকর্ষণীয়। বিশেষ করে চমৎকার সব বাড়ি-ঘর আর পরিকল্পনামাফিক সাজানাে-গােছানাে সরু গলিগুলাে সত্যিই দৃষ্টিনন্দন।

তবে আমি যখন ভেরা ক্রুজে পৌছাই, ততদিনে ইয়েলাে ফিভার ওখানটায় আঘাত হেনেছে। তাই আমার কাছে ভেরা ক্রুজের স্মৃতি মানে, খােলা নর্দমার দুর্গন্ধ আর ইতস্তত ঘুরতে থাকা ভ্যান। ওগুলাের কয়েকটার ওপরে তাে শকুন পর্যন্ত দেখতে পেয়েছিলাম। | যা-ই হােক, করার মত কোন কাজ হাতে না থাকায় তিন সপ্তাহ ধরে স্থানীয় ডাক্তারদের ছায়াসঙ্গী হয়ে রােগটাকে। পর্যবেক্ষণ করলাম। 

দুনিয়াতে একটা মাত্র ছোঁয়াচে রােগকেই ভয় পাই আমি। তবে সেটা অবশ্য ইয়েলাে ফিতাঁর নয়। তিন সপ্তাহ পর রওয়ানা হলাম মেক্সিকো সিটির উদ্দেশে।
তখনকার দিনে ভেরা ক্রুজ থেকে মেক্সিকো সিটিতে যাওয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। রেলপথের কাজ তখনও শেষ হয়নি। তার ওপর তৎকালীন মেক্সিকো ছিল প্রায় বুনাে এক রাষ্ট্র। যুদ্ধ-বিগ্রহ ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। বাধ্য হয়েই জীবিকা নির্বাহের জন্য নেমে এসেছিল

রাস্তায় মেক্সিকোবাসীরা। নাহ, ভিক্ষে করতে নয়-ডাকাতি আর খুন-জখম করে পর্যটকদের সর্বস্ব লুটে নিতে। ভেরা ক্রুজ আর মেক্সিকো সিটির মধ্যবর্তী রাস্তাটা ক্রমশই ওপরের দিকে উঠে গেছে। অবশ্য পরের শহরটার অবস্থান যেহেতু ভেরা ক্রুজ থেকে সাত হাজার ফিট ওপরে, তাই তেমনটাই হওয়ার কথা।
রাস্তাটাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগটা গরম অঞ্চল, ওখানে মেয়েরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আনারস আর নারিকেল বিক্রি করে। পরের ভাগটা নাতিশীতােষ্ণ, ওখানে বিক্রি হয় কমলা আর কলা। একদম শেষ ভাগটা ঠাণ্ডা এলাকা। ঘৃতকুমারীর বিস্বাদ ফেনিল রস ছাড়া পান করার মত আর কিছু এই এলাকায় মেলাটা বেশ দুষ্কর।

আমি যে কোচটায় উঠেছিলাম, সেটার যাত্রী ছিল সাকুল্যে আটজন। কোচটাকে টেনে নিচ্ছিল চার জোড়া খচ্চর। | যাত্রীদের পরিচয় দেয়া যাক। চারজন ব্যবসায়ী, দু’জন প্রিস্ট, আমি আর এক সুন্দরী যুবতী। তখন অবশ্য জানতাম না, অদূর ভবিষ্যতে আমার স্ত্রী হতে চলেছে সে!
নীল চোখ আর ঝলমলে চুলের অধিকারী মেয়েটি ছিল আমেরিকার নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা। শিগগিরই জানতে পারলাম ওর নাম-এমা বেকার। ওর বাবা ছিলেন একজন স্বনামধন্য উকিল। অল্প ক'দিন আগেই মারা গিয়েছেন। | শুরুতেই বন্ধু হয়ে গেলাম আমরা। আর একসঙ্গে পরের দশ মাইল যাবার আগেই ওর সম্পর্কে প্রায় সবই জেনে গেলাম আমি।

উত্তরাধিকার সূত্রে খুব বেশি কিছু পায়নি এতিম মেয়েটা। নিকটাত্মীয় বলতে শুধু এক খালা। সেই খালা আবার গােমেজ নামের এক মেক্সিকান হাঁসিয়েণ্ডা মালিককে বিয়ে করেছে। হাসিয়েণ্ডাটা মেক্সিকো সিটি থেকে প্রায় আশি মাইল দূরে, একেবারে হাইল্যাণ্ডের প্রান্ত সীমায়।

এমা বেকার অন্য সব আমেরিকান যুবতীদের মতই রােমাঞ্চপ্রিয় ও স্বাধীনচেতা। তাই খালার কাছ থেকে কিছুদিন বেড়িয়ে যাবার আমন্ত্রণটা পেয়ে আর মানা করেনি। চলে এসেছে একা-একা। খালু গােমেজের এক বন্ধুর মেক্সিকো সিটিতে নিতে আসার কথা ওকে।

ভরা ক্রুজ থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল দিনের মাঝামাঝি একটা সময়ে। যাত্রার প্রথম রাতটা আমরা কাটালাম পােকামাকড়সর্বস্ব এক সরাইখানায়।
ভােরের ঘণ্টা দুয়েক আগে আবার শুরু হলাে আমাদের যাত্রা। সেদিনের পথটা এতটাই খাড়া ছিল যে, মুহুর্মুহু গালি আর চাবুক বর্ষণ করেও খচ্চরগুলােকে নড়াতে কষ্ট হচ্ছিল চালকের। তবুও কয়েক শ গজ পর-পর থেমে বিশ্রাম নিতে বাধ্য হচ্ছিল অবলা প্রাণীগুলাে।

বসে থাকতে-থাকতে পাশে বসা মােটাসােটা প্রিস্টের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। যাজকও অবশ্য ঘুমুচ্ছিলেন। সজোরে নাক ডাকছিলেন ভদ্রলােক।
| মিস বেকার বসে ছিল আমার উল্টো পাশে। হঠাৎ ওর কথাতে ঘুম টুটে গেল আমার।
‘আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত, ডা থার্ন, শান্ত গলায় বলল মেয়েটা। কিন্তু এখন না দেখলে, পরে হয়তাে আফসােস করবেন। কোচের জানালার দিকে ইঙ্গিত করল ও ।

ওর ইশারা করা দিকটায় তাকিয়ে অবর্ণনীয় মােহময় এক দৃশ্য দেখতে পেলাম। সারাজীবনেও সে দৃক ভুলব না আমি। ওরিজাবা পর্বতের চূড়ায় উঁকি দিচ্ছে উদীয়মান সূর্য। অ্যাজটেকরা এই পর্বতের নাম দিয়েছিল ‘দ্য স্টার মাউন্টেন। আমাদের এখনকার উচ্চতা থেকেও প্রায় আঠারাে হাজার ফুট উঁচু এর শীর্ষ।

PDF পড়তে আরো নিচে যান

আগ্নেয়গিরিটার পদতলে ঘন জঙ্গল। ওপর থেকে দেখে মনে হচ্ছে তুষারে ঢাকা। পর্বতশীর্ষের পাশের দিকটা ঢেকে আছে গাঢ় ছায়ায়। তবে ভােরের আলাে আস্তে-আস্তে ঝেটিয়ে বিদায় করে দিচ্ছে ছায়াটাকে। যেন এক বিশাল মশালের মাথায় আগুন ধরিয়েছে কেউ। আর সেই আগুনের আলােয় দূর হয়ে যাচ্ছে ঘন কালাে অন্ধকার। এমন অপরূপ দৃশ্য আমি আগে কখনও দেখিনি। তাই হতবাক হয়ে উপভােগ করলাম।

একখানা মশাল ঝুলছে কোচের ছাদ থেকে। পর্বত থেকে নজর সরানাের সঙ্গে-সঙ্গে সে মশালের আলােয় সহযাত্রীর চেহারাটা দেখতে পেলাম আমি। ...আর ঠিক সেই মুহূর্তেই প্রেমে পড়ে গেলাম।
ইতিপূর্বে একটিবারের জন্যও প্রেম সংক্রান্ত কোন চিন্তাভাবনা মাথায় আসেনি আমার। তখন অবশ্য আমার চোখে ও ছিল স্রেফ প্রাণবন্ত ও সুন্দরী এক মেয়ে। কিন্তু ওরিজাবার শীর্ষ থেকে উঁকি দেয়া সূর্যের আলােয় আমার চোখে যেন নতুন রূপে ধরা দিয়েছে মেয়েটা। 

অদ্ভুত এক দীপ্তি খেলা করছিল এমার চোখে। চেহারায় ফুটে ছিল প্রসন্ন, স্নিগ্ধ একটা ভাব। নিজেকে আর বেঁধে রাখতে পারলাম না আমি। হার মানলাম প্রবৃত্তির কাছে। সারাটি জীবন ধরে অপ্রয়ােজনীয় মনে করা প্রেমভালবাসাকেই বড় আপন মনে হচ্ছিল ওই মুহূর্তে মেয়েটার চোখে চোখ পড়ল আমার। কথা বঁললাম না কেউই। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই বুঝে ফেলেছিলাম দু’জনে, এক সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে আমাদের জীবন? 

নিজেদের মনের ভাব গােপন করতে হালকা সব বিষয়আশয় নিয়ে আলাপচারিতায় মেতে উঠলাম আমরা। কথায় কথায় এমা জানাল, ওর খালা বলে দিয়েছেন, ও যেন ওরিজাবায় কোচ থেকে নেমে না পড়ে। যদিও জায়গাটা লা কনসেপশন নামক হাসিয়েণ্ডা থেকে মাত্র পঞ্চাশ মাইল দূরে।

অথচ মেক্সিকো সিটিতে নামলে প্রায় আশি মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে ওকে! কিন্তু তবুও যেন ও মেক্সিকো সিটি হয়েই হাসিয়েণ্ডায় যায়। কারণ ওখানে এমাকে অভ্যর্থনা করার জন্য লােক থাকবে। ওর খালু আসার আগ পর্যন্ত তারাই এমার দেখাশােনা করবে।
এই মুহূর্তে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা, দেখে অন্তত তা-ই মনে হচ্ছে। কিন্তু আমার ঘুম আসছে না। বসে-বসে মােটা যাজকের নাক ডাকার আওয়াজ শুনছি। থেকে-থেকে কানে আসছে ড্রাইভারের খিস্তি-খেউড়।। | একটা সস্তা আয়না ঝুলছে এমার মাথার ঠিক ওপরে। নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেলাম ওতে । করার মত আর কিছু পেয়ে, মনােযােগ দিয়ে নিজেকেই দেখতে শুরু করলাম খানিকক্ষণ আগে ওরিজাবার আলােয় এমার অপরূপ মুখটা আমাকে নিজের চেহারা সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে।

সব মিলিয়ে...নাহ, মন্দ না। আমি বেশ লম্বা, হ্যাংলাপাতলা। চুল কালাে, গায়ের রঙ শ্যামলা। গভীর আর বেশ বড়-বড় একজোড়া বাদামি চোখ আছে আমার। তবে আমার চেহারার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলাে, চওড়া কপাল। আর সবচেয়ে বাজে অংশ হলাে দুর্বল চিবুকটা। তবে আমার এই সাতাশ বছরের নধর দেহটাকে দেখে কেউ আন্দাজও করতে পারবে না, আমি কতটা কর্মঠ। কতটা তীক্ষ আমার নজর বা কতটা জোলো আমার স্মৃতিশক্তি! তবে এসব গুণের কোনটাই যে এমা বেকারের নজর কাড়েনি, সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছি।ওরিজাবার আলােতে খানিকক্ষণ আগে আমাদের ভিতরে যে অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে, তার সাথে যে কোন আত্মিক ব্যাপার-স্যাপার জড়িত নেই। তা-ও বেশ বুঝতে পারছি।
কী আর বলব, আমরা ডাক্তাররা আত্মিক গালগল্পে খুব


একটা বিশ্বাসী নই। মানব অনুভূতি কীভাবে সৃষ্টি হয়, তা আমরা বেশ ভালমতই জানি। আমার প্রতি এমার আকর্ষণ বােধ করার কারণ সম্ভবত আমার শ্যামলা রং। তেমনি, এমার ফর্সা চামড়ার জন্যই ওর প্রতি আমার এই আকর্ষণ। ওরিজাবা আর পরিস্থিতি আমাদের এই পছন্দকে আরেকটু গাঢ় বানিয়ে দিয়েছে শুধু, এই আরকী।। | সূর্য বহাল তবিয়তে উঠে এসেছে আকাশে। জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম, এখন একটা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে চলছি আমরা। আমাদের ওপরে একটা পাথুরে চাতাল। বিভিন্ন গাছ-গাছড়া আর কাঁটাঝােপ রাজত্ব করছে ওতে। কিন্তু নিচে গহীন এক খাদ।। | পাহাড়ের শরীর খুঁড়ে বানানাে হয়েছে রাস্তাটা। ঘন কুয়াশায় খাদের তলদেশ পুরােপুরি ঢাকা পড়ে আছে। ওপর থেকে তেমন কিছু চোখে পড়ছে না।

ভাবছিলাম, মদ্যপ কোন ড্রাইভারের হাতে পড়লে এই রাস্তায় দুর্ঘটনা অবশ্যম্ভাবী। ঠিক তখনই টের পেলাম, একদম সামনের খচ্চরটা হুমড়ি খেয়ে মাটিতে আছড়ে পড়েছে। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই শুনতে পেলাম গুলির আওয়াজ। পরমুহূর্তে হতবাক হয়ে দেখলাম, চালকের আসন থেকে খাদে লাফ দিয়েছে ড্রাইভার আর তার সঙ্গী! আচমকা নরক গুলজার হয়ে উঠল কোচের ভেতরটা। সবাই কেবল একটাই শব্দ উচ্চারণ করছে, ‘লুটোপ্লুটেরা! | কেঁদে উঠে ঈশ্বর স্মরণে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ব্যবসায়ীরা, সেই সঙ্গে কাপা-কাপা হাতে যতটা পাক্কা খায় দামি দ্রব্যাদি লুকাতে শুরু করল নিজেদের বুটে আর হ্যাটে। | দুই প্রিস্টের একজন তাে ডাক ছেড়ে কেঁদেই উঠলেন। অন্য জন অবশ্য নীরবে প্রার্থনা করছেন।

ততক্ষণে আতঙ্কিত খরগুলাে এমনভাবে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে যে, কোচটা উল্টে পড়ার উপক্রম হয়েছে। সেটা থামাতেই হয়তাে আমাদের অনাহুত অতিথিরা ম্যাচেটি বা তলােয়ার ব্যবহার করে মুক্ত করে দিল প্রাণীগুলােকে। তারপর খাদের দিকে ঠেলে দিল ওদেরকে। চকিতে ড্রাইভারের মত উধাও হয়ে গেল ওরাও। এরপর আমাদের দিকে নজর ফেরাল লুটেরার দল। | গালে ক্ষত চিহ্নওয়ালা এক কালাে চামড়ার দুবৃত্ত কোচের দরজার কাছে এসে বের হওয়ার নির্দেশ দিল আমাদের। শত্রুপক্ষে কম করে হলেও এক ডজন লুটেরা আছে দেখে বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিলাম হুকুমটা।
এক সারিতে দাঁড়ানাের আদেশ দেয়া হলাে আমাদের। 

পিঠ খাদের দিকে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমরা। লাইনের একেবারে শেষ মাথায়, এমা বেকারের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। আতঙ্কিত মেয়েটাকে সান্তনা দেয়ার জন্য ধরলাম ওর হাত।
এরপর যা ঘটল, তাতে পিলে চমকে গেল আমাদের সবার। কয়েকজন লুটেরা পাকড়াও করল প্রথম ব্যবসায়ীকে। লােকটার আপত্তি, বাধা কোন কিছু কানে না তুলে মুহূর্তেই নগ্ন করে ফেলল তাকে। তবুও তার মুখে খই ফুটছে দেখে মেরেই বসল। কাগজের নােট, স্বর্ণ-এক কথায় দামি যা-যা পেল, সব কিছুই ছিনিয়ে নিল ওরা। তারপর স্টেজকোচের ভিতরে নিয়ে বেঁধে ফেলল হতভাগাকে।

লাইনের পরবর্তী দু’জন হলেন দুই প্রিস্ট প্রথম জনকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করল তস্করেরা। এই লোকটাই হাউমাউ করে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন খানিকক্ষণ আগে। কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে হ্যা-বােধক জবাক দিলেন তিনি। | চোখে আগুন নিয়ে তাঁর দিকে ফিরে তাকালেন অপর প্রিস্ট। বিড়বিড় করে একটা গাল বকলেন তিনি, স্প্যানিশ ভাষায় যার অর্থ করলে দাঁড়ায় নির্লজ্জ মানুষ।
দ্বিতীয় প্রিস্টকেও একই প্রশ্ন করা হলাে। 

কিন্তু তিনি সাফ যেখানে লুটেরাদের হাত-পা ধরলে ক্ষীণ হলেও বাঁচার একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়।
মনে পড়ে গেল খচ্চরগুলাের কথাও। একরকম নির্বিবাদেই খাদের দিকে পা বাড়িয়েছিল প্রাণীগুলাে। অথচ বিপদ আঁচ করার সহজাত একটা ক্ষমতা আছে এসব অবলা জীবের। নিশ্চয়ই খাদটাকে আমরা যতটা খাড়া ভাবছি, ওটা ঠিক ততটা খাড়া নয়, ঢাল আছে।

চট করে একবার পেছনে ফিরে তাকালাম আমি। কিন্তু কিছুই ঠাহর করতে পারলাম না। মেক্সিকোতে ভােরবেলায় এত ভারী কুয়াশা পড়ে যে, খালি চোখে কিছু দেখতে পাওয়াটা দুরূহ।।
নিজেকে বােঝালাম, কিছুই না করলে সামনে প্রতীক্ষায় রয়েছে নিশ্চিত মৃত্যু। তার চেয়ে বরং ঝুঁকি নেয়াটাই সমীচীন হবে। একটু-একটু করে খাদের দিকে পিছিয়ে যাচ্ছি, ঠিক তখনই এমা বেকারের কথা মনে পড়ল আমার। যদি মেয়েটাকে সঙ্গে নিই, তাহলে সফলভাবে পালানাের সম্ভাবনাটা অনেকাংশে কমে আসবে। আচমকা বিদ্যুৎ চমকের মত মনের আয়নায় ভেসে উঠল ওরিজাবার আলােয় দেখা সেই অপার্থিব সুন্দর মুখখানি।

PDF পড়তে আরো নিচে যান

তৎক্ষণাৎ ওটা মনে না পড়লে, সেদিন হয়তাে মেয়েটাকে ফেলেই পালাতাম।
নাহ্, সত্যটা স্বীকার করতে মােটেও লজ্জা পাচ্ছি না আমি। আমার স্বভাবটাই তাে এমন। আর এই পাতায় যা-যা লিখেছি তার মধ্যে এক রত্তি কপটতাও নেই। | জানি, জীবনী এভাবে লিখতে হয় না। কিন্তু আমি কেবল নিরেট সত্যটাই বলতে চাই। যেন পাঠকরা কিছুটা হলেও এই লেখাটাকে গুরুত্ব দেয়। | শারীরিক আর মানসিক-দুদিক দিয়েই আমি বেশ দুর্বল।

যেখানে লুটেরাদের হাত-পা ধরলে ক্ষীণ হলেও বাঁচার একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়।
মনে পড়ে গেল খচ্চরগুলাের কথাও। একরকম নির্বিবাদেই খাদের দিকে পা বাড়িয়েছিল প্রাণীগুলাে। অথচ বিপদ আঁচ করার সহজাত একটা ক্ষমতা আছে এসব অবলা জীবের। নিশ্চয়ই খাদটাকে আমরা যতটা খাড়া ভাবছি, ওটা ঠিক ততটা খাড়া নয়, ঢাল আছে।
চট করে একবার পেছনে ফিরে তাকালাম আমি। কিন্তু কিছুই ঠাহর করতে পারলাম না। মেক্সিকোতে ভােরবেলায় এত ভারী কুয়াশা পড়ে যে, খালি চোখে কিছু দেখতে পাওয়াটা দুরূহ।।
নিজেকে বােঝালাম, কিছুই না করলে সামনে প্রতীক্ষায় রয়েছে নিশ্চিত মৃত্যু। তার চেয়ে বরং ঝুঁকি নেয়াটাই সমীচীন হবে।

একটু-একটু করে খাদের দিকে পিছিয়ে যাচ্ছি, ঠিক তখনই এমা বেকারের কথা মনে পড়ল আমার। যদি মেয়েটাকে সঙ্গে নিই, তাহলে সফলভাবে পালানাের সম্ভাবনাটা অনেকাংশে কমে আসবে। আচমকা বিদ্যুৎ চমকের মত মনের আয়নায় ভেসে উঠল ওরিজাবার আলােয় দেখা সেই অপার্থিব সুন্দর মুখখানি। তৎক্ষণাৎ ওটা মনে না পড়লে, সেদিন হয়তাে মেয়েটাকে ফেলেই পালাতাম।
নাহ্, সত্যটা স্বীকার করতে মােটেও লজ্জা পাচ্ছি না আমি। আমার স্বভাবটাই তাে এমন। আর এই পাতায় যা-যা লিখেছি তার মধ্যে এক রত্তি কপটতাও নেই। | জানি, জীবনী এভাবে লিখতে হয় না। কিন্তু আমি কেবল নিরেট সত্যটাই বলতে চাই। যেন পাঠকরা কিছুটা হলেও এই লেখাটাকে গুরুত্ব দেয়। | শারীরিক আর মানসিক-দুদিক দিয়েই আমি বেশ দুর্বল।

যদিও গােটা জীবনে মৃত্যুর মুখােমুখি কম হতে হয়নি আমাকে। তবুও মরণকে ভয়ই পাই আমি। বিশেষ করে যন্ত্রণাদায়ক আর ভয়াবহ মৃত্যুকে। সে ভয়টা এতটাই অকৃত্রিম যে, বিপরীত লিঙ্গের কাউকে বাঁচাবার চেষ্টা করেও কখনও নিজের জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারতাম না আমি।
কিন্তু এমা আমার ভিতরে নতুন এক অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছে। ব্যাপারটা নিজের কাছে খুব একটা পছন্দ না হলেও এটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছিলাম যে, মেয়েটার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও রাজি আছি আমি! তাই কয়েক পা এগিয়ে এসে আবারও দাঁড়ালাম মেয়েটার পাশে।

‘শােনন, ফিসফিস করে বললাম। টেরও পেলাম না, কখন সম্বােধন পাল্টে ফেলেছি। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এই খাদটা পুরাে খাড়া না। আমি একটা ঝুঁকি নিতে চাই। নেবে?
‘অবশ্যই, চটজলদি বলে উঠল মেয়েটা। এদের হাতে পড়ার চেয়ে ঘাড় ভেঙে মরতেও রাজি আছি আমি।' | ‘তাহলে প্রস্তুত থেকো। সুযােগ পাওয়া মাত্রই ঝুঁকিটা নেব আমরা। এখনই যদি পালাতে চাই, তাহলে গুলি করে ফেলে দেবে আমাদের।'

নড করল এমা। বুঝতে পেরেছে।
আমার পাশে দাঁড়ানাে চতুর্থ এবং শেষ বাবসায়ীর পালা চলে এল। কিন্তু তখন পর্যন্ত পালানাের কোন সুযােগ মেলেনি। ভাবছিলাম ঝুঁকি নিয়েই হয়তো লাফ দিতে হবে। ঠিক তখনই ভাগ্যদেবী মুখ তুলে চাইলেন আমাদের দিকে। ব্যবসায়ী লােকটা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল, দুর্গতি আছে তার কপালে। বাঁচার কোন আশা নেই। তাই ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটতে শুরু করল সে। প্রাণপণে ফেলে আসা রাস্তা ধরে দৌড়ানাে শুরু করল হতভাগা লােকটা।

হতচকিত ভাবটা কাটিয়ে ওঠা মাত্রই একজন বাদে অন্য সব লুটেরা পিছু নিল ভূতপূর্ব বন্দির। | পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ডাকাতটার নজরও তখন পলায়নরত ব্যবসায়ীর দিকে। তবে কপাল ভাল, আমাদের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। কোচের দরজা পাহারা দেয়ার দায়িত্ব পড়েছে তার ঘাড়ে। এই মুহূর্তে তিন ব্যবসায়ী আর এক প্রিস্টকে বেঁধে রাখা হয়েছে কোচের ভেতরে। | রণ-হুঙ্কার ছেড়ে পলায়নরত ব্যবসায়ীর দিকে ধেয়ে গেল তস্করের দল। থেকে-থেকে গুলি ছুঁড়ছে। অবশেষে এক দুর্বত্ত ধরে ফেলল হতভাগা লােকটাকে ম্যাচেটির এক কোপে ধড় থেকে আলাদা করে ফেলল মাথা!
‘আর দেখার দরকার নেই, সাবধান করে দিলাম সঙ্গিনীকে। জলদি এসাে।

খাদের একদম কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালাম দুজনে। মাত্র ফুট খানেক নিচ থেকে সব কিছু ঢেকে রেখেছে ঘন কুয়াশা। একদম কিছুই দেখা যাচ্ছে না। খানিকটা ইতস্তত করলাম-হয়তাে পরবর্তী পদক্ষেপটাই আমার জীবনের সর্বশেষ পদক্ষেপ। | ‘এখনকার চেয়ে খারাপ অবস্থা তাে আর হবে না, তাই
? ঈশ্বরের নাম নিয়ে লাফ দাও,' ফিসফিসিয়ে বলল এমা। তারপর আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই সবেগে লাফিয়ে পড়ল খাদে। | মাত্র কয়েক ফুট নিচ থেকে ভেসে আসা মেয়েটার উস্ফুল্ল কণ্ঠস্বর যেন স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিল আমার আতঙ্কিত হৃদয়ে! কালবিলম্ব না করে আমিও অনুসরণ করলাম ওকে। | মেয়েটার পাশে এসে নামলাম আমি। তারপর যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি পিছলে নেমে চললাম খাদের দেয়াল বেয়ে। আমার মনে হয় না, কেউ আমাদেরকে পালাতে দেখেছে। অবশ্য ব্যাপারটা পাহারায় থাকা লুটেরার চোখে পড়লেও পড়তে পারে। তবে আমাদেরকে ধরার চেয়ে স্টেজ কোচ আর ওর পাশেই হাঁটু গেড়ে বসে থাকা প্রিস্টের দিকে নজর রাখাটাকেই সম্ভবত বেশি জরুরি মনে হয়েছে তার কাছে।

কুয়াশা কিছুটা হালকা হয়ে এলে দেখলাম, আমাদের ঠিক নিচে, খাদের কিনারা থেকে একটা পাথুরে শাখা বেরিয়ে আছে। তবে বাম দিকে শূন্যের রাজত্ব, ওদিকটায় খাদটা ভয়ানক গভীর। কিছু গাছের মাথা চোখে পড়ছে অনেক নিচে।।
কোন পিছু-ধাওয়াকারীর আওয়াজ শুনতে না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেব এখানে। সেই সঙ্গে এটাও উপলব্ধি করতে পারলাম, আমাদের বাম পাশে মাত্র পাঁচ গজ দূরের খাদটা এতটাই খাড়া যে, কোন বিড়ালও সেটা বাইতে পারবে না। 

Doctor Thern PDF Bangla

File Type: Google Drive Direct

File Size: 8 MB

Author: henry rider haggard pdf Bangla

Rating: 4.5/5



‘কপাল ভাল আমাদের। লাফ দেয়ার জন্য একেবারে ঠিক জায়গাটাই বেছে নিয়েছিলাম। এমাকে দেখালাম। | ‘আমরা বেছে নিইনি,' প্রতিবাদ জানাল ও। আমাদের জন্য ওপরওয়ালাই জায়গাটা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।'

ওর বলা শব্দগুলাে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই একটা আর্তচিৎকার ভেসে এল ওপর থেকে। আমাদের আর আকাশের মধ্যে ঝুলে থাকা কুয়াশার গাঢ় পর্দাটা ভেদ করে ভারী কিছু একটা নেমে এল নিচে। | আমাদের পাশ দিয়েই সাঁই করে বেরিয়ে গেল স্টেজ কোচটা। খাদের নিচে পড়ে টুকরাে-টুকরাে হয়ে গেল ওটা। ভাল করে দেখে, নিশ্চিত হওয়ার জন্য ছুটে গেলাম আমরা। তবে জিনিসটা যে কী, সেটা আগেই বুঝতে পেরেছি।

স্টেজ কোচের খণ্ড-বিখণ্ড দেহের পাশে পড়ে আছে আমাদের পাঁচ সহযাত্রীর দলা পাকানাে লাশ।।
সময়মত পালাতে ব্যর্থ হলে হয়তাে আমাদেরও এই একই পরিণতি ভােগ করতে হত!
‘ওহ্! ঈশ্বরের দোহাই, চলে এসাে, বিড়বিড় করে বলল এমা। নিচের দৃশ্যটা ওকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। দাড়িয়ে গাছগুলাের আড়ালে আশ্রয় নেয়ার জন্য ছুটতে শুরু করলাম আমরা।


হাসিয়েও ‘ওগুলাে কী?' বুনাে কলার ঝােপে লুকিয়ে থাকা কয়েকটা প্রাণীর দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইল এমা।

তাকিয়ে দেখি, স্টেজ কোচ থেকে লুটেরাদের মুক্ত করে দেয়া খচ্চরগুলাের মধ্য থেকে দুটো ভীতসন্ত্রস্ত প্রাণী আশ্রয় নিয়েছে ওখানটায়! এখনও হার্নেস ঝুলছে ও-দুটোর গলায়।
‘চড়তে পারবে?' এমার কাছে জানতে চাইলাম। উত্তরে কেবল নড করল মেয়েটা।
খচ্চর দুটোকে পাকড়াও করতে বেগ পেতে হলাে না। কোন কাজে লাগবে না বলে হার্নের্সগুলাে খুলে ফেললাম। তারপর একটা খচ্চরের ওপরে এমাকে, নিজে চেপে বসলাম অন্যটার পিঠে। 

নষ্ট করার মত বিন্দুমাত্র সময়ও নেই আমাদের হাতে। চলা শুরু করব, ঠিক এমন সময় পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠল, সেনর।' ছোঁ মেরে পকেটের পিস্তলটা তুলে নিলাম হাতে। ঘুরে দেখি, একজন মেক্সিকান দাঁড়িয়ে আছে সামনে! 

‘গুলি করবেন না, সেনর, ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল লােকটা। পরে জানতে পেরেছি, এক আমেরিকান জাহাজে কিছুদিন কাজ করায় কাজ চালাবার মত ইংরেজি শিখে নিতে পেরেছিল ও। আমি ড্রাইভার, অ্যান্টনিয়াে। আমার সহকারী ওখানে, হাত তুলে খাদের দিকে ইঙ্গিত করল সে। ও মৃত, কিন্তু আমি বেঁচে আছি। আপনি দুষ্ট লােকদের হাত থেকে পালাতে পেরেছেন, আমিও পেরেছি। কিন্তু ওরা এখন আমাদের সবাইকে খুঁজতে আসছে। আপনারা কোথায় যাবেন?'
‘মেক্সিকো জবাব দিলাম।

‘মেক্সিকোতে যাবেন না, সেনর। মন্দ লােকেরা পুরাে রাস্তায় নজর রাখছে। ম্যাচেটি আর তলােয়ার আছে ওদের কাছে। হাতে পেলেই মেরে ফেলবে আমাদেরকে। ওরা চায়
, জীবিত কেউ সৈন্যদের কাছে সাক্ষী হয়ে ফিরুক।' | ‘তুমি কি কনসেপশন নামের হাসিয়োটা চেন? স্যান হােসে শহরে? জানতে চাইল এমা। | ‘হ্যাঁ , সেনােরা। আলবত চিনি। সেনর গােমেজের হাসিয়েণ্ডা ওটা। এখান থেকে প্রায় এক দিনের পথ। তুরিত জবাব এল।

‘তাহলে ওখানেই নিয়ে চলাে আমাদের, শান্ত গলায় বললাম আমি। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে হয় না। চলা শুরু হলাে আমাদের ক্ষুদ্র দলের। পাহাড়ি পথ ধরে খচ্চরগুলােকে যতটা সম্ভব দ্রুত চালালাম আমরা। আমাদের পাশে-পাশে হেঁটে চলল অ্যান্টনিয়াে ।
সূর্যাস্ত পর্যন্ত এগিয়ে চললাম (রিনৗবাধায়। সতর্ক রইলাম পুরােটা সময়। যদিও তস্কুলের টিকিটাও চোখে পড়েনি কখনও। আমার মনে হয়, ওরা ধরে নিয়েছিল যে, নির্ঘাত বেঘােরে
ফুসফুসের প্রদাহকে প্রচণ্ড ভয় পায়। 

তাই দিন শুরুর কুয়াশাটা না কাটা পর্যন্ত মুখের ওপর থেকে সেরাপ সরায় না। | ‘কী খবর, অ্যান্টনিয়াে? জানতে চাইলাম। ‘ডাকাতেরা কি আমাদের পিছু নিয়েছে? | ‘না, সেনর, নেয়নি। ডাকুরা এই পথে আসতে ভয় পাচ্ছে। কারণ এই লােক বলছে, অনেক মানুষ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে স্যান হােসেতে। | বললাম, শুনে খারাপ লাগছে। কিন্তু আমাদেরকে এগুতেই হবে।
প্রথমটায় অ্যান্টনিয়াে মােটেও এগুতে রাজি হলাে না। পরে অনেক পুরস্কারের লােভ দেখাতে হলাে ওকে। লুটেরাদের পিছু ধাওয়ার ভয়েই হােক আর পুরস্কারের লােভেই হােক, শেষমেশ পথ দেখাতে রাজি হলাে লােকটা।। | স্প্যানিশে আমার অদক্ষতা আর ইংরেজিতে অ্যান্টনিয়াের জ্ঞান প্রায় শূন্যের কোঠায় হওয়ায়, ওর ভয়ের আসল কারণটা তখন ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারিনি আমি।। | সন্ধ্যার দিকে কনসেপশন নামক হাসিয়েণ্ডাটার বিশাল এবং সাদা চুনকাম করা দালানটা হাত তুলে আমাদেরকে দেখাল অ্যান্টনিয়াে। স্যান হােসে থেকে দেখা যায়, এমন একটা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে ইমারতটা।

স্যান হােসেকে শহর বললে বাড়িয়ে, আবার গ্রাম বললে কমিয়ে বলা হয়ে যায়। প্রায় তিন হাজার মানুষের বাস ওই মফস্বলে।। | নুড়ি বিছানাে রাস্তা ধরে শহরের প্রবেশ মুখে এসে পৌছলাম আমরা।
ঠিক তখনই আচমকা একটা চিৎকার ভেসে এল কানে। ঘুরে তাকিয়ে দেখি, দু’জনরাইফেলধারী লােক ছুটে আসছে আমাদের দিকে! প্রায় ধরেই নিয়েছিলাম যে, এরা নির্ঘাত আমাদের পিছু-ধাওয়াকারী সেই গলাকাটা ডাকাতের দল। আতঙ্কে হাত-পা পেটের ভিতরে সেঁধিয়ে যেতে বসেছিল আমার। তবে পরে জানতে পারি, আসলে ওরা ছিল ক্যাভালরি পুলিস বা রুরালেস। 

বােধের অগম্য ভাষায় আমাদেরকে শহরে না ঢােকার অনুরােধ জানাচ্ছিল ওরা। | অ্যান্টনিয়াে আর ওদের দুজনের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও খচ্চরগুলােকে সামনে ছােটালাম আমি। এত দূর এসে ফিরে যাওয়ার কোন অর্থ হয় না। একটা সাদা পাথর চিহ্নিত জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল রুরালেস দু’জন। কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থেকে ফিরতি পথ ধরল। ততক্ষণে বুঝে গেছে, অনুরােধে কোন ফল হয়নি। শহরটার প্রধান সড়ক ধরে এগিয়ে চললাম আমরা। এলাকাটাকে ভীষণ জনশূন্য মনে হচ্ছিল!
প্লাজার কাছে পৌঁছনাের পর একটা খচ্চর-টানা কার্টের ওপর নজর পড়ল আমাদের। 

খচ্চর দুটোকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একজন পুরুষ মানুষ। লােকটা এমনভাবে সেরাপ দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে রেখেছে, যেন প্রত্যুষের কুয়াশা কাটেনি এখনও! | কার্টটা কালাে কাপড় দিয়ে ঢাকা। তবে যতটুকু চোখে পড়ছে, তাতে মনে হচ্ছে...কিন্তু না, তা কী করে সম্ভব! এদিকে অ্যান্টনিয়াে বার-বার নিজের বুকে ক্রস আঁকছে আর মুখে বিড়বিড় করে বলছে: মুয়ের্তা! শব্দটা অন্য কিছুও হতে পারে, তবে আমার কানে অনেকটা ওরকমই শােনাল।

এই মুহূর্তে প্লাজার ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা। সাধারণত জায়গাটা গোন-বাজনায় ভরে থাকে সবসময়। মেক্সিকানরা ফুর্তিবাজ জাতি। যদূর জানতাম, স্যান হােসের অধিবাসীরাও এর ব্যতিক্রম নয়। | কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে, সদা কর্মব্যস্ত এই প্রাজায় খানিকক্ষণ পর-পর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা কিছু পাথুরে স্তম্ভ ছাড়া প্রাণের কোন নিদর্শনই যেন চোখে পড়ছে না! প্রায় প্রতিটা স্তম্ভের ওপর একটা করে খিলান। প্লাজার ঠিক মধ্যখানে একটা কৃত্রিম ফোয়ারা থেকে অবিরাম পানি ঝরছে। ফোয়ারার কাঠামোেটা বেশ মনােমুগ্ধকর।

‘এত মানুষ ঘুমােচ্ছে এখানে! বিস্মিত গলায় বলে উঠল এমা। এরইমধ্যে পাঁচ-ছয়জন ঘুমন্ত ব্যক্তিকে অতিক্রম করে ফেলেছি আমরা। আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে মানুষগুলাে। ওদিকটায় আরও অনেকে শুয়ে আছে। অদ্ভুত ব্যাপার! ঘরবাড়ি ছেড়ে ভরা সন্ধ্যায় এমন খােলা জায়গায় এসে ঘুমানাের মানে কী?

আচমকা এক থুড়থুড়ে বুড়ি চট করে উঠে দাঁড়াল। পাশের যুবতী মেয়েটার শরীর থেকে টেনে সরিয়ে দিল কম্বল। তারপর ফোয়ারা থেকে আনা এক বালতি ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিল মেয়েটার ওপর।
হতভাগিনীর দিকে এক পলকের জন্য তাকিয়েছিলাম কেবল, ওটাই যথেষ্ট ছিল আমার জন্য। | মেয়েটার গুটি বসন্তে ভরা মুখটা আমার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিল। ওর শরীরের অবস্থাটা বর্ণনা করা আমার সাধ্যের অতীত।

যদিও এর আগে কোন গুটি বসন্তে আক্রান্ত রােগীর চিকিৎসা করিনি আমি, তবুও রােগটাকে পরিক্ষাঁর চিনতে পারলাম। আমি এমন একজন ডাক্তার, যে মানবদেহের কোন রােগকেই তেমন একটা ভয় পায় না। তবে গুটি বসন্তের কথা আলাদা। এই বিশেষ রােগটাকে আমি চিরকালই ভয় পেয়ে এসেছি।
এতে অবশ্য আমার খুকু একটা দোষ নেই। কারণ, ব্যাপারটা জন্মগত। সম্ভবতআমার জন্মের সময়ই মা জানতে পারেন যে, বাবা গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়েছেন। তখন তিনি যে ভয়টা পেয়েছিলেন সেটা পরে আমার ভিতরেও সংক্রমিত হয়েছে।

এই রােগটাকে আমি এতটাই ভয় পাই যে, গুটি বসন্ত নিয়ে কাজ করে এমন এক হাসপাতালের ভীষণ লােভনীয় একটা প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছিলাম নির্দ্বিধায়।
পরে যে হাসপাতালে কাজ নিয়েছিলাম, সেখানে বসন্তের রােগী এলে, তাদের চিকিৎসার ভার তুলে দিতাম অন্য ডাক্তারদের হাতে। জানি, এতে করে খানিকটা বদনাম রটে গিয়েছিল আমার নামে। কিন্তু আমি নিরুপায়। | এমনকী এখনও আঁতকে না উঠে, ভ্যাকসিন দেয়ার ফলে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, তার দিকে তাকাতে পারি না আমি। কারণ ক্ষতটা দেখতে অনেকটা গুটি বসন্তের মত।
সত্যি বলতে কী, গুটি বসন্তকে আমি যমের মত ভয় পাই। তবে ভ্যাকসিনেশনের রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতার ওপর আমার যথেষ্টই আস্থা আছে। কিন্তু তবুও কেন যেন নিজেকে ভ্যাকসিন দিতে রাজি করাতে পারি না।

অবশ্য একদম ছােট বেলায় অন্য সবার মত আমাকেও টিকা নিতে হয়েছিল। যার সাক্ষী আজও বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি নিজের দেহে। কিন্তু শৈশবে নেয়া ভ্যাকসিন দুর্বল হতে শুরু করে সময়ের সাথে-সাথে। পরবর্তী ডােজগুলাে দেয়া না হলে, পরিণত বয়সে সেটা আর তেমন কার্যকরী থাকে
অবচেতন মনেই হাতের লাগামটা টেনে ধরলাম। সঙ্গেসঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল ক্লান্ত খচ্চরটা। ম্যালিগন্যান্ট গুটি বসন্ত! ভীষণ মারাত্মক, বিড়বিড় করে বললাম আমি। আর এই বােকার দল কিনা ঠাণ্ডা পানি দিয়ে এই রাতে বাগের চিকিৎসা করতে চাইছে!’
কথার শব্দে মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল বুড়ি। ‘সি, সেনর ইংলেস। অপার্থিব একটা হাসি ফুটে আছে তার মুখে। কেমন যেন গায়ে কাঁটা দেয়। ভিরুয়েলা, ভিরুয়েলা!

চলবে... ( নিয়মিত এই পোস্টে সিরিয়াল অনুযায়ী পরবরতী পর্বগুলো যুক্ত হবে) 

ডক্টর থার্ন pdf বইসহ হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড এর জনপ্রিয় বইগুলো পড়তে নিয়মিত আমাদের ওয়েবসাইটের আর্টিকেল পড়ুন। 

Tags

Post a Comment

0Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
Post a Comment (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !